১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, রবিবার, ৩:২৫

আমানত সুরক্ষা ঘাটতি ৫ হাজার কোটি টাকা

ধারদেনা করেও তারল্য সংকট কাটতে পারছে না ব্যাংকগুলো। আমানত সুরক্ষায় ব্যাংকগুলোকে আমানতের একটি অংশ বাধ্যতামূলকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখতে হয়। তবে ইসলামী ব্যাংকসহ ছয়টি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ও দুটি প্রচলিত ধারার ব্যাংক চাহিদামতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সেই অর্থ জমা রাখতে পারছে না। এমন খবরে শরীয়াহ ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন করছে গ্রাহকরা। ফলে তারল্য সংকট আরও বাড়ছে।

এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা এসব ব্যাংকের চলতি হিসাব মাঝেমধ্যে বড় ঘাটতিতে পড়ছে। কয়েকটি ব্যাংকের বড় এই ঘাটতির কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখা ব্যাংকগুলোর আমানত সুরক্ষার অর্থে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গত নবেম্বর শেষে এই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিসেম্বর ভিত্তিক প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

ইসলামী ব্যাংকের ভয়ঙ্কর নবেম্বর এই শিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকে নিউজ হওয়ার পর থেকে এই ব্যাংক থেকে গ্রাহক আমানত প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে,তারা প্রতিদিনই ধারদেনা করে গ্রাহকের দাবি পূরণ করছে। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে ব্যাংকটি সব ধরনের ঋণ বন্ধ করে দিয়েছে।

তারল্য সংকটে থাকা সাত ব্যাংককে ধার দিয়ে চালাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরমধ্যে পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক রয়েছে। তাদেরকে ২২ হাজার কোটি টাকা ধার দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে তথ্য পাওয়া গেছে।

সূত্র জানায়, লেন্ডার অব দ্য লাস্ট রিসোর্ট-এর একটি বিষয় রয়েছে। সে হিসেবে সাত ব্যাংককে এই টাকা ধার দেওয়া হয়েছে। এর আগেও এই ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নিয়মিত সব তফসিলি ব্যাংককে ধার দিয়ে থাকে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংক কোম্পানি অ্যাক্টের ক্ষমতাবলে সিকিউরিটিজের পাশাপাশি ডিমান্ড প্রমিজরি নোটের মাধ্যমে টাকা ধার নেয় সংকটে থাকা দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।

তবে শঙ্কার কথা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নেওয়া সাত ব্যাংকের মধ্যে পাঁচটিই ইসলামী ব্যাংক। এই পাঁচটি ব্যাংক হচ্ছে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক এবং গ্লোবাল ইসলামি ব্যাংক। বাকি দুটি বেসরকারি তফসিলি ব্যাংক হচ্ছে- পদ্মা ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংক।

নীতিমালা অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিতে হলে ব্যাংকগুলোকে বিল, বন্ড জমা রাখতে হয়। তবে এই সাত ব্যাংকের কাছে ব্যবহারযোগ্য বিল-বন্ডও নেই যে তারা জমা রাখবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন সময় দেওয়া তথ্য অনুসারে, পাঁচ শরিয়াভিত্তিক ব্যাংকের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে দীর্ঘদিন ধরে ঘাটতি রয়েছে। ফলে প্রতিশ্রুতিপত্র (ডিমান্ড প্রমিজারি নোট) দিয়ে টাকা ধার করেছে সংকটে থাকা কয়েকটি ব্যাংক। এর মাধ্যমে যেকোনো উপায়ে ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ব্যাংকগুলো।

দেশের ব্যাংকগুলোকে গত নবেম্বরে নগদ জমা বাবদ (সিআরআর) কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ৭১ হাজার ৫২ কোটি টাকা জমা রাখার বাধ্যবাধকতা ছিল, কিন্তু ব্যাংকগুলো জমা রাখতে পেরেছিল ৬৫ হাজার ৮৫৯ কোটি টাকা। তারল্য সংকটে না থাকা ব্যাংকগুলো সিআরআর বাবদ প্রয়োজনের বেশি অর্থ জমা রাখলেও সব মিলিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এ বাবদ ঘাটতি ছিল পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি। মূলত শরিয়াহভিত্তিক কিছু ব্যাংক সিআরআর বাবদ অর্থ জমা রাখতে না পারায় সার্বিকভাবে এ ঘাটতি তৈরি হয়েছে। সিআরআরের অর্থ জমা রাখতে না পারা ব্যাংকগুলো জরিমানা গুনছে, জরিমানার সেই টাকাও তারা জমা দিতে পারছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, কিছু ব্যাংক বড় ধরনের তারল্য সংকটে রয়েছে। ফলে পুরো খাতেই এ সংকট ছড়িয়ে পড়ছে। যার প্রভাবে দেশের ভালো ব্যাংকগুলোও দেশে-বিদেশে নানা প্রশ্নের মুখে পড়ছে। বিশেষ করে বৈশ্বিক মান যাচাইকারী সংস্থাগুলোর কাছে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

