২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, মঙ্গলবার, ১১:০১

রমযান সামনে রেখে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা চলছেই

রমযানকে সামনে রেখে বাজার যেনো লাগামহীন পাগলা ঘোড়া। কতিপয় অসাধু আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী নানা কায়দায় ভোগ্যপণ্য থেকে বাড়তি মুনাফা তুলে নিতে সক্রিয়। ফলে কোন কারণ ছাড়াই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিত্য পণ্যের দাম। রমযানকে সামনে রেখে সরকার চার পণ্যের শুল্ক কমালেও তার কোন প্রভাব নেই বাজারে। শুল্ক সুবিধার পুরোটাই চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের পকেটে। বেড়েছে রমযানে ইফতারের প্রধান উপকরণ খেজুরের। এনিয়ে ভেক্তার মধ্যে চাপা ক্ষোভ বাড়ছে।

জানা গেছে, এমনিতেই নিত্য পণ্যের বাজার লাগামহীন। তার সাথে যুক্ত হচ্ছে রমযান। অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বাজার ধাউধাউ করে জ¦লে উঠছে। রমযানে বেশ কয়েকটি পণ্যের বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি হয়। আর এ সুযোগ নেয় দেশের অসাধু ব্যবসায়ী চক্র। যা গোটা বাজারকে অস্বির করে তুলছে।

জানা গেছে, গত ৮ ফেব্রুয়ারি চালের আমদানি শুল্ক-কর ৬৩ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। আর সম্পূরক শুল্ক কমানো হয় ২০ শতাংশ। এ ছাড়া পরিশোধিত-অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের ভ্যাট ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। চিনি আমদানিতে টনপ্রতি আমদানি শুল্ক দেড় হাজার টাকা থেকে কমিয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে। খেজুরের ক্ষেত্রে শুল্ক ৫৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এনবিআরের এমন সিদ্ধান্তে আশা করা হচ্ছিল, ভোক্তারা এসব পণ্য কম দামে পাবেন। কিন্তু বরাবরের মতোই বাজারে এই শুল্ক ছাড়ের প্রভাব পড়েনি।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, শুল্ক সুবিধাটা দেওয়া হয় ভোক্তাদের সুবিধার্থে। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, এটা কেবল ব্যবসায়ীরা ভোগ করেন। বাজারে ভোক্তা পর্যায়ে তা পৌঁছায় না। এর পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে, কিছু সংখ্যক বড় খেলোয়াড়ের হাতে আমদানির বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ। এখানে নতুনদের প্রবেশের সুযোগ নেই, প্রতিযোগিতা নেই। এমন বাজারে যতই শুল্ক ছাড় দেওয়া হোক, ভোক্তা পর্যন্ত সেটি পৌঁছবে কিনা, তা অনিশ্চিত। উল্টো এতে ব্যবসায়ীদের মুনাফা বাড়ে আর সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্বও হারায়। এনবিআর সদস্য মাসুদ সাদিক জানান, শুল্ক কর কমানোর কারণে এনবিআরের ৭শ কোটি টাকা রাজস্ব আয় কমবে।

এ বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, শুধু শুল্ক-করে ছাড় দিলে তো হবে না, ভোক্তারা তাতে উপকৃত হচ্ছে কিনা, সেটিও মনিটর করতে হবে। তিনি বলেন, শুল্ক সুবিধা দেওয়ার পর কারা কারা পণ্য আমদানি করছে, কত দামে করছে, দেশের বাজারে কত দামে ছাড়ছে- এসব তথ্য জোগাড় করা কঠিন কাজ না। আমাদের প্রতিযোগিতা কমিশন রয়েছে। কিন্তু কাজে ফল পাচ্ছি না। আমাদের উচিত এই মনিটরটাও করা। তাহলে শুল্ক ছাড়ের সুবিধা ভোক্তারাও ভোগ করতে পারবেন।

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, রোজায় ভোক্তা পর্যায়ে পণ্য সরবরাহ ও দাম নিয়ে যাতে কোনো বিভ্রান্তি না থাকে, সেটা দূর করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। মাসখানেক ধরে আমরা চেষ্টা করছি। রমজান শুরুর এক সপ্তাহ আগেই এর বাস্তবায়ন হবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, যে তারিখে কারখানা থেকে তেল বের হবে, সেই তেলের বোতলে নতুন মূল্য মার্ক করা থাকবে। প্রথমে অপরিশোধিত তেল আমদানি হয়, পরে সেটা পুনর্র্নিধারিত ট্যারিফ অনুসারে খালাস হওয়ার পর কারখানায় গেলে সেই উৎপাদিত তেলেরই দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। মাঠ পর্যায়ের মনিটরিং থাকবে।

এদিকে বাজার চিত্র বলছে, নতুন করে না বাড়লেও আগের উচ্চমূল্যেই স্থির রয়েছে চাল, তেল, চিনি ও খেজুরের বাজার। খুচরা পর্যায়ে সরু চালের কেজি এখনো ৬২ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। আর মাঝারি মানের চালের কেজি ৫৬ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। চালের বাজারে এখনো অভিযান চলছে। অবৈধ মজুদদার ও কারসাজিকারীদের বারবার হুশিয়ার করছে সরকার। অনুরোধের পরও চালের দাম আশানুরূপ কমায়নি মিল মালিকরা।

এদিকে খুচরায় খোলা চিনির কেজি এখনো ১৪০ টাকার নিচে মিলছে না। এর বেশি দামেও বিক্রি হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে গেছে। খুচরায় বোতলজাত সয়াবিনের লিটার এখনো ১৭০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। খোলা সয়াবিনের বাজার স্থিতিশীল থাকলেও পাম তেলের দাম চড়া। গত মাসের তুলনায় খোলা পাম তেলের দাম এখনো ২ শতাংশ বেশি রয়েছে। অপরদিকে খেজুরের বাজারে দাম শুধু বাড়ছেই। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের তুলনায় এবার দাম ৪০ শতাংশ বেশি রয়েছে।

