৩ মার্চ ২০২৪, রবিবার, ২:২৯

শামীমদের হাত ধরেই তৃপ্তির ভোর হবে

-সালাহউদ্দিন বাবর

আরশি বা আয়না প্রতিটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কতটা প্রয়োজনীয়তা কাউকেই বুঝয়ে বলার দরকার হয় না। সকাল দুপুর সন্ধ্যা যখনই কোনো সচেতন মানুষ ঘর থেকে বের হতে চান, তখন অবশ্যই একবার আরশির সম্মুখে দাঁড়াতে হয়। মাথার চুল ও মুখমণ্ডলটা ঠিকঠাক আছে কি না, পরখ করে নেন। আরশিটা কখনো ভেঙে চৌচির হয়ে গেলে তা আর কোনো কাজে আসে না এবং তৎক্ষণাৎ ঘরের বাইরে জরুরি প্রয়োজন থাকলেও বেরোনো খুবই মুশকিল হয়ে পড়ে। আরশির জরুরতটা সবাই বোঝেন বলে তাকে নিরাপদ স্থানে সযতেœ রাখেন। সমাজ রাষ্ট্রীয় জীবনে যারা সৎ ও গঠনমূলক সমালোচক, তাদের প্রয়োজনটা ঠিক আরশির মতোই। প্রতি মুহূর্তের অত্যাবশ্যকীয় একটা অনুষঙ্গ। ঘরে আরশিকে যেমন যত্নে রাখতে হয়। সমাজ সংসারেও তেমন সৎ সমালোচকদের যত আত্তি করতে দ্বিধা করতে নেই। নিজেদের স্বার্থেই ওদের যন্ত্রণা দিতে নেই। কেউ-ই যেমন আরশি বা অপরের সাহায্য ছাড়া নিজের মাথাটা, শরীরের পেছনটা দেখতে পান না। এই সীমাবদ্ধতা সবাইকে মনে রাখতে হবে। সে জন্য সৎ সমালোচকদের বাঁচিয়ে রাখতে হয়। নিজের প্রয়োজনেই। আমাদের এমন সীমাবদ্ধতার কথা মনে রাখতে পারাটার মধ্যে কল্যাণ আছে।

সকালে আমাদের হয়তো কারোরই খেয়াল থাকে না এক সময় সন্ধ্যা হবে। এটা অমোঘ এবং অনিবার্য হলেও অনেকে গা করে না। আজকের দিনটাও যে শেষ দিন নয়, আরো বহু দিন থাকে। এমন বোধটাও থাকে না। আগামীকাল হয়তো অবস্থার পরিবর্তনও অসম্ভব নয়। দম্ভ নিয়ে চললে অনেক কিছুই মনে উদয় হয় না। আর ক্ষমতা প্রতিপত্তি হাতের মুঠোয় এলে কথাই নেই। যথেচ্ছা ব্যবহারে সম্ভাবনা থাকে ষোলআনা। তাতে সংশ্লিষ্টদের আপাতত লাভ হয় বটে; কিন্তু দিনের শেষে অঙ্কের হিসাব মিলানো দুরূহ হয়ে পড়ে। সমাজও হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। অথচ যারা দূরদর্শী, তারা মন-মানস এমনভাবে রচনা করেন। সব মৌসুমেই বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে মাঝ পথ ধরে চলেন। সময়ের কথাটা পরিশীলতভাবেই হলেও উচ্চারণ করেন। হক কথা বলতে কখনো পেছনে তাকান না। কেউ বেজার হোক বা খুশি হোক। তারা আসলে ধীমান বোদ্ধাজন। তবে এ-ও সত্য, এসব বোদ্ধাজনের সংখ্যা অগণন নয়। এরাই সমাজের সম্পদ। রাষ্ট্র সর্বত্রই এদের অবদান রাখার সুযোগ না হলে এই বোদ্ধাজনের ক্ষতিটা সবিশেষ না হলেও রাষ্ট্রের ক্ষতিটা অবধারিত। তাই এদের প্রয়োজনকে মানতে হবে। এরা ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না। এদেরই এই দৃঢ়তাকে সম্মানের সাথে দেখতে হবে। কখনোই তাদের পরিত্যাগ ঠিক হবে না।

যাই হোক, ওপরের বিমূর্ত কথাগুলো মনে এলো, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি দাপট দেখানোর ঘটনার খবর জেনে। হ্যাঁ আজ এমন দাপুটে ঘটনা এখানে সেখানে অহরহ সর্বত্র ঘটছে। তবে যে ঘটনাটির বিষয় এ লেখার উপলক্ষ। সেটা ময়মনসিংহ শহরে ঘটেছে। তরুণ শামীম আশরাফ যানজট, জলাবদ্ধতাসহ ময়মনসিংহ শহরের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে হরদম কথা বলতেন। সে ব্রহ্মপুত্র নদের হাঁটু পানিতে নেমে ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ করত আরো অনেক কিছুই সে করেছে। একটি জাতীয় দৈনিকের খবর পড়ে সম্প্রতি জানা গেছে, বেনামী পোস্টারের মাধ্যমে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়রের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগে ৫৪ ধারায় সেই তরুণকে গ্রেফতার করা হয়। শহরের এই তরুণ কবি ও অধিকারকর্মী শাশীম আশরাফকে শেষে জামিন দেয়া হয়েছে বটে। তবে এখানেই তার ল্যাটা চুকে যায়নি। জামিনে মুক্তি পাওয়ার পরপরই ওর বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা ঠুকে দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বোঝা যাচ্ছে শামীমের ভোগান্তি সহসা চুকে যাবে না, দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। তবে সম্মুখে ওই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। সেখানে ভোট হবে না কাউকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে সেটা ভবিতব্য। তার পর কী হবে। সেটা শামীমের মতো কারোরই জানা নেই।

