১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, সোমবার, ৪:১৯

জাহাঙ্গীরনগরে মাদক বাণিজ্যে যাদের নাম

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি মাসে ৮ হাজার পিস মাদক সাপ্লাই দিতো ধর্ষণকাণ্ডে অভিযুক্ত মামুন। এই মামুন ক্যাম্পাসে আসে ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম মোল্লার হাত ধরে। এই প্রতিনিধির কাছে কয়েকটি ছবি এসেছে যেখানে অভিযুক্ত মামুনের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, চাপাতি, চাইনিজ কুড়াল। পিছনে শামীম মোল্লার ছবি। বর্তমানে শামীম মোল্লা পলাতক রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকার কয়েকটি স্পটে নিয়মিত ইয়াবা, ফেনসিডিল ও হেরোইনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক কেনাবেচা হয়। মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণকারীদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের নাম এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন রাঙ্গামাটি এলাকায় মাদক ব্যবসা পরিচালনা করতেন ফরিদ হোসেন ওরফে পাঞ্চু। ফরিদের কাছ থেকে দৈনিক দুই হাজার টাকা চাঁদা নিতেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সাব্বির হোসেন নাহিদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান জয়। তবে চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় গত বছরের ১৬ই জুলাই নাহিদ ও জয়ের নেতৃত্বে ফরিদকে তুলে এনে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ আদায় করে ছাত্রলীগের নেতারা। এরপর থেকে শারীরিক অসুস্থতার জন্য ফরিদ মাদক ব্যবসা বন্ধ রেখেছে বলে জানা গেছে।

এখন আপেল মাহমুদ নামে আরেক ব্যক্তি ওই এলাকায় মাদক ব্যবসা পরিচালনা করছেন। তবে সাব্বির হোসেন নাহিদ ও মেহেদী হাসান জয় নিজেরাও মাদক ব্যবসায় জড়িত।

এ ছাড়া ক্যাম্পাস সংলগ্ন রাঙ্গামাটি এলাকায় হেরোইন ব্যবসার মূল হোতা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি তানভীর ইসলাম, সাংগঠনিক সম্পাদক রাশেদ খান শিমুল, এবং আ ফ ম কামাল উদ্দিন হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ প্রত্যাশী মেহেদী হাসান রিফাত। বহিরাগত ৩ যুবকের মাধ্যমে আশুলিয়ার পল্লীবিদ্যুৎ এলাকা থেকে হেরোইন এনে রাঙ্গামাটি এলাকায় ভাগবাটোয়ারা করেন তারা। হল প্রভোস্ট এই অভিযোগে একটি রুম সিলগালা করে রেখেছেন।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের (৪১তম ব্যাচ) সাবেক শিক্ষার্থী আরমান খান যুবর নাম ভাঙিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন অনেকে। যুবর বিরুদ্ধে মাদক সেবন ও মাদক ব্যবসায়ীদের মারধরসহ নানা অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তার মাদক সেবন ও অপরাধের সহযোগী হিসেবে আরও কয়েকজনের নাম এসেছে।

