১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, শনিবার, ১০:১৭

১৩ মাসে এক হাজারের বেশি হত্যাকাণ্ড, ৫২৯ জনই শিশু

► চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৪৪ শিশুকে হত্যা

► ৬০% হত্যার পেছনে কারণ পারিবারিক কলহ

► ২০২৩ সালে দেশে রাজনৈতিক 

রাজধানী ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে গত ১০ ফেব্রুয়ারি তাওহীদ ইসলাম নামের এক শিশুকে অপহরণ করা হয়। এক পর্যায়ে অপহৃত শিশুর মা মুক্তিপণের তিন লাখ টাকা দিলেও ছেলেকে আর জীবিত ফিরে পাননি। হত্যার শিকার শিশুটির লাশ ফেলা হয় সেপটিক ট্যাংকে।

এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে মকবুল হোসেন নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।
এ বিষয়ে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, মকবুলকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, প্রবাসী বাবার কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করতে ওই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। তবে পরিবার বলছে, মুক্তিপণ দেওয়ার পরও ওই সন্ত্রাসী শিশুটিকে হত্যা করে। নিহত তাওহীদের মা তাসলিমা বেগম বলেন, ‘আমি সন্তান হত্যার বিচার চাই।’

শুধু এই শিশু হত্যার ঘটনাই নয়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত গত ১৩ মাসে দেশে এক হাজারের বেশি নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করা হয়েছে।

এর মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা বেশি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সারা দেশে ৪৪ শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। সেই হিসাবে ১৩ মাসে ৫২৯ জন শিশুকে হত্যা করা হয়। পুলিশ ও মানবাধিকার সংস্থা, আইন ও সালিশ কেন্দ্র সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সমাজ বিশ্লেষক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে সম্প্রতি সারা দেশে খুনখারাবির মতো অপরাধ বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে অপরাধ করেও আইনের ফাঁকফোকর গলে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের পার পাওয়া বা বিচার থেকে রেহাই পাওয়ার বিষয়টিও এতে ইন্ধন জোগাচ্ছে।

অতি সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ৯ বছরের শিশু সানজিদা খাতুন নামের এক শিশুকে হত্যার পর লাশ পুঁতে রাখা হয় ধানক্ষেতে। পাঁচ দিন লাশটি মাটির নিচে থাকায় শরীরে পচন ধরেছে। গত বৃহস্পতিবার সকালে শিশুটির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ বলছে, পারিবারিক বিরোধের জের ধরে এই শিশুকে তার সত্বাবা হত্যা করে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে।

এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলা সদরের বারোয়ারি বটতলা মহল্লার একটি বাসা থেকে তিনজনের গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতরা হলো ওই এলাকার বিকাশ চন্দ্র সরকার, তাঁর স্ত্রী স্বর্ণা রানী সরকার ও তাঁদের একমাত্র কন্যা ১৫ বছরের পারমিতা সরকার তুষি। তদন্ত সূত্রে পুলিশ জানায়, ব্যবসা ও পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে মামা বিকাশ চন্দ্রকে সপরিবারে হত্যা করেন তাঁর আপন ভাগ্নে রাজীব কুমার ভৌমিক।

এসব হত্যার বেশির ভাগ ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে সামাজিক, পারিবারিক ও আর্থিক বিরোধের জের ধরে তুচ্ছ কারণে মানুষ একে অপরকে হত্যা করছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এসব ঘটনা আরেকবার সামাজিক পরিসরে কুিসত কর্মকাণ্ডের ভয়াবহ চিত্রও সামনে নিয়ে এসেছে। এসব ঘটনার জন্য নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়কে দায়ী করছেন সমাজবিদ, মনোবিদ ও অপরাধ বিশ্লেষকরা।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সামাজিক পরিবর্তন, পারিবারিক মূল্যবোধ ও বন্ধন অনেকটা ভেঙে গেছে। বিশ্বায়নের যুগে মানুষের মধ্যে লোভ ও উচ্চাভিলাষ বাড়ছে। অবক্ষয ঘটছে নৈতিকতার। এ ছাড়া সমাজের বিভিন্ন বিশৃঙ্খল পরিবেশ মানুষের মানসিক সমস্যা ও অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

