১৫ মে ২০১৭, সোমবার, ৩:৪৫

সমাজের এ কোন ভয়াল রূপ?

ধর্ষণ যৌন নির্যাতনের ছড়াছড়িতে উদ্বিগ্ন অভিভাবক মহল

নিত্য নতুন ভয়াবহতা নিয়ে চলছে ধর্ষণ। পত্রিকার পাতা খুললেই বিকৃত যৌন নির্যাতনের খবরে আঁতকে উঠছেন পাঠক। অহরহ ধর্ষণের শিকার হচ্ছে শিশু, স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী থেকে শুরু করে কর্মজীবী নারী গৃহিণীসহ বিভিন্ন স্তরের মহিলা। ফেনীতে মা-মেয়েকে এক সাথে ১৪ জন ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। সিলেটে মাকে ধর্ষণ করে তা ভিডিও করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে বারবার ধর্ষণ করেছে এক যুবক। পরে একই ভয় দেখিয়ে তার কিশোরী মেয়েকেও বারবার ধর্ষণ করে সে। আটকের পর তার কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে মা ও মেয়েকে ধর্ষণের ২৫টি ভিডিও। শরীয়তপুরে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে পাঁচ ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সাভারে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রধান শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছে পঞ্চম শ্রেণীর সাত ছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে।
নানাভাবে ফাঁদে ফেলে তরুণীদের আটকে রেখে ঘটছে গণধর্ষণের ঘটনা। ছোট ছোট শিশুকে নানা লোভ দেখিয়ে যৌন নির্যাতন করছে তারই কোনো না কোনো স্বজন। রেহাই পাচ্ছে না তিন সাড়ে তিন বছরের শিশুও। কোনো কোনো দিন একাধিক ধর্ষণের খবর আসছে পত্রিকায়। দীর্ঘ দিন ধরে ধর্ষণের ক্ষেত্রে যেটি ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে, তা হলো ব্ল্যাকমেইলিং। ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে আদায় করা হচ্ছে অর্থ। ভুক্তভোগীকে বারবার বাধ্য করা হচ্ছে তাদের ডাকে সাড়া দিতে। এ ছাড়া সম্পর্কের সূত্র ধরে, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে অথবা অন্য কোনোভাবে বশ করে দৈহিক সম্পর্ক স্থাপন করে তা-ও কৌশলে ভিডিও করে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছে তরুণীদের। এভাবে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় ভীতি ও আতঙ্ক বিরাজ করছে সারা দেশে অভিভাবকদের মধ্যে। কয়েক দিন ধরে দেশজুড়ে আলোচিত হচ্ছে ধর্ষণের কয়েকটি ঘটনা। একের পর এক চাঞ্চল্যকর যৌন সন্ত্রাসের ঘটনা সামনে আসছে আর পেছনে চলে যাচ্ছে একের পর এক বিভৎস ঘটনা। ধর্ষণের শিকার আট বছরের মেয়ের বিচার না পেয়ে মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে জীবন দিলেন পিতা হযরত আলী। দেশজুড়ে আলোচিত এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই বনানীতে হোটেলে আটকে রেখে দুই শিক্ষার্থী ধর্ষণ এবং তা ভিডিও করার ঘটনায় তোলপাড় চলছে দেশজুড়ে।
এ দিকে রাজধানী দিল্লিসহ গোটা ভারতজুড়ে কয়েক বছর ধরে ধর্ষণের বিরুদ্ধে অগণিত মানুষ মিছিল সমাবেশ করেছে। কখনো কখনো তা সহিংস রূপ নিয়েছে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিবাদের মধ্যেই ধর্ষণের পর হত্যা করে লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে সে দেশের ধর্ষকেরা। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন দেশে ধর্ষণের বিরুদ্ধে মানুষ রাজপথে নামলেও ঢাকায় তেমনটি ঘটেনি। তবে এবার বনানীতে দুই তরুণী ধর্ষণের পর শাহবাগে ধর্ষণের বিরুদ্ধে মিছিলের ঘটনা হয়েছে। তাতে অনেকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে নানা ধরনের স্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে হাজির হয়েছেন গত ৫ মে। একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘স্টপ নরমালাইজিং রেপ’। অর্থাৎ ধর্ষণ স্বাভাবিকীকরণ বন্ধ কর।
প্রায় প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় ধর্ষণের খবর এবং এই প্ল্যাকার্ড প্রমাণ করছে ধর্ষণ ধীরে ধীরে যেন স্বাভাবিক ঘটনা হতে চলেছে বাংলাদেশেও। আর এ নিয়েই বিরাজ করছে ভীষণ রকমের ভীতি আর আতঙ্ক কন্যা সন্তানের পিতা-মাতার মনে। কখন কিভাবে কোন ঘটনার জালে জড়িয়ে তাদের নিষ্পাপ মেয়েটির চরিত্রে কালিমা লেপন করে দেয়া হয় সে আতঙ্কে দিন কাটছে অনেক মা-বাবার।
বিভিন্ন সংস্থার তথ্য মতে চলতি বছরের মার্চ মাসেই ধর্ষণের সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়ে গেছে। ক্রমে বাড়ছে ধর্ষণের সংখ্যা। প্রতি মাস, প্রতি বছরের পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে আছে আগের রেকর্ড। এপ্রিল ও মে মাসের ১৩ তারিখ পর্যন্ত পত্রপত্রিকায় ধর্ষণের যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে মনে হয় যেন ধর্ষণের হিড়িক পড়ে গেছে দেশজুড়ে।