এ বিষয়ে রাজধানীর কাওরান বাজারের এক খেজুর বিক্রেতা বলেন, ভালো খেজুরের দাম কেজিতে ২০০ টাকা বেড়েছে, ছোট খেজুরের দাম কেজিতে ৮০ থেকে ১০০ টাকা বেড়েছে। গতবছর শুল্ক কম ছিল, এবার বাড়তি শুল্কের কারণে খেজুরের দাম বেড়েছে। গতবার মেডজুল খেজুরের পাঁচ কেজিতে শুল্ক ছিল ২৬০ টাকা, এবার এক কেজিতে তা ২৬০ টাকা পড়ছে। বেড়েছে ছোলাসহ প্রায় সব ধরনের ডালের দাম। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এ জন্য আমদানিকারক ও বড় ব্যবসায়ীদের দায়ী করেন।

দাম বাড়ার বিষয়ে এক ডাল বিক্রেতা বলেন, রমজানকে কেন্দ্র করে সবরকম ডালের বাজার চড়া। দুই সপ্তাহ আগে যে ছোলার ডাল বিক্রি করেছি ৮০ থেকে ৯০ টাকা এখন তা ১০০ থেকে ১০৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। সাদা ছোলাটি ১০০ থেকে ১০৫ টাকা ছিল। এখন তা বিক্রি করতে হচ্ছে ১০৫ থেকে ১১০ টাকা। খেসারি, মসুরসহ সব ডালের দাম পর্যায়ক্রমে বাড়ছে। কারণ, জানতে চাইলে পাইকাররা বলছেন ছোলা আমদানি হচ্ছে না। এতেও সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। রমজান উপলক্ষে তারা ছোলা মজুদ করছে বাজারে ছাড়ছে না।
গরুর মাংসের দাম ফের সাড়ে ৭০০ অতিক্রম করেছে। কোথাও তা ৭৮০ টাকায় ঠেকেছে। নানান অজুহাতে বাড়ছে পোলট্রি মুরগির দামও। রাজধানীর কাওরান বাজারে প্রতি কেজির ২১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পাড়ায় মহল্লায় তা বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায়। এ বিষয়ে এক মুরগি বিক্রেতা বলেন, আমদানি কম, ফিডের দাম বেশি, পরিবহনের ভাড়া বেশিসহ বিভিন্ন কারণে মুরগির দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সুমন দেওয়ান নামে এক ক্রেতা বলেন,গরিব মানুষ এক বছর আগেও ১২০/১৫০ টাকায় বয়লার মুরগি খেতে পারতো। আর পাঙ্গা মাছ খেতে পারতো ১২০/১৩০ টাকায়। এখন বয়লার বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায় আর পাঙ্গাস বিক্রি হচ্ছে ২১০/২২০ টাকায়। যা গবিরের নাগালের বাহিরে। তাহলে গরিব মানুষ খাবে কি?

ভরা মৌসুমে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকায়। আলুর দামও সহনীয় হয়নি। নতুন করে বাড়ছে সবজির দাম। এ বিষয়ে বাজার করতে আসা এক ক্রেতা বলেন, আমরা দিনমজুর। এক কেজি শিমের দাম ৬০ টাকা। আর এক কেজি মাছের দাম ৩৫০ টাকা। তাহলে আর পকেটে কী থাকে। সেই সঙ্গে চাউল আছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি। অন্য এক ক্রেতা বলেন, এটি একটি চক্র যা ভাঙা না গেলে রমজানে কিছু কেনাই যাবে না।

উচ্চমূল্যের বাজারে নির্দিষ্ট আয়ের ক্রেতাদের স্বস্তি দিতে নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করেছে টিসিবি। সংস্থাটির মুখপাত্র মো. হুমায়ন কবির মনে করেন, প্রথম ধাপে এক কোটি পরিবারকে ভর্তুকি মূল্যে তেল, ডাল, ছোলা ও চাল দেওয়া হচ্ছে, যা বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রভাব ফেলবে।
তিনি বলেন, প্রথম পর্যায়ে আমরা তেল, ডাল, ছোলা এবং চাল বিক্রি করব। ছোলা ৫০ টাকা, মসুর ডাল ৬০ টাকা, তেল ১০০ টাকা লিটার এবং চাল যথারীতি ৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি করা হবে। পরে এর সঙ্গে একটি পণ্য বাড়ানো হবে। প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ এখান থেকে উপকৃত হবে। যদি এক কোটি পরিবার বাজার থেকে এসব পণ্য না কিনে টিসিবি থেকে কেনে তবে বাজারের ওপর এর একটি বিশেষ প্রভাব পড়বে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আবারও এক কোটি পরিবারের মাঝে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে নির্ধারিত দামে তেল, চাল, ডাল, ছোলা ও খেজুর বিক্রি করা হবে। তবে দাম সহনীয় করতে অনিয়মের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করতে হবে।
দেশে মূল্যস্ফীতি কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। কোন না কোন অজুহাতে বাড়ছে এসব নিত্য পন্যের দাম। রমজান এলে কিছু পণ্যের বাড়তি চাহিদা সৃুিষ্ট হয়। আর এ সুযোগ নেয় এক শ্রেনির আমদানিকারক এবং অসাধু ব্যবসায়ীরা। এতে করে সাধারণ রোজাদাররা কষ্ট করেই রোজা রাখতে হয়। এনিয়ে সরকার নানা হাকডাক দিলেও কাজের কাজ আসলে কিছুই হয় না।

https://www.dailysangram.info/post/549352