৪ মার্চ ২০২৪, সোমবার, ৬:৫৯

শরীফ থেকে শরীফা : নব্য ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আদি তত্ত্ব

-ড. মো: কামরুজ্জামান

প্রাকৃতিক সমাজব্যবস্থা সব প্রাণীর জীবনে শৃঙ্খলা এনে দিয়েছে। এটি আল্লাহ প্রদত্ত ভারসাম্যপূর্ণ এক সুন্দর ও টেকসই ব্যবস্থাপনা। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতির ফলে নতুন সব সোস্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামিংয়ের উদ্ভাবন ঘটেছে। এর মাধ্যমে মানুষ ভালোমন্দ দু’টিই উপভোগ করছে। তবে কিছু নব্য ইঞ্জিনিয়ার গোষ্ঠী সোস্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামিংয়ের নামে গোপন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার তেমনই একটি। তাদের মূল উদ্দেশ্য পরিবার, ধর্ম, জাতি ও রাষ্ট্রকে ধ্বংস করা। আন্তর্জাতিক এলিটদের দ্বারা সর্বগ্রাসী এক গভর্নমেন্ট তৈরিই তাদের মিশন। তাদের প্রতিষ্ঠিত ওই গভর্নমেন্টের অধীনে থাকবে একটিমাত্র ধর্ম, একটিমাত্র গোষ্ঠী ও একটিমাত্র লিঙ্গ। অর্থাৎ তারা নতুন ধরনের এক পৃথিবী গড়তে চায়। যে পৃথিবীতে মানুষের শুধু একটিই নাম থাকবে। সেখানে নারী-পুরুষের কোনো পরিচয় থাকবে না। পরিভাষাগতভাবে তারা এর নাম দিয়েছে ‘হেটেরোহেমো’। সমাজজীবনের প্রাথমিক ও মূলভিত্তি হলো বিয়ে। এ বিয়ের মাধ্যমেই একটি পরিবার সৃষ্টি হয়। পরিবার মানুষকে তার মানবিক পরিচিতি শিক্ষা দেয়। পরিবার জীবনের লক্ষ্য এবং বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য জানায়। পশ্চিমা বিশ্বে অনেক আগেই পারিবারিক বন্ধনের বিলুপ্তি ঘটেছে। অধুনা কমিউনিজম পরিবারকে গুরুত্বহীন করে তুলেছে। অথচ বিশ্ব-সভ্যতায় পরিবারের গুরুত্ব অপরিসীম। সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই পরিবারের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে সমাজ। আর বৃহৎ সমাজের সমষ্টির নাম হলো রাষ্ট্র। কিন্তু তথাকথিত এলিট ইঞ্জিনিয়াররা সমাজের মূলভিত্তি পরিবারপ্রথা বিলোপ করতে চায়। পরিবার গঠন ও মানবজাতির বিকাশ সাধনে বিপরীত লিঙ্গের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। মানবসৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই পরস্পর দু’টি বিপরীত লিঙ্গের বিকল্প কেউ ভাবেনি। শুধু মানব জাতিই নয়; বরং সব প্রাণীর বংশ বিস্তারে এটি এক স্বাভাবিক নিয়ম হিসেবেই চলে আসছে। কিন্তু তথাকথিত আধুনিক এলিটরা নন্দিত সভ্যতাকে ভেঙে দিতে উদ্যত। এ পাগলামির ঢেউ বাংলাদেশেও আছড়ে পড়েছে।

জনগণকে শাসন ও শোষণকারী এলিটদের রয়েছে আন্তর্জাতিক শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এ শক্তিটি প্রকৃত লিঙ্গগত পরিচয় নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তারা তরুণীদেরকে পুরুষের মতো চলতে শেখাচ্ছে, প্রকৃতবিরুদ্ধ আচরণে উৎসাহ জোগাচ্ছে। নারী ও পুরুষের মধ্যে স্থায়ী বৈবাহিক বন্ধনে বাধা সৃষ্টি করছে। এ ক্ষেত্রে তারা কোমলমতি শিক্ষিতা নারীদেরকে টার্গেট করেছে। লক্ষ্যে পৌঁছতে তারা প্রচুর কৌশল এবং ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছে। তারা নারীদেরকে ফেমিনিজমের (নারীবাদ) নামে পুরুষবিদ্বেষী করে তুলছে। এর মাধ্যমে তারা তাদেরকে সুরক্ষা, স্বাধীনতা ও সমৃদ্ধির মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে। নারীসুলভ আচার-ব্যবহার ও তার সামাজিক দায়দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে ভুলভাল ধারণা দিচ্ছে।

