১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১০:১৯

নিবন্ধন থাকার পরও শিক্ষক হতে পারছেন না ৬ লাখ প্রার্থী

২০০৫ সাল থেকে অসংখ্য সনদ অকার্যকর

প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও নিবন্ধন নিয়ে শিক্ষক হতে পারছেন না ছয় লাখের বেশি প্রার্থী। বয়স জটিলতা আর নিবন্ধন সনদ বাতিল হওয়ায় অনেক প্রার্থী এখন আর শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন না। বাধ্য হয়ে অনেকে শিক্ষকতার পেশার আশা বাদ দিয়ে ঝুঁকছেন অন্য পেশায়। সূত্র জানায়, ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষক নিবন্ধনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ছয় লাখ ৩৪ হাজারের বেশি প্রার্থীর শিক্ষক নিবন্ধন সনদ অকার্যকর হয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এন্ট্রি লেভেলের শিক্ষক পদে নিয়োগ পেতে শিক্ষক নিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক। বর্তমানে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে প্রার্থীরা নিবন্ধিত হয়ে বেসরকারি হাইস্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার সুযোগ পান। বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও এন্ট্রি লেভেলের (সহকারী শিক্ষক, সহকারী মৌলভী, প্রভাষক) শিক্ষক নিয়োগে প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) কর্মকর্তারা বলছেন, আদালতের নির্দেশনায় শিক্ষক নিবন্ধন সনদের মেয়াদ ফের তিন বছর নির্ধারিত হয়েছে। তাই ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে প্রথম থেকে পঞ্চদশ পর্যন্ত ১৬টি (একটি বিশেষসহ) শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছয় লাখ ৩৪ হাজার ১২৭ জন প্রার্থীর সনদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাই অকার্যকর সনদ নিয়ে তারা আর পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করার সুযোগ পাবেন না। কিন্তু ইতোমধ্যে নিয়োগ পেয়ে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকা শিক্ষকদের ক্ষেত্রে সনদের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়া কোনো প্রভাব ফেলবে না। যদিও সনদ অকার্যকর হওয়া প্রাার্থীদের বেশির ভাগেরই শিক্ষক হওয়ার বয়সসীমা পার হয়ে গেছে।

এ বিষয়ে এনটিআরসিএর এক কর্মকর্তা জানান, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এক রায়ে শিক্ষক নিবন্ধন সনদের মেয়াদ তিন বছর নির্ধারণের নির্দেশনা এসেছিল। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে দেয়া ওই রায়ের বিষয়ে সলিসিটর উইংয়ের মতামত চাওয়া হয়েছিল। মতামতে সলিসিটর উইং জানিয়েছে, আদালত ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে জারি হওয়া শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা গ্রহণ ও প্রত্যয়ন বিধিমালার সংশোধনের আলোকে সনদ বা প্রত্যয়নের মেয়াদ তিন বছর করার নির্দেশনা দিয়েছেন। তাই যাদের সনদের মেয়াদ তিন বছরের বেশি হয়ে গেছে তাদের আর শিক্ষক পদে নিয়োগ পাওয়া বা আবেদন করার সুযোগ নেই।

কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়েছিল ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ অক্টোবর। সে হিসাবে ১৬তম নিবন্ধনে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের সনদের মেয়াদ আছে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত। আর ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ফল প্রকাশিত ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধনে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের সনদের মেয়াদ সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী আর নেই। তাই তারা বা তাদের আগে নিবন্ধিত প্রার্থীরা আর শিক্ষক পদে নিয়োগের আবেদন করতে পারবেন না। তবে গত বছরের শেষ সপ্তাহে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ হওয়া ১৭তম শিক্ষক নিবন্ধনে উত্তীর্ণ ২৩ হাজার ৯৮৫ জন প্রার্থী ও ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধনে উত্তীর্ণ ১৮ হাজার ৫৫০ জন প্রার্থীর মধ্যে যারা এখনো নিয়োগ সুপারিশ পেয়ে এমপিওভুক্ত হননি (ইনডেক্স পাননি) তারা পঞ্চম ধাপে শিক্ষক নিয়োগে আবেদন ও নিয়োগ সুপারিশ পাওয়ার সুযোগ পাবেন।

এনটিআরসিএর এ-সংক্রান্ত তথ্য দেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও সচিব মো: ওবায়দুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আদালতের নির্দেশনা অমান্য করার সুযোগ নেই। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে সনদের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে তিন বছর। সেভাবেই আগামী শিক্ষক নিয়োগ বা পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তির কার্যক্রম চালানো হবে। আদালতের নির্দেশনা অমান্য করার সুযোগ নেই।

