১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, মঙ্গলবার, ১১:৪৩

বই না ছাপিয়েও সাড়ে ৮ লাখ টাকা লোপাট

কৃষি তথ্য সার্ভিসে মিলেমিশে লুটপাট-১

প্রতি বছর জুন মাসে জাতীয় ফল মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত হয় ‘ফল সম্ভার’ বই। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধিনস্থ সংস্থা কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) এ বই মুদ্রণের পর তা মেলায় আগতদের সরবরাহ করে। গত বছর (২০২৩) ফল মেলা অনুষ্ঠিত না হলেও ফল সম্ভার বই ঠিকই প্রকাশিত হয়েছে। তবে তা বাস্তবে নয়, কাগজে-কলমে। এআইএসের কর্তা বাবুরা ‘ফল সম্ভার’ বই প্রকাশের ভুয়া বিল ভাউচার তৈরি করে প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা লোপাট করেছেন।

খামারবাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) ও এআইএস কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, প্রতি বছর ১৬-১৮ জুন খামার বাড়ির পাশে জাতীয় ফল মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত নিয়মিত এ মেলা অনুষ্ঠিত হলেও মহামারী করোনার সময় ও পরবর্তীতে (২০২২ হয়েছে) আর মেলা হয়নি। তাই ফল সম্ভার নামের ওই বই প্রকাশেরও প্রয়োজনীয়তা পড়েনি। কিন্তু এআইএসের কর্তা বাবুরা ঠিকই তিনটি কোটেশনে মোট ৮ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৯ টাকার বিল ভাউচার তৈরি করে গত জুলাই মাসে তা উত্তোলন করেছেন। ১২৮ পৃষ্ঠার এই বই তিনটি আলাদা কোটেশনে যথাক্রমে ৮৯০ কপি (২ লাখ ৪৮ হাজার ৮৭ টাকা), ১০৬০ কপি (২ লাখ ৯২ হাজার ৬৮৭ টাকা) এবং ১০৬০ কপি (২ লাখ ৯৫ হাজার ৪৭৫ টাকা) মুদ্রণ ব্যয় দেখিয়েছেন।

খামারবাড়ি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফল সম্ভার বই মূলত ফল মেলায় আগতদের কাছে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়ে থাকে। খামারবাড়িসহ আঞ্চলিক অফিসগুলোতে এ বই পাঠানো হয়। গত বছর এ বই কেউ দেখেনি। তারা বলছেন, যেহেতু ফলমেলাই হয়নি, সেখানে ফল সম্ভার বই ছাপানোর তো প্রয়োজনীয়তাই থাকে না। এআইএসের তৎকালীন প্রধান তথ্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো: আবু জাফর আল মুনছুর এসব গায়েবি বিলে স্মাক্ষর করেছেন।

এআইএসের বিভিন্ন শাখা ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে আলাপ করেও ২০২৩ সালে কথিত প্রকাশিত ‘ফল সম্ভার’ বইয়ের হদিস পাওয়া যায়নি। গত ৭ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির প্রশিক্ষণ ও প্রয়োগ অফিসার মো: পারভেজের সাথে তার রুমের সামনে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তার সাথে আরো তিনজন ছিলেন। পারভেজের কাছে গত বছরের ফল সম্ভার বই চাওয়া হলে তিনি জানান, ফল মেলাই হয়নি, আবার বই কোথা থেকে আসবে? গতকাল সোমবার দুপুরে এআইএসের প্রেরক দফতরে গিয়ে-সারোয়ার জাহানের রুমে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তার কাছে বই চাইলেও তিনিও একই কথা বলেন। করোনার পর ফলমেলা হয়নি, তাই এ সংক্রান্ত কোনো বইও প্রকাশিত হয়নি।

গতকাল সোমবার দুপুরে বর্তমানে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরে মনিটরিং উইংয়ের উপপরিচালকের দায়িত্বে থাকা মো: আবু জাফর আল মুনছুরের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি প্রথমে স্বীকার করেন করোনা ও করোনা পরবর্তী সময়ে কোনো ফলমেলা হয়নি। তিনি বলেন, যতদিন ফলমেলা হয়েছে ততদিন ‘ফল সম্ভার’ বই বের হয়েছে। তাহলে গত বছর ‘ফল সম্ভার’ নামে বই প্রকাশের বিল ভাউচার করা হলো কী করে? যেখানে আপনার স্বাক্ষর রয়েছে? এমন প্রশ্ন করতেই কিছুক্ষণ চুপ থেকে পাল্টে ফেলেন জবাব। তিনি তখন বলেন, বই প্রকাশ হয়েছে কি না- সবগুলো বিল ভাউচার না দেখে বলতে পারব না। অল্প পরিসরে ১০০ বা ২০০টি বই ছাপা হতে পারে। তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি প্রকাশনা পেন্ডিং ছিল। দেখবেন যে ওখানে (এআইএস-প্রকাশনা দফতরে) কয়েক দিনের মধ্যে বই চলে আসছে।

ডিএই থেকেই মোবাইলে কথা হয় এআইএস পরিচালক সুরজিত সাহা রায়ের সাথে। তিনি জানান, করোনার পর থেকে কোনো ফলমেলা হয়নি। ফল সম্ভার বইও হয়নি। শুধু কৃষি কথা বই হয় (মুদ্রণ)।

জানা যায়, বিভিন্ন ফলের পরিচিতি ও গুণাগুণ উল্লেখ করে কালার ছবিসহ ‘ফল সম্ভার’ বইটি মুদ্রণ করে তা মেলায় বিতরণ করে এআইএস। বইয়ের ভেতরে সবকিছু ঠিক থাকলেও ওপরের মলাটের ডিজাইন ও সাল পরিবর্তন করে এটা করা হচ্ছিল। ২০২০ সালে করোনা শুরুর পর শুধু ২০২২ সালে ছোট পরিসরে অনুষ্ঠিত হয়েছে মেলা। খামারবাড়ি একাধিক সূত্র বলছে, তখন খুব অল্প সংখ্যক এ বই মুদ্রণ করা হয়।

খামার বাড়ির একটি সূত্র জানায়, এআইএসের সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এবং বর্তমানে ডিএইতে কর্মরত উপপরিচালক মো: আবু জাফর আল মুনছুর গতকাল দুপুরে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলার পরই পরই কিছু সংখ্যক বই প্রকাশ করার তোড়জোড় শুরু করে দেন। তিনি দেখাতে চান, কিছু বই হলেও এআইএস মুদ্রণ করেছে।

এসব বিষয় নিয়ে গতকাল সন্ধ্যায় পরিচালক সুরজিত সাহা রায়ের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ফল সম্ভার বই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, করোনার পর সম্ভবত এক বছর হয়েছে। সেটা গত বছর নাকি আগের বছর (২০২২) মনে নেই। গত বছর মনে হয় বই হয়নি, তবে এই বই মুদ্রণের প্রসেসিংয়ে আছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/813723