ফেমিনিজম নারীকে দৃশ্যত ফাঁদে ফেলে দিকভ্রান্ত করে। এলিট নামক পাগলদের খপ্পরে পড়ে ইতোমধ্যে দিশেহারা হয়ে পড়েছে মিলিয়ন মিলিয়ন নারী ও পুরুষ। একত্রে বসবাসের মাধ্যমে তাদের কাছে সেক্সুয়াল রিলেশনটি মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা বিয়ে ছাড়াই যৌনতাকে সহজ ও স্বাভাবিক করে তুলেছে। তারা সমস্ত মানবিক সম্পর্কের মধ্যে যৌনতার অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রথম ও প্রধান টার্গেট শিশুশ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক। পাঠসূচি থেকে তারা পরিকল্পিতভাবে ধর্মশিক্ষা নির্বাসন দিয়েছে। কিভাবে সেক্স উপভোগ করবে এটিই হলো একজন দুধের শিশুর পাঠ্যসূচি! তারা শিশুদেরকে বানোয়াট, ভিত্তিহীন ও হাস্যকর ‘শরীফ থেকে শরীফা’র গল্প পড়াচ্ছে। তারা সমাজের নারী ও পুরুষের মধ্যে নিয়ন্ত্রণহীন শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন ও স্বেচ্ছাচারিতার জন্ম দিচ্ছে।

মিডিয়ার বদৌলতে গোটা দুনিয়ায় বানোয়াট এসব গল্পের কথা ছড়িয়ে পড়েছে। দেশে বর্তমানে ছয় কোটি শিশু আছে যাদের বয়স ১৮ বছরের মধ্যে। এসব শিশুর অনেকে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। পর্নোগ্রাফি নারীকে পুরুষের চোখে ভোগপণ্য হিসেবে উপস্থাপন করছে। ফলে সমাজে নারীর প্রতি নির্যাতনের নানান মাত্রা যুক্ত হচ্ছে। ফলে নারী ও পুরুষের মধ্যে প্রকৃত প্রেম-ভালোবাসা গড়ে উঠছে না। বিয়ে, সন্তান উৎপাদন ইত্যাদি ক্রমেই গৌন হয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে মানবীয় গুণের পরিবর্র্তে নির্জীব ও প্রাণহীন দানবের আচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। কর্মজীবী মানুষের মধ্য থেকে কর্মস্পৃহা ও প্রাণচাঞ্চল্য উড়ে যাচ্ছে। শিশুদের মধ্য থেকে সুকুমারবৃত্তি হারিয়ে যাচ্ছে। সমাজে নানা মন্দ সংস্কৃতির জন্ম নিচ্ছে। ভালোকে ভালো আর মন্দকে মন্দ বলবে এমন মানুষ সমাজ থেকে লোপ পাচ্ছে। পুরুষ প্রাকৃতিকভাবেই ক্ষমতাশালী ও নেতৃত্বদানে পারঙ্গম। নারী প্রেমময়ী। তারা ভালোবাসার বিনিময়ে পুরুষের বীরত্বের প্রতি আকৃষ্ট ও মুগ্ধ হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন পুরুষও নারীর প্রতি নির্ভরশীল হতে পারে। এসবই দু’জনের প্রেম, ভালোবাসা বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই হয়ে থাকে। এখানে জয়-পরাজয় বা হার-জিতের প্রশ্ন থাকে না। কে ছোট, কে বড়, কে মহান, কে অধম ইত্যাদি কোনো ব্যাপারও এখানে থাকে না। দু’জনের পারস্পরিক সহযোগিতা ও আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের ভিত্তিতেই তারা সাফল্যের সোপানে অগ্রসর হয়। পুরুষের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে দায়িত্ব গ্রহণ, পরিবার গঠন ও স্ত্রী-সন্তানকে চরম ভালোবাসায় আগলে রাখার মাধ্যমে। স্বামী, সন্তান এবং সংসারের প্রতি যতœ, ভালোবাসা হচ্ছে নারীত্বের সুমিষ্ট দায়। পরিবার গঠনের পর নারীত্বের দায় মিটিয়ে একজন নারী তার ক্যারিয়ারকে গুরুত্ব দিতে পারে। জাতি গঠনেও একজন নারী গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। এতে কারো অভিযোগ থাকার কথা নয়। তবে নারীবাদের গোপন এজেন্ডা নারীকে বিয়ে ও পরিবারবিরোধী করে গড়ে তুলতে চায়। ঘরের কাজ, সন্তান জন্মদান ও লালন-পালনকে তারা জঘন্য কাজ বলে অভিহিত করছে। স্বামী, সন্তান আর সংসার বাদ দিয়ে ক্যারিয়ারকেই তারা সামনে এগিয়ে আনছে। এ বিষয়ে সচেতনতা দরকার।
সেন্ট্রাল ইনটেলজেন্ট এজেন্সি (সিআইএ) আমেরিকার কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা। পৃথিবীর সেরা এই গোয়েন্দা সংস্থার কাছে গোটা দুনিয়ার তথ্য সবসময় আপডেট থাকে। এটির মাধ্যমে মুসলিমবিশ্ব একধরনের জালে বন্দী হয়ে আছে। সিআইএ, রথচাইল্ড ও রকফেলার ফাউন্ডেশনের মতো অসংখ্য সঙ্ঘ গোটা দুনিয়াকে জালের মতো আটকে রেখেছে। এরা সারা দুনিয়ায় নিয়মের নামে অনিয়মের রাজত্ব কায়েম করেছে। এ সমস্ত সঙ্ঘ মূলত ‘লুসিফারিজম’ মতাদর্শে বিশ্বাসী। লুসিফারিজম একটি পথভ্রষ্ট শয়তানি মতাদর্শ। যুগ অনেক আধুনিক হয়েছে। শয়তানও আর সেকেলে নেই। সেও বেশ মডার্ন হয়েছে। শয়তান বিভিন্ন আধুনিক চটকদার কথা ও কর্ম নিয়ে হাজির হয়েছে। যেগুলোকে ‘শ্যাটানিক স্পিচ ও শ্যাটানিক ওয়ার্ক’ নামে নতুনভাবে অভিধানে সংযোজিত হয়েছে। এ মতাদর্শের দর্শনই হলো উল্টো নীতি। এটি শয়তানের আধুনিক এক মস্তবড় হাতিয়ার। এটির মাধ্যমে শয়তান মানুষকে সবকিছু উল্টোভাবে প্রদর্শন করে। এ ক্ষেত্রে শয়তানের কিছু জনপ্রিয় ডায়ালগ আছে। যা আধুনিক উদভ্রান্ত তরুণ-তরুণীর কাছে মডেল হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন- ‘আপ সাইট ডাউন, ইনসাইড আউট, ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট, ব্যাড ইজ গুড, গুড ইজ ব্যাড, জান্নাত ইজ জাহান্নাম, জাহান্নাম ইজ জান্নাত ইত্যাদি এ মতাদর্শের ডায়ালগ। এসব ডায়ালগ দ্বারা শয়তান মূলত সব জিনিসকে উল্টো করে বুঝাতে চায়। শয়তান বুঝাতে চায়, যা উপরে তাই নিচে, যা সাদা তাই কালো, যা ভালো তাই খারাপ, যেটি সাদা সেটিই কালো, যেটি জাহান্নাম সেটিই জান্নাত ইত্যাদি। অর্থাৎ তুমি ভালো করো বা মন্দ করো তাতে কোনো সমস্যা নেই।

