১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, সোমবার, ৪:১৪

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ধারালো অস্ত্রধারী ছাত্রলীগের আট নেতা–কর্মী শনাক্ত

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী খালেদ মাসুদ একসময় ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি রেজাউল হকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত ছিলেন। সেই সূত্রেই ২০২২ সালের ৩১ জুলাই পূর্ণাঙ্গ কমিটিতেই পান আইন সম্পাদকের পদ। তবে পদ পাওয়ার পর ঘনিষ্ঠ খালেদ মাসুদই রেজাউলকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন।

খালেদ মাসুদ বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি মির্জা খবিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। মির্জা খবির ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ার (সিএফসি) উপপক্ষের নেতৃত্ব দেন। এ উপপক্ষের বেশির ভাগ সংঘর্ষেই এখন খালেদ মাসুদ থাকেন সামনের সারিতে। প্রতিবারই রামদা হাতে তাঁকে দেখা যায়। সংঘর্ষে জড়ানো ও সাংবাদিককে মারধরের ঘটনায় ইতিমধ্যে দুবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বহিষ্কৃত হয়েছেন। একবার ২০২১ সালে ১৮ অক্টোবর, আরেকবার গত বছরের ২২ জুন। তবে দুবারই ‘মানবিক কারণে’ বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করে নেয় কর্তৃপক্ষ।

দুই দফায় চলা এ সংঘর্ষের সময় অন্তত ৬০ নেতা-কর্মীকে রামদা হাতে দেখা গেছে। এর মধ্যে খালেদ মাসুদ একজন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘাত ও সংঘর্ষের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অনুরোধ জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নাম ব্যবহার করে কোনো দায়ী ব্যক্তি যেন রেহাই না পান, সে বিষয়েও সচেতন থাকতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মন্ত্রী। গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।

গত বৃহস্পতিবার রাতে ও শুক্রবার বিকেলে দুই দফায় সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগের উপপক্ষ সিক্সটি নাইন ও সিএফসি। এতে পুলিশের ৩ সদস্যসহ আহত হন ২৯ জন। দুই দফায় চলা এ সংঘর্ষের সময় অন্তত ৬০ নেতা-কর্মীকে রামদা হাতে দেখা গেছে। এর মধ্যে খালেদ মাসুদ একজন। তাঁকে গত শুক্রবার বিকেলে সংঘর্ষ চলাকালে শাহ আমানত হলের সামনে রামদা হাতে দেখা যায়। সংঘর্ষের সময় তোলা বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ, ছবি ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে পরিচয়ের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
জানতে চাইলে খালেদ মাসুদ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তিনি সংঘর্ষের সময় হলের ভেতরে ছিলেন। এখন সিনিয়র হয়ে গেছেন। মারামারিতে আসেন না। জুনিয়ররা আসে।

খালেদ মাসুদ কেবল একা নন, রামদা হাতে থাকা আরও সাত নেতা-কর্মীকে একই প্রক্রিয়ায় শনাক্ত করেছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তাঁরা হলেন সিএফসি উপপক্ষের সাবেক উপদপ্তর সম্পাদক আরাফাত রায়হান, সিএফসির কর্মী যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের মোহাম্মদ শামীম, একই বর্ষের দর্শন বিভাগের ইমন আহমেদ।

এ ছাড়া রয়েছেন সিক্সটি নাইন উপপক্ষের মার্কেটিং বিভাগের স্নাতকোত্তরের আহমেদ অনিক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের চতুর্থ বর্ষের মেহেদী হাসান, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের নাইম আরাফাত, অ্যাকাউন্টিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের মোহাম্মদ হোসাইন।
সিক্সটি নাইন উপপক্ষের এ চার কর্মীই বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহজালাল হলে থাকেন। তাঁদের বৃহস্পতিবার রাতে শাহজালাল হলের সামনে ধারালো অস্ত্র হাতে দেখা গেছে। তাঁরা সবাই সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইদুল ইসলামের অনুসারী।