জানা গেছে, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে আপিল বিভাগের রায়ে সনদের মেয়াদ নির্ধারণ করা হলেও এরপর তৃতীয় ও চতুর্থ ধাপে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। তবে তখন আবেদনের ক্ষেত্রে সনদের মেয়াদ বেঁধে দেয়া হয়নি। তাই নিবন্ধিত প্রার্থীরা আবেদন করে নিয়োগ সুপারিশ পেয়েছিলেন। তখন সনদের মেয়াদ নির্ধারণ কেন করা হয়নি জানতে চাইলে সচিব আরো বলেন, এ রায়ের বিষয়ে সলিসিটর উইংয়ের মতামত পাওয়া গেছে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তির নিয়োগের চূড়ান্ত সুপারিশের পর। তাই ওই নিয়োগগুলোতে বিষয়টি মানা যায়নি। তবে এখন থেকে বিষয়টি মানা হবে।

এ দিকে সনদের মেয়াদ নির্ধারণ হলেও কৌশলগত কারণে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘোষণা দেয়া হচ্ছে না। তবে যাদের সনদের মেয়াদ শেষ হয়েছে তারা আবেদন করতে পারবেন না। আবেদন করে নির্বাচিত হলেও তারা চূড়ান্ত সুপারিশ পাবেন না। যাচাইয়ে তারা বাদ যাবেন।

যদিও এনটিআরসিএ সর্বশেষ প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, শিক্ষক নিবন্ধনের সনদের মেয়াদ প্রথমে ছিল পাঁচ বছর। পরবর্তী সময়ে মেয়াদ তুলে দেয়া হয়। পুনরায় মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় তিন বছর। পরে হাইকোর্টের নির্দেশনায় সনদের মেয়াদ তুলে দেয়া হয়েছিল।

২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ২১ অক্টোবর সাবেক শিক্ষা সচিব মো: নজরুল ইসলাম খান (এন আই খান) স্বাক্ষরে জারি হওয়া শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষা গ্রহণ ও প্রত্যয়ন বিধিমালার সংশোধনে বলা হয়েছিল, শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের ডাটাবেজে এন্ট্রি ও তিন বছর মেয়াদি সনদ দেবে এনটিআরসিএ।

এনটিআরসিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রথম থেকে ১৭তম পর্যন্ত ১৮টি (একটি বিশেষসহ) শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় ছয় লাখ ৬৭ হাজার ৬৬২ জন প্রার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাদের মধ্য হতে প্রথম থেকে ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছয় লাখ ৩৪ হাজার ১২৭ জন প্রার্থীর সনদের মেয়াদ শেষ। আর ১৬তম ও ১৭তম শিক্ষক নিবন্ধনে উত্তীর্ণ ৪২ হাজার ৫৩৫ জন প্রার্থীর মধ্যে যারা এমপিওভুক্ত হননি বা ইনডেক্স পাননি তারা পঞ্চম গণবিজ্ঞপ্তিতে আবেদন করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-প্রভাষক হওয়ার সুযোগ পাবেন। তবে এ মুহূর্তে দেশের ৩৫ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অর্ধলক্ষাধিক শিক্ষক পদ শূন্য আছে।

সূত্র জানায়, প্রথম থেকে দ্বাদশ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার সনদ ছিল শিক্ষক পদে চাকরির আবেদন করার প্রাক যোগ্যতার। শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য তাদেরকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেসরকারি ব্যবস্থাপনা কমিটির নেয়া পরীক্ষা দিতে হতো। তবে ১৩তম থেকে অদ্যাবধি উত্তীর্ণ প্রার্থীরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য নির্বাচিত হন।

প্রথম থেকে পঞ্চম শিক্ষক নিবন্ধনে (২০০৫- ২০০৯) পর্যন্ত ১০০ নম্বরের আবশ্যিক বিষয়ে তিন ঘণ্টার লিখিত ও ১০০ নম্বরের ঐচ্ছিক বিষয়ে তিন ঘণ্টার লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়। ষষ্ঠ থেকে একাদশ শিক্ষক নিবন্ধন (২০১০-২০১৪) পরীক্ষা আবশ্যিক বিষয়ে এমসিকিউ ছিল ও আবশ্যিক বিষয়ে এক ঘণ্টা ও ঐচ্ছিক বিষয়ে তিন ঘণ্টা মোট চার ঘণ্টার লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়। দ্বাদশ শিক্ষক নিবন্ধনে (২০১৫) যুক্ত হয় প্রিলিমিনারি। এ নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রথম ধাপে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা ও প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণদের ১০০ নম্বরের ঐচ্ছিক বিষয়ে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ১৩তম শিক্ষক নিবন্ধন থেকে (২০১৬) প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার সাথে যুক্ত হয় ভাইভা। এরপর থেকে প্রিলিমিনারি, লিখিত ও ভাইভার পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে শিক্ষক নিবন্ধনে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/814240