১৫ মে ২০১৭, সোমবার, ৩:৪৩

এক বছরে আদালতের ১৬৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ

ছোট কর্মচারীদের বড় দুর্নীতি

জাল-জালিয়াতি, ফাইল গায়েব, টাকার বিনিময়ে রায় পক্ষে পাইয়ে দেয়াসহ নানা অভিযোগ * দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি - রেজিস্ট্রার জেনারেল

সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের এমএলএসএস মো. ফারুক উদ্দিন সুমন। ১২ এপ্রিল তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। সে দুটি রিট মামলার আদেশ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত বলে স্বীকার করেছে। এখন তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত চলছে।


শুধু সুমন নয়, দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন গত বছর অর্ধডজনেরও বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। আরও তিনজন স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত হয়েছে। এছাড়া চলতি বছরের প্রথম চার মাসেই অন্তত আটজনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের হয়েছে। অন্যদিকে গত এক বছরে অধস্তন আদালতের ১৬৮ কর্মচারীর বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের কাছে অভিযোগ এসেছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কোনো কোনো অভিযোগের তদন্ত চলছে। অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় কাউকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্তও করা হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সুনির্দিষ্ট না হওয়ায় সেগুলো আমলে নেয়া হয়নি।

উচ্চ ও নিন্ম আদালতের অনেক কর্মচারীই বড় বড় দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জাল-জালিয়াতি, ফাইল গায়েব করা, টাকার বিনিময়ে রায় পক্ষে পাইয়ে দেয়া, মামলা করে দেয়ার নামে টাকা নিয়ে টালবাহানাসহ নানা ধরনের অভিযোগ উঠছে এসব কর্মচারীর বিরুদ্ধে।

এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। যখন যে অভিযোগ পাচ্ছি আমরা তাৎক্ষণিকভাবে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি। অনেক ক্ষেত্রে ফৌজদারি ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেকে চাকরিচ্যুতও হয়েছেন।’

জানা গেছে, ১৩ এপ্রিল সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন থেকে এমএলএসএস সুমনকে বরখাস্তের আদেশ জারি করা হয়েছে। সুমনের নামে জারিকৃত বরখাস্তের আদেশে বলা হয়েছে, ‘আপনি অত্র কোর্টের এমএলএসএস মো. ফারুক উদ্দিন সুমন। বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে দায়েরকৃত রিট পিটিশন মামলা নং-৯৭৬/২০১৭-এর ২৩ জানুয়ারির আদেশ এবং রিট পিটিশন মামলা নং-৯৭৫৩/২০১৪-এর ২১ মার্চের আদেশ জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত। আপনার উপরোক্ত কার্যকলাপ হাইকোর্ট বিভাগের কর্মচারী বিধিমালা ১৯৮৩-এর ২(২) ধারা মোতাবেক অসদাচরণের শামিল এবং বিধিমালার ৩(বি) বিধি মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিধায় অভিযোগের গুরুত্ব বিবেচনায় ১২ এপ্রিল থেকে উক্ত বিধিমালার ১০(১)বিধি অনুযায়ী আপনাকে অত্র কোর্টের চাকরি হতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হল।’

সূত্র জানিয়েছে, জালিয়াতির মাধ্যমে আদালতের আদেশ পরিবর্তন করে বাদীপক্ষে রায় পাইয়ে দেয়া হয়। আর এ কাজে মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের বিচারপতিদের নজরে এলে ওই বেঞ্চের এক কর্মকর্তাকে দিয়ে সুমনের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের কাছে জালিয়াতির অভিযোগ দাখিল করা হয়। পরে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন।

এর আগে গত বছরের আগস্টে হাইকোর্টের বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি জাফর আহমেদের স্বাক্ষর জাল করে সাড়ে ২৯ কেজি স্বর্ণের মামলায় স্থগিতাদেশ নেয়া এবং প্রায় ১৮ হাজার পিস ইয়াবার মামলার আসামির জামিন নেয়ার ঘটনা ঘটে। নিখুঁতভাবে এ জালিয়াতির কাজটি সম্পন্ন হয়। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট সেকশন থেকে জাল আদেশের কপি দুটি নিন্ম আদালতেও পৌঁছায়। এ অবস্থায় বিষয় দুটি সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের নজরে আসে। এরপরই আদেশ দুটি প্রত্যাহার করে নেন ওই বেঞ্চ। জাল আদেশ প্রত্যাহারের নির্দেশে বিচারপতিরা বলেন, ‘বিশাল একটি চক্র বড় ধরনের জালিয়াতির ঘটনা ঘটিয়েছে। যা তদন্তের প্রয়োজন। পাশাপাশি জড়িতদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।’ আদালত সুপ্রিমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে এ ব্যাপারে ফৌজদারি মামলা দায়েরের নির্দেশ দেন। এরপর সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন এ ঘটনায় বিভাগীয় তদন্ত করেন। সম্প্রতি আপিল বিভাগের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার অরুনাভ চক্রবর্তী তদন্ত করে এ জালিয়াতির জন্য ১২ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়ী করেছেন। এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের নিন্মস্তরের দু’জনসহ মোট চার কর্মচারী এ জালিয়াতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত বলে প্রতিবেদন দিয়েছেন। বাকিদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ আনা হয়েছে। এছাড়া এ ঘটনায় দায়ের করা ফৌজদারি মামলার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি বলে জানা গেছে।