অপরাধ বিশ্লেষক মাওলানা ভাষানি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, সমাজে এখন যে ধরনের অপরাধপ্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক। তুচ্ছ কারণে একজন আরেকজনকে খুন করছে। বেড়েছে সহিংসতা। এর পাশাপাশি মানুষের আয়-রোজগার কমে যাওয়া, বেকারত্ব, মানবিক ও মানসিক বিপর্যয়ও এই অস্থির পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এ জন্য সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্রের দায় রয়েছে। এই অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই।

পুলিশের তথ্যে অপরাধের চিত্র
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তর সূত্র বলছে, গত এক বছরে রাজধানীর আটটি ক্রাইম বিভাগের ৫০ থানা এলাকায় হত্যার ঘটনায় ১৬৫টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে অনেক মামলায় সন্দেহে থাকা ব্যক্তি গ্রেপ্তার হয়েছে। বেশির ভাগ মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। ডিএমপির এক পরিসংখ্যান বলছে, পারিবারিক কলহের জেরে খুনের ঘটনা বেড়েছে।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, সমাজে মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় আর পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণেই বেশির ভাগ অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে। ফলে খুনখারাবি বেড়ে যাচ্ছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৩ মাসে সারা দেশে এক হাজারের বেশি হত্যার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব ঘটনার ৬০ শতাংশ পারিবারিক কলহের কারণে ঘটে। নিরপরাধ শিশুরাও স্বামী-স্ত্রীর বিরোধের কারণে হত্যার শিকার হয়।

যা বলছে মানবাধিকার সংগঠন
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, গত ১৫ নভেম্বর থেকে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় সামাজিক বিরোধ থেকে সংঘর্ষ, সংঘাত, হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনী সহিংসতার অন্তত ৭৪৯টি ঘটনায় নিহত ১৫ জন। আহত দুই হাজার ৫১৬ জন। ১০০ জনের বেশি গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ৪৫০টির বেশি গৃহ ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, আগুন ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে দেশে রাজনৈতিক সংঘাতে ৪৫ জন নিহত হয়েছে। এ সময় গণপিটুনিতে ৫১ জন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে ২০ জনের মৃত্যু হয়। গত বছর নারীর প্রতি সহিংসতা ছিল উদ্বেগজনক বিষয়। এ সময়ে সারা দেশে ৫৭৩ জন নারী ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় তিন নারীকে। ধর্ষণের শিকার আরো তিন নারী আত্মহত্যা করেন। এ ছাড়া এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ১২২ জন পুরুষ। প্রতিবাদ করতে গিয়ে আটজন নারী-পুরুষ খুন হন।

পুলিশের সাবেক আইজি মো. শহীদুল হক বলেন, বর্তমানে সামাজিক অস্থিরতা বেড়েছে। এ কারণে খুনোখুনি বাড়ছে। শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী দিয়ে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এসব রোধে সমাজের বিজ্ঞজন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

সাম্প্রতিক আরো হত্যাকাণ্ড
গত ২১ জানুয়ারি গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যার পর হাজারীবাগের একটি সাততলা বাড়ির বাথরুমে ফেলে রাখা হয় তানিয়া নামের এক নারীর লাশ। ঢাকার লালমাটিয়া মহিলা কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর করে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ব্যবসা করতেন তিনি।
প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ বলছে, ১৯ জানুয়ারি থেকে ২১ জানুয়ারির মধ্যে তানিয়াকে হত্যা করা হয়। পারিবারিক, সামাজিক বা ব্যক্তিগত বিরোধের কারণে তাঁকে হত্যা করা হতে পারে।

এই তথ্য দিয়ে পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন বলেন, ‘তানিয়া হত্যাকাণ্ডে তার কাছেরই কেউ জড়িত থাকতে পারে।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের হীরাপুর মধ্যপাড়া এলাকায় গত মঙ্গলবার বিকেলে তাছলিমা আক্তার নামের এক নববধূকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সৌদিপ্রবাসীর সঙ্গে বিয়ের চার দিন পর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বামীর সংসারে যান এই নারী।

এর দুই দিন আগে গত রবিবার রাতে যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া গ্রামের মুরাদ হোসেনকে তাঁর বাড়ির পাশের সড়কে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

দেশের সার্বিক এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (অপারেশন) আনোয়ার হোসেন বলেন, বেশির ভাগ অপরাধের মূলে রয়েছে ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিরোধ।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2024/02/17/1364328