এদিকে গত ৩রা ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক দম্পতিকে ডেকে এনে স্বামীকে মীর মশাররফ হোসেন হলের একটি কক্ষে আটকে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণের ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী মো. মামুনুর রশিদ মামুন মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত ছিল। ২০১৭ সাল থেকে সে ক্যম্পাসে মাসে ৮ হাজার পিস ইয়াবা সাপ্লাই দিতো। তার ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একটি চক্র জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের ৪৩তম ব্যাচের সাবেক শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান অনিক এই ইয়াবা চক্রের সঙ্গে জড়িত। ৪৩তম ব্যাচের শিক্ষা সমাপনী উৎসবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এম্বুলেন্সে মদসহ বংশাল থানায় আটক হয় অনিক। বর্তমানে এই ব্যবসা দেখে শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব হোসাইন, সহ-সভাপতি শাহ পরাণ, ধর্ষণকাণ্ডে মূল অভিযুক্ত মোস্তাফিজ, পালাতে সহযোগী মুরাদ, সাগর সিদ্দিকীসহ আরও কয়েকজন জড়িত। অভিযুক্তদের এই গ্যাংটি ক্যাম্পাস সংলগ্ন ডেইরি গেট, সিএন্ডবি ভাসমান দোকান থেকে মাসোয়ারা চাঁদা আদায় করেন। বর্তমানে শাহ-পরাণ পলাতক। অভিযোগ অস্বীকার করে বিপ্লব হোসাইন বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেটা ভিত্তিহীন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র ও মাদক সিন্ডিকেটের এক সদস্য থেকে জানা যায়, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার থেকে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা দরে এবং চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ থেকে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা দরে ইয়াবা আনতো মামুন। মাসে ৭ থেকে ৮ হাজার পিস ইয়াবা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় তিনশ’ টাকা দরে বিক্রি করতো সে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী নয়ারহাটে টিটু, কলমাতে আতিক ও বিশমাইলে হাসান নামে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি মামুনের ইয়াবা সরবরাহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, মামুনকে চট্টগ্রাম থেকে আরিফ, কক্সবাজার থেকে সাইফুল ইসলাম বাপ্পী ইয়াবা সরবরাহ করতেন। মাদক মামলায় বেশ কয়েকবার কারাগারে গেছেন মামুন। মামুনের বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানা, বগুড়া সদর থানা, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানা ও কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় পৃথক ৪টি মাদক মামলা রয়েছে।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে কেউ প্রমাণ দিতে পারলে যা শাস্তি হবে তা মাথা পেতে নিবো। শরিফ ও আরিফ রোয়ালিয়া এলাকার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। আমি নিজে উদ্যোগ নিয়ে তাদের মাদক ব্যবসা বন্ধের চেষ্টা করেছি।’ জানা যায়, সেনওয়ালিয়া এলাকায় মাদক ব্যবসা পরিচালনা করেন শামীম ও সুমন। তারা আশুলিয়ার জিরানী এলাকা থেকে মাদক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশমাইল এলাকায় কর্মচারী কোয়ার্টার সংলগ্ন মাঠের ভাঙা প্রাচীর দিয়ে ভিতরে ঢোকেন। এ ছাড়া বড় সেনওয়ালিয়া এলাকায় মাদক কারবার চালাচ্ছেন হুমায়ুন কবির ও পারভেজ। অন্যদিকে গোকুলনগর এলাকায় রতন, আবুল ও শরিফ মাদক ব্যবসা পরিচালনা করছেন। এ ছাড়া আমবাগান এলাকায় স্থানীয় আছেরউদ্দিন ও আইয়ুব নামে দু’জনকে ব্যবহার করে মাদক ব্যবসা চালাচ্ছেন মাসুদ ও অনিক।