আইন ও সালিস কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী ২০১৬ সালে ৭২৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। এর মধ্যে ধর্ষণের পর ৩৭ জনকে হত্যা করা হয় এবং ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেন আটজন।
অপর একটি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী গত বছর বাংলাদেশে এক হাজার ৫০ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হন। এর মধ্যে তিন শতাধিক শিশু। একই সময় হত্যার শিকার হয় ৪১৫টি শিশু।
২০১৫ সালে ৫২১ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে যাদের মধ্যে ৯৯ শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়, ৩০ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় এবং চারজন শিশু ধর্ষণের অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে।
২০১৪ সালে ৬৬৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ৪০১ জন।
গত ৭ এপ্রিলের একটি খবর হলো সাভারের আশুলিয়ায় কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সাত শিশু শিার্থীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে শিক আমির হোসেনকে আটক করেছে পুলিশ। শিক আমির হোসেন ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। ধর্ষিতাদের মধ্যে এক শিশুকে ডাক্তারি পরীার জন্য ঢাকা মেডিক্যালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে পাঠানো হয়েছে।
পুলিশের হাতে আটক আমির হোসেন নরসিংদী জেলার বেলাব থানার বাটেরচর এলাকার জিন্নাতুল মিয়ার ছেলে। তিনি আশুলিয়ার কুরগাঁও এলাকায় আমির মডেল স্কুল নামে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও আবাসিক ডে-কেয়ারের প্রতিষ্ঠাতা। এখানে তার স্ত্রীও শিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। পড়াশোনার আড়ালে আমির হোসেন শিশু শিার্থীদের যৌন নির্যাতন করতেন।
এ দিকে স্কুল চালানোর আড়ালে কোমলমতি শিার্থীদের যৌন নির্যাতনকারী আমির হোসেনকে আটকের পর তার বিরুদ্ধে অন্যান্য শিার্থী ও অভিভাবকেরাও থানায় হাজির হয়ে একই ধরনের অভিযোগ করেন। অভিভাবকেরা জানান, আমির হোসেনের আসন্ন প্রসবা স্ত্রী চার মাস আগে গ্রামের বাড়িতে চলে যান। এরপর থেকেই বিভিন্ন সময়ে একে একে ধর্ষণ করে সাত শিার্থীকে। অন্য দিকে শিকের কাছে পড়তে গিয়ে শিার্থীরা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে জানতে পেরে এলাকার অভিভাবক ও সচেতন শিার্থীদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই আটককৃত আমিরের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করেছেন।
সিলেটে মা মেয়েকে ধর্ষণের দায়ে গত বুধবার রাতে গ্রেফতার করা হয়েছে নিমার নামে এক রাজমিস্ত্রিকে।
গত বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহে ছয় বছরের এক শিশুকে ১৪ বছরের কিশোর ধর্ষণ করে।
১৩ মে একটি খবরের শিরোনাম ছিল রাজধানীতে দুই দিনে আলাদা ঘটনায় তিন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ভর্তি করা হয়। এসব ঘটনায় এক শিশুর সৎ বাবাসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
১৯ এপ্রিল প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয় শরীয়তপুর জেলার সদর উপজেলার ৬৩ নম্বর বিনোদপুর ঢালীকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক এস এম কাওসার মিলনের বিরুদ্ধে পাঁচ ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। হয়রানির শিকার বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর চার এবং তৃতীয় শ্রেণীর এক ছাত্রী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করে। এ ঘটনায় ুব্ধ এলাকাবাসী প্রধান শিকের অপসারণ ও উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে বিদ্যালয় মাঠে বিােভ মিছিল করে।
গত ৬ মার্চের একটি খবরে বলা হয়, নড়াইলের লোহাগড়ায় অষ্টম শ্রেণীর এক স্কুলছাত্রীকে (১৪) ১০ দিন আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত আল আমিন শেখকে (২৪) গ্রেফতার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
সারা দেশে শিক্ষক কর্তৃক একের পর এক ছাত্রীদের যৌন হয়রানির ঘটনায় উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে অভিভাবকদের মধ্যে। প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত একের পর এক বরখাস্ত হচ্ছেন শিক্ষকেরা ছাত্রীদের যৌন নির্যাতনের দায়ে। ঘটছে গ্রেফতারের ঘটনা। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের বিরুদ্ধে রাজপথে নামছেন শাস্তির দাবিতে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেখা মিলছে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের পরিমল জয়ধর, কুষ্টিয়ার পান্না মাস্টার, আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেরদৌসদের।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/220048