২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, শনিবার, ১২:০৮

অ্যানেসথেসিওলজিস্ট সঙ্কটে স্বাস্থ্যখাত

সুন্নতে খতনায় দুই শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যুর পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টনক নড়লো

চিকিৎসায় অ্যানেসথেসিওলজিস্টদের ভুমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও পাত্তা পান না

‘সুন্নতে খতনা’ করতে গিয়ে চলতি মাসে দু’টি শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। হেটে হেটে হাসপাতালে গেছেন বাবা-মায়ের সঙ্গে; বাড়ি ফিরেছেন লাশ হয়ে। আরেকটি শিশু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। খাতনা করার আগে অ্যানেসথেসিওলজিস্টরা অ্যানেসথেসিয়া দেয়ার পর ওই শিশুদের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে শুরু হয় তোলপাড়। এতে করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ দায়িত্বশীলদের টনক নড়ে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্যান্য চিকিৎসকদের তুলনায় কম বেতন, সার্জনদের চেয়ে কম পরিচিতি ও যথেষ্ট সরকারি চাকরির সুযোগ না থাকায় ডাক্তাররা সাধারণত অ্যানেসথেসিওলজিস্ট হতে চান না। অথচ শল্যচিকিৎসা ও জরুরি চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে অ্যানেসথেসিওলজিস্টের (অবেদনবিদ) ভ‚মিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশে প্রয়োজন অনুযায়ী অ্যানেসথেসিওলজিস্ট না থাকায় সার্বিকভাবে ভুগছে স্বাস্থ্যসেবা খাত।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট, ক্রিটিক্যাল কেয়ার ও পেইন ফিজিসিয়ানস (বিএসএসিসিপিপি) জানিয়েছে, দেশে মাত্র ২৪০০ জন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট আছেন। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব সোসাইটিজ অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টস নামে একটি বৈশ্বিক সংস্থার মতে, প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য অন্তত ৫ জন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এক লাখ মানুষের জন্য একজনেরও কম অ্যানেসথেসিওলজিস্ট রয়েছে।

জানতে চাইলে বিএসএসিসিপিপির মহাসচিব অধ্যাপক কাওসার সর্দার গণ মাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশে এই খাতকে সব সময়ই অবহেলা করা হয়েছে। সার্জন ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তুলনায় অ্যানেসথেসিওলজিস্টরা খুবই কম উপার্জন করেন। কিন্তু তারা যে কাজটি করেন, তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। উন্নত দেশগুলোতে অ্যানেসথেসিওলজিস্টরা অনেক বেশি বেতন পান।

স্বাস্থ বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনেক দেশে চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী পেশাদার অ্যানেসথেসিওলজিস্ট গড়ে তোলার প্রথা রয়েছে। বাংলাদেশে সেটা নেই। সরকার চাইলে একটি কোটা তৈরি করতে পারে, যার মাধ্যমে চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে আনুপাতিক হারে শিক্ষার্থীদের অ্যানেসথেসিওলজিস্ট হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার বিষয়টি নিশ্চিত হবে।

গত বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানিয়েছে,লাইসেন্সপ্রাপ্ত, নিবন্ধিত হাসপাতাল ও ক্লিনিক ছাড়া চেম্বার বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কোনো অবস্থাতেই অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া যাবে না। আদেশে বলা হয়, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনার ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত আবশ্যিকভাবে পালনের নির্দেশ দেওয়া হলো। একই সঙ্গে বিএমডিসি স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ অবেদনবিদ (অ্যানেসথেসিস্ট) ছাড়া কোনো ধরনের অপারেশন বা সার্জারি বা ইন্টারভেনশনাল প্রসিডিউর করা যাবে না।
যেসব প্রতিষ্ঠানের নাম ডায়াগনস্টিক ও হাসপাতাল হিসেবে আছে, কিন্তু শুধুমাত্র ডায়াগনস্টিক অথবা হাসপাতালের লাইসেন্স রয়েছে তারা লাইসেন্স ছাড়া কোনোভাবেই নামে লেখা সেবা দিতে পারবে না। হাসপাতাল বা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়োজিত সব চিকিৎসকের পেশাগত ডিগ্রির সনদ, বিএমডিসির হালনাগাদ নিবন্ধন ও নিয়োগপত্রের কপি অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে।
হাসপাতাল বা ক্লিনিকের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের অপারেশন বা সার্জারি বা প্রসিডিউরের জন্য অবশ্যই রেজিস্টার্ড চিকিৎসককে সার্জনের সহকারী হিসেবে রাখতে হবে। কোন অবস্থাতেই লাইসেন্সপ্রাপ্ত বা নিবন্ধিত হাসপাতাল ও ক্লিনিক ছাড়া চেম্বারে অথবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া যাবে না।