যেসব ব্যাংকের কারণে এ ঘাটতি দেখা দিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক। এর মধ্যে নানা অনিয়মের পর প্রচলিত ধারার পদ্মা ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা, মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এসেছে। তবে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন এ নিয়ে বলেন, পুরো ব্যাংক খাতের সিআরআরে ঘাটতি থাকা ভালো খবর নয়। স্থানীয় গ্রাহকেরা ব্যাংকভিত্তিক খোঁজখবর নিয়ে লেনদেন করে থাকেন। এতে হয়তো ব্যাংকগুলোর আস্থায় সমস্যা হবে না। তবে বিদেশি ঋণমান যাচাইকারী সংস্থা, বিদেশি ব্যাংক ও বিদেশিরা এ ঘাটতিকে ভালো চোখে দেখবে না। তারা এসব সূচক পর্যালোচনা করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেয়। যেসব ব্যাংকের কারণে এই পরিস্থিতি হয়েছে, নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পদক্ষেপ নিচ্ছে।

শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোতে নানা অনিয়মের পর আমানতের প্রবৃদ্ধি আগের চেয়ে কমে গেছে। সেই তুলনায় কমেনি ঋণ বিতরণ। ফলে যেটুকু আমানত আসছে, তার বড় অংশই ঋণে চলে যাচ্ছে। তাতে এসব ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী অর্থ জমা রাখতে পারছে না। এ জন্য জরিমানাও গুনতে হচ্ছে; কিন্তু জরিমানার টাকা পরিশোধ করছে না।

গত ৩১ জানুয়ারি সিআরআর বাবদ ইসলামী ব্যাংকের জমা রাখার কথা ছিল ৬ হাজার ৬৫ কোটি টাকা। ওই দিন ব্যাংকটির চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ২ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। ফলে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়ায় ৮ হাজার ৩২১ কোটি টাকা। একই দিন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ৯ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৩ হাজার ৪৮২ কোটি টাকা, ইউনিয়ন ব্যাংকের ২ হাজার ৬ কোটি টাকা ও আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ৩৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া একই দিন ন্যাশনাল ব্যাংকের ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা ও পদ্মা ব্যাংকের ১৪৫ কোটি টাকা।

নানা অনিয়মের কারণে গত ডিসেম্বরে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে পদ্মা ব্যাংকের পর্ষদও ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তবে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। উল্টো বিশেষ ক্ষমতায় টাকা ধার দিয়ে এসব ব্যাংকের কার্যক্রম সচল রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের এমডির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা সাড়া দেয়নি।

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, কোনো জবাবদিহি ছাড়া এসব ব্যাংককে টিকিয়ে রাখতে টাকা ছাপিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এভাবে টাকা দেওয়ার ক্ষমতা কাউকে দেওয়া হয়নি। এসব ব্যাংকের কারণে পুরো ব্যাংক খাতে বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে, যা ব্যাংকব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। ভালো ভালো ব্যাংকও সমস্যায় পড়েছে। এভাবে গুটিকয় ব্যাংকের অপরাধের দায় সব ব্যাংক নিতে পারে না। এর একটা ব্যবস্থা করা উচিত।

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি মাসে অর্থনীতির হালচাল নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত ২২ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা ছিল। গত বছরের জুলাইয়ে যা কমে হয় ৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। আগস্ট থেকে পুরো ব্যাংক খাতে ঘাটতি শুরু হয়। ওই মাসে ঘাটতি হয় ৬৯৫ কোটি টাকা। এরপর ক্রমাগত ঘাটতি বাড়তে থাকে। গত নবেম্বরে তা বেড়ে হয় ৫ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। এতে চাপে পড়েছে অন্য ব্যাংকগুলোও।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, পুরো ব্যাংক খাতে এত বড় ঘাটতি হওয়ায় বিদেশীদের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, পুরো খাতের অবস্থা খারাপ। বিশেষ করে যারা বাণিজ্য অংশীদার ব্যাংক, তারা এ নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। যেভাবেই হোক, দ্রুত এই ঘাটতি পূরণ করা প্রয়োজন। কারণ, কয়েকটি ব্যাংকের দায় পুরো ব্যাংক খাতের ওপর এসে পড়েছে। সূচক খারাপ হয়ে পড়েছে।

https://www.dailysangram.info/post/549165