১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৫

অস্বাস্থ্যকর বাতাসে বসবাস

প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল /এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার ছাড়পত্র কবিতায় এমন আশাবাদ ব্যক্ত করলেও গেল জানুয়ারি মাসে জন্ম নেওয়া শিশুটিও পৃথিবীতে এসেই দূষিত বা অস্বাস্থ্যকর বায়ু সেবন করে চলেছে। আমরা শিশু বৃদ্ধসহ কারো জন্যই এ নগরীর বাতাসকে নির্মল করতে পারিনি। রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণ দিন দিনই বাড়ছে। বর্তমানে এ শহরের বায়ুর মান কোনদিন খুবই অস্বাস্থ্যকর আবার কোনদিন ‘বিপজ্জনক’ পর্যায়ে থাকছে। চলতি বছরের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত একদিনও ঢাকাবাসী নির্মল বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারেনি। গত জানুয়ারি মাসের ৩১ দিনের মধ্যে ১১ দিনই রাজধানীর বাতাস ছিল বিপজ্জনক। আর বাকি ২০দিনের ৮দিন ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং ১২ দিন ছিল অস্বাস্থ্যকর। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসেও বায়ুমানে তেমন কোন উন্নতি নেই। চলতি মাসের ১৪ দিনের মধ্যে ৪ দিনই ঢাকার বাতাস ছিল বিপজ্জনক। এ ছাড়া বাকি দিনগুলো ছিল খুবই অস্বাস্থ্যকর। গতকালও ফাগুনের প্রথম দিন বায়ুদূষণে বিশ্বের ১০০টি শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। সকালে আইকিউএয়ারের বাতাসের মানসূচকে ঢাকার স্কোর ছিল ২৮৮। এ স্কোরকে খুবই অস্বাস্থ্যকর বলে ধরা হয়। এর আগের গত তিন দিন ধরে ঢাকার বাতাস খুবই অস্বাস্থ্যকর হিসাবে বিশ্বের বায়ুদূষণের শহরের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে।

গত এক সপ্তাহ ধরে চরম অস্বাস্থ্যকর বায়ুর মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়েই জীবন কাটাচ্ছে এই মেগাসিটির মানুষ। আর এর ফলে সর্দি-কাশিসহ নানা জটিল এবং কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে ঢাকাবাসী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতিবেদন অনুসারে, বায়ুদূষণের ফলে স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যানসার এবং তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু ৮ বছর কমছে।

আইকিউএয়ারের মানদণ্ড অনুযায়ী, স্কোর ৫১ থেকে ১০০ হলে তাকে ‘মাঝারি’ বা ‘গ্রহণযোগ্য’ মানের বায়ু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১০১ থেকে ১৫০ স্কোরকে ‘সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর’ ধরা হয়। স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে তা ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু। স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে তাকে ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ বায়ু ধরা হয়। ৩০১ থেকে তার ওপরের স্কোরকে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ বা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বা বিপজ্জনক ধরা হয়।

রাজধানীর বায়ুদূষণ নিয়ে দেশের উচ্চ আদালত বারবার অসন্তোষ প্রকাশ করে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা দিলেও এখন পর্যন্ত তা কার্যকর হচ্ছে না। সিটি কর্পোরেশনকে প্রতিদিন সকাল বিকাল দুই রাস্তায় পানি ছিটানোর নির্দেশ দিলেও তা করা হচ্ছে না। পরিবেশ অধিদফতরও এ ব্যাপারে উদাসীন। রাজধানীর বায়ুদূষণের জন্য দায়ী এর আশপাশের অবৈধ ইটভাটা এবং ফিটনেসহীন পুরানো লক্কর ঝক্কর গাড়ির কালো ধোঁয়া। অথচ এগুলোর বিরেুদ্ধে পরিবেশ অধিদফতরের কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই। রাজধানীর আশপাশের অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে অভিযান চলে। এরপর সেগুলো যথারীতি আবার চলে। তবে গত বছর বেশ কিছু ইটভাটা বন্ধ করা হয়েছে। এবছর আরও দৃঢ়ভাবে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবে পরিবেশ অধিদফতর। তবে ফিটনেসবিহীন পুরানো গাড়ির ব্যাপারে পরিবেশ অধিদফতর কিছুই করতে পারছে না। এ ব্যাপারে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা প্রয়োজন। রাজধানীতে যে সব ফিটনেহীন পুরানো গাড়ি চলছে তার বিরুদ্ধে বিআরটিএ ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের কোন উদ্যোগ নেই। এ ছাড়া রাজধানীতে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের জন্য রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ফলে ধূলাবালি বাতাসকে দূষিত করছে। এ ব্যাপারেও সিটি কর্পোরেশন উদাসীন। পরিবেশবাদীরা বলছেন, ধূলার দূষণে রোগবালাই থেকে শুরু করে পোশাক-পরিচ্ছদ, আসবাবপত্র, বাসাবাড়ি, খাবার-দাবার সবকিছুতেই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন নগরবাসী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরের বায়ুদূষণ রোধে সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়হীনতা রয়েছে। বিশেষ করে ধূলাদূষণের প্রধান উৎস নির্মাণকাজ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও সেগুলো মানছে না সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া দূষণ রোধে সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয় নেই। ফলে শহরে মারাত্মক আকার ধারণ করছে ধূলাদূষণ।

পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা’র নির্বাহী প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ঢাকার বাতাস এত দূষিত যে আমাদের গড় আয়ু গড়ে আট বছর কমে যাচ্ছে। এ ভয়াবহ বাস্তবতাকে আমরা কেবল দেখে যাচ্ছি, শুনে যাচ্ছি। কিন্তু মোকাবিলা করার কোনো ব্যবস্থা নেই। পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। অথচ নাগরিকদের জীবন রক্ষার জন্য এ বিষয়টিকে সবচেয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখা উচিত।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের নেতা শরিফ জামিল ইনকিলাবকে বলেন, রাজধানীর বায়ুদূষণের জন্য প্রথম সর্বোচ্চ উৎস নির্মাণকাজ, দ্বিতীয় কারণ হলো শিল্পকারখানার কালো ধোঁয়া, তৃতীয় সর্বোচ্চ হলো ফিটনেসবিহীন যানবাহনের ধোঁয়া, এর পর ঢাকার আশপাশের অবৈধ ইটভাটা। এসব উৎস থেকে বায়ুদূষণ প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। কিন্তু সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় নয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট আরও সেব মন্ত্রণালয় বা সংস্থা আছে তাদের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। শুধু পরিবেশ অধিদফতরের একার পক্ষে রাজধানীর বায়ুদূষণ নিরসন করা সম্ভব নয়।

দূষণবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপসের গবেষণা বলছে, ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য সমন্বয়হীন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ ৩০ শতাংশ দায়ী। ঢাকার বায়ুদূষণে শিল্পায়নের প্রভাব ও আশপাশের ইটভাটার পাশাপাশি নির্মাণ স্থান হলো ধূলা দূষণের প্রধান উৎস। এছাড়া নির্মাণসামগ্রী আনা নেওয়ার সময় বড় বড় মালবাহী গাড়িতে ছাউনি না থাকায় ছড়াচ্ছে ধূলা। ক্যাপসের চেয়ারম্যান ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকায় নির্মাণ কাজ করার ক্ষেত্রে বেশির ভাগই নির্মাণবিধি মানা হয় না। যেখানে সেখানে রাস্তা কাটাকাটির কারণে ধূলাবালি বেশি হয়। সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্টরা যদি নজরদারি রাখতো তাহলে এ উৎসগুলো থেকে দূষণ হতো না।

ক্যাপসের গবেষণা বলছে, সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে যে এলাকায় পানি ছিটানো হচ্ছে দুই ঘণ্টা পর সেখানের দূষণ পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ধূলাদূষণ রোধে সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদফতর ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়কে গুরুত্ব দিচ্ছেন ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের উচিত নির্মাণকাজে একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেওয়া। যারাই ঢাকা শহরের নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত তাদের নির্দিষ্ট বিধি অনুযায়ী কাজ শেষ করতে হবে। ঢাকা শহরে ১০টি মন্ত্রণালয় ও ৩০-৩৫টি সংস্থা বায়ুদূষণের সঙ্গে যুক্ত। এক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর বা সিটি করপোরেশন এর টেকসই সমাধান করতে পারবে না। এজন্য সর্বোচ্চ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে কাজ করতে হবে।

এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, রাজধানীর বায়ুদূষণ ও পরিবেশ দূষণ রোধে ইতোমধ্যে আমরা ১০০ দিনের অগ্রাধিকার কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সমন্বয়ে কার্যকর কমিটি গঠন করা হচ্ছে। এসব সমন্বয় কমিটির মাধ্যমে আমাদের নেওয়া কর্মপরিকল্পনা যথাযথ বাস্তবায়ন হলে আশা করি ঢাকা একটি সুস্থ সুন্দর ও স্মার্ট নগরীতে পরিণত হবে।

https://dailyinqilab.com/national/article/638798