সব বেসরকারি নিবন্ধিত বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত হাসপাতাল বা ক্লিনিকে লেবার রুম প্রটোকল অবশ্যই মেনে চলতে হবে। নিবন্ধিত বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত হাসপাতাল বা ক্লিনিকে অপারেশন থিয়েটারে অবশ্যই অপারেশন থিয়েটার অ্যাটিকুয়েট (শিষ্টাচার) মেনে চলতে হবে।
অ্যানেসথেসিয়া কী : যখন কোনো রোগীকে সার্জারির প্রয়োজনে ব্যথামুক্ত করা হয়, সেটিই ক্লিনিক্যাল অ্যানেসথেসিয়া। অর্থাৎ সার্জারির প্রয়োজনে রোগীকে ব্যথামুক্ত করে সার্জারি করার নামই হলো অ্যানেসথেসিয়া। অনেকভাবে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া যায়। আবার জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়ায় প্রধানত ৩টি পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। রোগীকে অজ্ঞান করা হয়, ব্যথামুক্ত করা হয়, ব্যথামুক্ত করে লাংস সাপোর্ট অর্থাৎ রেসপেরটরি সাপোর্ট দিতে হয়। বড় ধরনের অপারেশনে জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া লাগে রিজিওনাল অ্যানেসথেসিয়ায় শরীরের যে অংশটা অবশ করতে চাওয়া হয়, সেখানে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে স্পাইনাল দেওয়া যায়, এপিডুরাল দেওয়া যায়। যেমন: অন্তঃসত্ত¡া নারীদের সিজারের সময় দেহের অর্ধেক অবশ করে সিজার করা হয়। এ ছাড়াও রয়েছে লোকাল অ্যানেসথেসিয়া, মনিটরিং অ্যানেসথেসিয়া ইত্যাদি।

ঢাকার হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডাক্তারদের যে গুরুত্ব দেয়া হয় অ্যানেসথেসিওলজিস্টদের তার সিকি ভাগও দেয়া হয় না। ঢাকার বেশিরভাগ হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারগুলোতে সুষ্ঠু উপকরণ ও ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে কোনো মানদÐই মেনে চলা হয় না। আর বেশিরভাগ সার্জারির ক্ষেত্রে একেবারে শেষ মুহ‚র্তে অ্যানেসথেসিওলজিস্টকে ডাকা হয়। ততক্ষণে রোগীকে অপারেশন টেবিলে নিয়ে আসা হয়েছে। এ কারণেই অ্যানেসথেসিয়ার ভুল প্রয়োগে মৃত্যুর ঘটনা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়।

বিএসএসিসিপিপির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সহকারী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পর্যায়ে অ্যানেসথেসিওলজিস্টদের জন্য ২১৩টি সরকারি পদ রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১০৭টি পদ বর্তমানে খালি আছে।

অ্যানেসথেসিওলজিস্টরা দাবি করেন, তারা বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে বড় আকারে বেতন বৈষম্যের শিকার হন। বেশিরভাগ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলোতে অ্যানেসথেসিওলজিস্টদের অর্থ উপার্জনের জন্য সার্জনদের ওপর নির্ভর করতে হয়।
জানতে চাইলে বারডেমের অনারারি কনসালট্যান্ট অধ্যাপক খলিলুর রহমান বলেন, কেউ অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকতে চায় না। আমাদের সমাজে সার্জনদের যেভাবে সম্মান করা হয়, একজন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট সেই সম্মানটা পান না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলে তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাবে না। তারা ভাবতে পারেন, তাদেরকে নিজ ক্যারিয়ার বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। মেডিকেল শিক্ষার্থীরা কোন বিষয় নিয়ে পড়বেন, তা নির্ধারণ করার সময় সামাজিক পরিচিতি, আর্থিক সুবিধা ও সামাজিক সুরক্ষার বিষয়গুলো মাথায় রাখে। তবে অ্যানেসথেসিওলজিস্টরা যাতে উপযুক্ত সম্মানী পান।

https://dailyinqilab.com/national/news/640855