খালেদ মাসুদ কেবল একা নন, রামদা হাতে থাকা আরও সাত নেতা-কর্মীকে একই প্রক্রিয়ায় শনাক্ত করেছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তাঁরা হলেন সিএফসি উপপক্ষের সাবেক উপদপ্তর সম্পাদক আরাফাত রায়হান, সিএফসির কর্মী যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের মোহাম্মদ শামীম, একই বর্ষের দর্শন বিভাগের ইমন আহমেদ।

আর খালেদ মাসুদসহ সিএফসির ওই চার নেতা-কর্মী থাকেন শাহ আমানত হলে। তাঁদের শুক্রবার বিকেল ও রাতে শাহ আমানত হলের সামনে দেখা গেছে। তাঁরা সাবেক সহসভাপতি মির্জা খবির সাদাফের অনুসারী।

জানতে চাইলে সিক্সটি নাইনের নেতা সাইদুল ইসলাম দাবি করেন, তাঁদের কর্মীদের কারও হাতে রামদা তিনি দেখেননি। প্রতিহত করতে অনেকেই হাতে লাঠিসোঁটা নিয়েছিলেন। যদি কারও হাতে রামদা থাকার বিষয়ে অভিযোগ পান, খতিয়ে দেখবেন।

আর সিএফসির নেতা মির্জা খবির সাদাফ প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসন ব্যবস্থা নিলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসত।

এ ঘটনায় ইতিমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়া এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে রোববার (আজ) একটি সভা হবে। এ সভায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যক্তি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা থাকবেন। সভা শেষে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

প্রক্টর নূরুল আজিম সিকদার
রামদা হাতে শনাক্ত হওয়া এসব নেতা-কর্মীর মধ্যে আরাফাত রায়হানকে গত বছরের ২২ জুন কর্মরত এক সাংবাদিককে মারধরের ঘটনায় ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার করা হয়। তবে মানবিক কারণ দেখিয়ে ৪ অক্টোবর এ আদেশ প্রত্যাহার করে প্রশাসন। অন্যদিকে নাইম আরাফাতকে এর আগেও রামদা হাতে সংঘর্ষে জড়াতে দেখা গেছে৷ তাঁকেসহ তিনজনকে রামদা হাতে শনাক্ত করে গত বছরের ৩ জুন প্রথম আলোতে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। বাকি দুজন হলেন পদার্থবিদ্যা বিভাগের স্নাতকোত্তরের সাব্বির হোসেন, আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের মোহাম্মদুজ্জামান ওমর। তবে এখন পর্যন্ত প্রশাসন কিংবা ছাত্রলীগ কেউ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এ ছাড়া গত ২৩ সেপ্টেম্বর ধারালো অস্ত্র হাতে থাকা তিনজনের ছবি দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছিল প্রথম আলো। তাঁদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ওই তিনজন হলেন সাবেক উপপ্রচার সম্পাদক সুলতান মাহবুব, সাবেক সহসম্পাদক রুবেল মিয়া ওরফে মাহিন রুবেল এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের কর্মী মোহাম্মদ সফল।

সংঘর্ষের সময় হাতে রামদা থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে মেহেদী হাসান, আরাফাত রায়হান ও ইমন আহমেদ দাবি করেন, তাঁরা ঘটনাস্থলেই ছিলেন না। আর আহমেদ অনিক ও নাইম আরাফাতের মুঠোফোনে কল করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। পরে মোহাম্মদ শামীম দাবি করেন, তাঁদের একজনকে সিক্সটি নাইনের কর্মীরা কুপিয়েছেন। এ কারণে তিনি প্রতিহত করতে রামদা হাতে নিয়েছিলেন। তবে কাউকে আঘাত করেননি।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর নূরুল আজিম সিকদার প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় ইতিমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়া এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে রোববার (আজ) একটি সভা হবে। এ সভায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যক্তি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা থাকবেন। সভা শেষে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে দুটি পক্ষে বিভক্ত। একটি পক্ষ শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান ও আরেকটি পক্ষ সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়। এ দুটি পক্ষ আবার ১১টি উপপক্ষে বিভক্ত। এর মধ্যে বিজয় ও সিএফসি মহিবুল হাসানের। আর বাকি নয়টি পক্ষ আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

https://www.prothomalo.com/bangladesh/crime/u482i7zi7w