যে কথাগুলো নিবন্ধের সূচনা ছিল। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে সূর্যোদয়ের পর সূর্যাস্ত যেমন অনিবার্য আর এ দেশে (অতীতের কথা স্মরণ করে বলছি) এটাও অবশ্যম্ভাবী কখনো ক্ষমতার পালাবদল হলে, পতিতজনের প্রতিপক্ষের রোষানলে পড়ে অপদস্ত অত্যাচারিত হতে হয় তাকে। কখনো কারণে, কখনো আবার অকারণেই। সেই দুর্যোগের সময় কিন্তু সেই পতিতজনের সুদিনের স্বজন সুহৃদয়দের আর দেখা পাওয়া যায় না পতিতজনের পাশে। কিন্তু বর্তমান (পরিবেশ পরিস্থিতি দেখেশোনে) খেপে যাওয়া এই শামীমরাই প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে তখন রাস্তায় নিরন্তর প্রতিবাদ জানায়। তখন অকুতোভয় শামীমরাই তার কষ্টের অতীতকে ভুলে যায়, দুস্থ পতিতের পাশে দাঁড়ায়। সবার বোঝা উচিত অকুতোভয় শামীমরা সমাজের বিরল যোদ্ধা। সব কালে সব সময় এরা থাকে পতিতজনের পাশে। সে জন্য এ শামীমদের ‘অপরাধ’কে কিঞ্চিত খাটো করে দেখাই উচিত। মনে করা হয়তো খুব দোষের হবে না যে, এক বাগানে হরেক রকম ফুল থাকতে পারে। বাগানকে সেই ফুল সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলতে পারে। এসব ফুলকে বৃন্তচ্যুত করা প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করার শামিল। মানুষ সীমাবদ্ধ প্রাণী, তাই তাদের পক্ষে বহু ক্ষেত্রেই ধৈর্য-সহিষ্ণুতা দেখানো, ক্ষমা করা কঠিন ব্যাপার। এ জন্য মনীষীরা পর্যন্ত স্রষ্টার কাছে এসব গুণ অর্জনের জন্য প্রার্থনা আর্জি পেশ করেছেন। ক্ষণে ক্ষণে স্মরণ করেছেন তাদের বোধ বিবেচনা স্বল্পতার কথা। তাই আমাদেরও তাদের সাথে অভিন্ন প্রার্থনায় শামিল হওয়া উচিত। ভুল করা ঠিক হবে না।

এসব শামীমরা সব সময় সমাজ বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে নিজেদের জন্য বিপদ ডেকে আনে। তারা অজ্ঞান নয়, স্বজ্ঞানেই সমাজ বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে নিজের জন্য নয়। বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষ্যকে সামনে রেখে। এ শামীমদের হাত ধরেই সব সময় দ্বিপ্তীমত তৃপ্তির এক প্রভাবের সূচনা হয়। ইতিহাসে তাদের নাম কখনো ওঠে। কখনো থাকে না। এরা কিন্তু কখনোই ইতিহাসে নাম উঠল কি উঠল না সে বিবেচনা না নিয়ে ঝড় বিক্ষুব্ধতাকে মাথায় তুলে তাদের কর্তব্যকে কখনো ভুলে থাকে না। শামীমদের কেউ মনে রাখুক না রাখুক। কাল-কালান্তরে এদের আবির্ভাব ঘটতে থাকবে। এরা স্রষ্টার এক অপূর্ব সৃষ্টি। যারা এদের খাটো করতে চায় তারাই খাটো হয়ে যান। এ শামীমরা কখনো বড় হতে চায় না বলেই তাদের খাটো করা অসম্ভব। জেল জুলুমই ওদের অলঙ্কার আজ না হোক তাদের প্রজন্ম ভবিষ্যতে গর্ব করার সুযোগ পাবে তাদের পূর্বসূরিদের।

এই মুহূর্তে কেউ তিক্ততা বাড়াতে চাইবে না। সে জন্য ময়মনসিংহের সিটি করপোরেশনের বিষয় আশয় নিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনের প্রাক্কালে ভিন্ন কোনো কথা তুলতে চাইলে ঠিক হবে না। যারা সেখানে প্রার্থী হবেন, তারাই হয়তো বহু কথা বলবেন। বাইরের থেকে এখন তিক্ততা সৃষ্টি করা রুচিকর নয়। কেউ জানে না ওই সিটি করপোরেশনের ভবিষ্যৎ কর্ণধার কে হবেন। তাদের কাছের তো বটেই সেই সাথে দেশের অন্যত্র যেখানেই ক্ষমতার কেন্দ্র। সেখানে যারাই অধিষ্ঠিত আছেন বা আগামীতে হন না কেন। তাদের নিশ্চয় উপলব্ধি করতে হবে। অতীতে এবং এখনো ক্ষমতাটার স্বাদটা একান্ত নিজস্ব বলয়ের মধ্যে ঘুরপাক খায়। এখনো তথৈবচ। আর বৃত্তের বিন্দুতে যারা থাকেন তারাই কেবল আনন্দলোকের অধিবাসী।

অথচ কারো ভাবনাতেই আসে না। আসলে ক্ষমতার প্রকৃত উৎস কোথায়, আর কারাইবা ক্ষমতার প্রকৃত মালিক। তাদের অবজ্ঞা অবহেলা হচ্ছে। কখনো সময় এলে তারা যদি সব হিসাব চেয়ে বসে। তবে সে হিসাব কিভাবে দেয়া হবে। তখন কেউ না থাকুক, ইতিহাস থাকে। ইতিহাস বড় নির্মম। তার তুলাদণ্ড কখনোই এপাশ-ওপাশ হয় না।
ndigantababar@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/818261