অন্যদিকে ইসলামনগর এলাকায় মাদক ব্যবসা পরিচালনা করেন পিন্টু ওরফে খোড়া পিন্টু, রফিকুল ইসলাম রফিক, পঙ্গু রনি, ইমন ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিচ্যুত গার্ড পলাশ। এ ছাড়া কাঁঠালবাগান এলাকায় রাজমিস্ত্রি পেশার আঁড়ালে ফরিদ ও মিরা মাদক ব্যবসায় জড়িত। এ ছাড়া ওই এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কর্মকর্তার ছেলে শ্যামল মাদক ব্যবসায় জড়িত। তবে প্রথমে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের ৪১তম ব্যাচের এক সাবেক শিক্ষার্থীর শেল্টারে মাদক ব্যবসা শুরু করে ফরিদ। অন্যদিকে গেরুয়ায় শরিফ নামে এক ব্যক্তি মাদক ব্যবসায় জড়িত।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পানধোয়া এলাকার ব্যবসায় নাম এসেছে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাসুদ রানার। ইন্টারনেট ও ডিশ ব্যবসার আঁঁড়ালে তিনি মাদক ব্যবসায় জড়িত। তার সহযোগী মমিনউল্লাহ মমিনও মাদক ব্যবসা পরিচালনা করেন। এ ছাড়া মাসুদের বিরুদ্ধে সরকারি জায়গায় রেস্টুরেন্ট ব্যবসা পরিচালনা করার অভিযোগ রয়েছে। তার রেস্টুরেন্ট ব্যবসার দায়িত্বে থাকা হৃদয় নামে এক যুবক মাদক ব্যবসায় জড়িত। এ ছাড়া পানধোয়া এলাকায় ফারুক, জাহিদুল ইসলাম বাবু, নুর ইসলাম, নিলয় ও রানা নামে কয়েকজন মাদক ব্যবসায় জড়িত। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইপার দিলীপ কুমার, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের কর্মচারী মফিজুল ইসলাম ওরফে সাদ্দাম, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের কর্মচারী মো. খালেক, প্রশাসনিক ভবনের কর্মচারী মামুনসহ কয়েকজন কর্মচারীর বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তাদের মধ্যে মাদক ব্যবসায়ে জড়িত থাকায় মামুন চাকরিচ্যুত হলেও পরে আবার ফিরে পেয়েছেন। এ ছাড়া খালেককে ৩শ’ পিস ইয়াবাসহ আটক করা হয়।

অভিযোগ অস্বীকার করে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের কর্মচারী মো. খালেক বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা মিথ্যা। আমাকে ফাঁসানোর জন্য এগুলো করা হচ্ছে।’ অভিযোগের বিষয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাসুদ রানা বলেন, ‘এখন মাদক ব্যবসার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তবে কারা এখন ব্যবসা চালাচ্ছে, তাদের বিষয়ে তথ্য দিতে পারবো। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থীও এই ব্যবসায়ে জড়িত।’ এরপর কয়েকজন মাদক ব্যবসায়ীর তথ্য দেন তিনি। মাদক ব্যবসায়ী ফরিদ হোসেন পাঞ্চু বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। এসব বিষয়ে এখন খোঁজখবর নেই। তবে আগে প্রতিদিন ক্যাম্পাসে প্রায় দুই হাজার পিস ইয়াবা কেনাবেচা হতো। ক্রেতাদের মধ্যে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী। আবার অনেকে ক্যাম্পাস থেকে মাদক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে ঢাকায় নিয়ে যায়।’

তবে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে সাব্বির হোসেন নাহিদ, মো. ফারশাদ হোসেন আবির, শাহ মোস্তাক আহমেদ, শান্ত মাহবুব, তানভীর ইসলাম ও রাশেদ খান শিমুল মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আমরা জিরোটলারেন্স। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যে কেউ মাদক ব্যবসায়ে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবো।’ বিশ্ববিদালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন বলেন, ‘সন্দেহজনকভাবে শিক্ষার্থীদের তল্লাশি করার এখতিয়ার আমাদের নেই। ফলে আমাদের সামনে শিক্ষার্থীরা মাদক কেনাবেচায় জড়িত থাকলেও তাদের ধরতে পারি না।’

বিশ্ববিদালয়ের প্রক্টর আসম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের এলাকার মাদক নির্মূলে আমরা পদক্ষেপ নিতে পারি না। তবে আশুলিয়া থানা পুলিশকে অনেকবার অবহিত করেছি। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের যারা জড়িত, তাদের বিষয়ে তথ্য দিলে ব্যবস্থা নেবো।’ র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক (মুখপাত্র) কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘ধর্ষণকাণ্ডে জড়িত মামুন ও মুরাদকে আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বিশ্ববিদ্যালয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের তথ্য পেয়েছি। আমাদের সদস্যরা সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তদন্ত কার্যক্রম চলমান রেখেছেন। আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবো।’

https://mzamin.com/news.php?news=98341