বাংলাদেশেও এ মতাদর্শ বেশ মাথচাড়া দিয়ে উঠেছে। এ ডায়ালগের সত্যায়ন হিসেবে ঢাকার লালমাটিয়ার একটি রেস্টুরেন্টের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। রেস্টুরেন্টটির নাম হলো- ‘আপ সাইড ডাউন’। অবশ্য এসব নামকরণে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু হোটেলটির ভেতরে কিছু ক্যালিগ্রাফি চোখে পড়ার মতো। সেখানে অসংখ্য চোখের সমাহার লটকানো। সেটি দেখে নিশ্চিত হওয়া যায়, এটি উল্টো করে প্রচার করা হয়েছে এবং তারা লুসিফারিজমের সদস্য।

লুসিফারিজম নিত্যনতুন ট্রেন্ড, চিন্তাপ্রণালী, মতাদর্শ ও মতবাদ ইত্যাদি তৈরি করে মানুষকে পথভ্রষ্ট করছে। মিউজিক, সিনেমা, পাঠ্যবই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি হচ্ছে তাদের মাইন্ড কন্ট্রোলের অস্ত্র। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাদের লক্ষ্য জনসংখ্যা কমানো, গভর্নমেন্ট পাওয়ার বাড়ানো এবং মানুষের মাইন্ড কন্ট্রোল (বিবেক নিয়ন্ত্রণ) করা। লিঙ্গের পার্থক্য বিলোপ ও সমঅধিকারের বুলি আওড়িয়ে নারী-পুরুষ ও মা-বাবাদের ঘরের বাইরে এনে করপোরেশনের ওয়ার্কফোর্স তৈরি করা তাদের উদ্দেশ্য। বাবা-মাকে ঘরের বাইরে এনে বাচ্চাদেরকে তারা বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। বাবা-মায়ের শিক্ষা, আদর, স্নেহ ও ভালোবাসা থেকে তারা শিশুদেরকে বঞ্চিত করে। পারিবারিক শিক্ষার পরিবর্তে শিশুরা স্কুলশিক্ষার ওপর নির্ভর করে। শিক্ষা-কারিকুলাম যেহেতু তাদেরই হাতে তাই তাদের মতো করেই সিলেবাস প্রণীত হয়। কোমলমতি শিশুরা তাদের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়। তাদের ধাচেই গড়ে ওঠে।

লেখক : অধ্যাপক, দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/818496