নিন্ম আদালতের কর্মচারীরাও একইভাবে দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। শুধু এক বছরে সুপ্রিমকোর্টের কাছে অধস্তন আদালতের প্রায় দেড় শতাধিক কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। এগুলো জমা পড়ে অভিযোগ বক্সে। এসব অভিযোগের প্রায় অর্ধেকই আমলে নেয়া সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, অভিযোগকারীর নাম-ঠিকানা, মোবাইল নম্বর এগুলো সুনির্দিষ্ট না থাকায় প্রায় অর্ধেক অভিযোগই আমলে নেয়া সম্ভব হয়নি। বাকিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

জানা গেছে, সুপ্রিমকোর্টের অভিযোগ বক্সে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে, তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন চট্টগ্রাম প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সাবেক বেঞ্চ সহকারী দীপংকর দাস (বর্তমানে সাময়িক বরখাস্ত)। তার বিরুদ্ধে মিজানুর রহমান চৌধুরী নামের এক ব্যক্তি ঘুষ-দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ দাখিল করেন। এই অভিযোগের প্রাথমিক তদন্তে দেখা যায়, দীপংকরের সোনালি ব্যাংকের চট্টগ্রাম কোর্টহিল শাখার ১০০০১২৬৭৯ নম্বর হিসাবে সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে। ওই হিসাবে নগদ টাকা জমার বিবরণীতে দেখা যায়, ২০১৩ সালের ১০ মার্চ ৬০ হাজার, ২০১৪ সালের ২৮ আগস্ট ১ লাখ ২০ হাজার, ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ৬০ হাজার, একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি ৬০ হাজার, একই বছরের ২৭ এপ্রিল ৪৮ হাজার, ২৬ জুন ৬০ হাজার, ৫ আগস্ট ৩০ হাজার, ২০১৬ সালের ১৪ মার্চ দেড় লাখ এবং ১৬ এপ্রিল ২ লাখ টাকা জমা হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তার বেতন-ভাতার চেয়েও বহুগুণ বেশি টাকা অসাধু লেনদেনে জড়িত, যা ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করে। এছাড়া ওই প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের একটি মামলার রায়ের নথি নিজ হেফাজতে রেখে রায় বিলম্বিত করেছেন। পাশাপাশি বিচারাধীন মামলায় ট্রাইব্যুনালের বিচারকের কাছে তদ্বির করেন। এ দুটি কারণে, অসৎ উদ্দেশ্য ও দুর্নীতির অভিযোগে দীপংকর দাসকে ২০১২ সালে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়। কিন্তু ওই নোটিশের কোনো জবাব তিনি দেননি। পাশাপাশি দীপংকর দাস ওই প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের স্টেনোগ্রাফার মোহাম্মদ সেলিমকে গত বছরের ৬ মার্চ ট্রাইব্যুনালের এজলাস কক্ষে প্রকাশ্যে ধারালো বস্তু দিয়ে দু’চোখের মাঝখানে আঘাতের মাধ্যমে রক্তাক্ত জখম করে। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশ। এসব অভিযোগের কারণে তাকে কেন স্থায়ীভাবে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হবে না তার কারণ জানতে চেয়ে নোটিশ দেয়া হয়েছে। এখনও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শেষ হয়নি।

আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এসব দুর্নীতি অনিয়ম রোধে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন থেকে একাধিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের অভিযোগ জানানোর জন্য সুপ্রিমকোর্টে রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ে স্থাপন করা হয়েছে ‘অভিযোগ বক্স’। এছাড়া অনলাইনে সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে ঢুকেও অভিযোগ দাখিলের সুযোগ রয়েছে। পাশাপাশি দুর্নীতি-অনিয়মের তথ্য জানাতে চালু করেছে হটলাইন সেবা। সেকশনগুলোতে বসানো হয়েছে সিসি (ক্লোজ সার্কিট) ক্যামেরা। কিন্তু তারপরও নিন্মশ্রেণীর কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ বিশেষ করে জাল-জালিয়াতি, ফাইল গায়েব করার মতো গুরুতর অভিযোগ উঠছে।

সম্প্রতি উচ্চ আদালতে একাধিক বড় বড় জালিয়াতি এবং দুর্নীতি-অনিয়মের ঘটনা ধরা পড়েছে। বিকাশের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীর কাছ থেকে টাকা নেয়া, বিচারপতির ক্রেডিট কার্ড চুরি করে টাকা উত্তোলনসহ নানা ধরনের অভিযোগ জমা পড়েছে সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসনের কাছে।

সাম্প্রতিককালের একাধিক ঘটনায় প্রচণ্ড হতাশ রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘অধস্তন কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের বিচারকের। কিন্তু বিচারকরা যদি তার অধস্তন কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন এটা তাদের ব্যর্থতা।’

অদক্ষতার কারণে এসব জাল-জালিয়াতি হচ্ছে উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, একজন বিচারক একটা মামলা শুনে সঙ্গে সঙ্গে যদি রায় দেন তাহলে এই জালিয়াতির সুযোগ থাকে না। একটি মামলায় কী আদেশ হয় সে ব্যাপারে কার্যতালিকায়, স্যুট রেজিস্ট্রার ও কম্পিউটারে তথ্য থাকে। সেগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে যদি আদেশ দিয়ে সেকশনে নথি পাঠানো হয়, তাহলে তো দুষ্কৃতকারীরা জালিয়াতি করার সুযোগ পায় না। কিন্তু তা না করে যদি একসঙ্গে ২৫টি মামলা ‘পার্ট-হার্ট’ রাখেন, তারপর পূর্ণাঙ্গ রায় না দিয়ে শুধু সংক্ষিপ্ত রায়টা উচ্চারণ করেন, সেক্ষেত্রে অধস্তন কর্মচারীরা তো সুযোগ নেবেই। পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করবে, বলবে টাকা দেন জিতিয়ে দেব। আগে এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। এখন অহরহ ঘটছে। আসলে কোর্ট ব্যবস্থাপনা জানা দরকার।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/05/15/124587/