১৪ মে ২০১৭, রবিবার, ৯:০৭

মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ১৩ কোটি গ্রাহক

দেশে মোবাইল ফোন সেট ও মোবাইল টাওয়ার থেকে নির্গত রেডিয়েশন পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। প্রতি বছর কোনও ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই দেশে আসছে কয়েক কোটি মোবাইল সেট। এসব মোবাইল ফোনের জন্য টাওয়ার রয়েছে কয়েক হাজার। অথচ এগুলো পরীক্ষার কোনও ধরনের ব্যবস্থা নেই দেশে। ফলে রেডিয়েশন সংক্রান্ত মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন দেশের প্রায় ১৩ কোটি গ্রাহক। এমনকি যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না, তারাও এসব টাওয়ারের কারণে আছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।

আমদানিকারকদের জমা দেয়া বিদেশী ‘সনদ’ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তায় একমাত্র ভিত্তি। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিতে এই সনদকেই ধরা নেয়া হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার একমাত্র মানদন্ড। অন্যদিকে টাওয়ার নিয়ে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর বেলায়ও অনুসরণ করা হয় একই নীতি। প্রতিটি মোবাইল ফোনেই রেডিয়েশন (যার একক ওয়াট পার কেজি) বা বিকিরণ হয়ে থাকে। তবে এরও একটি আদর্শ মাপ বা মান রয়েছে। সেই মানের নিচে রেডিয়েশন বা বিকিরণ হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু দেশে আসা মোবাইল ফোনগুলোতে কী মাত্রায় রেডিয়েশন রয়েছে তা মাপার কোনও ল্যাব না থাকায় তা পরীক্ষা ব্যতিরেকেই ছড়িয়ে পড়ছে বাজারে।
মূলত মোবাইল ফোনের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার অভাবে ব্যবহারকারীরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন বলে মনে করেন গবেষক, মোবাইল ফোন বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক ও আমদানিকারকরা। এছাড়া মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যহানির কথা বিশ্বখ্যাত জার্নালগুলোতে বলছেন বিদেশী গবেষকরা।
জানা গেছে, বিটিআরসির কাছে মোবাইল ফোন ও টাওয়ারের বিকিরণ পরিমাপের কোনও যন্ত্র নেই। স্বাভাবিকভাবেই বিটিআরসি বিকিরণ পরিমাপের কাজটি করতে পারে না।
সূত্র জানায়, বিটিআরসির ২০৪তম কমিশন সভায় বিকিরণ পরিমাপের জন্য দুটি মোবাইল যন্ত্র কেনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এজন্য সরকারের কাছে তারা বরাদ্দ চেয়েছেন ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এছাড়া যন্ত্র দুটি পরিবহনের জন্য গাড়ি কেনার জন্য চাওয়া হয় ১ কোটি টাকা। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, রেডিয়েশন পরিমাপের জন্য যন্ত্র দুটি ক্রয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
বিটিআরসির জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক জাকির হোসেন খাঁন জানান, রেডিয়েশন পরিমাপের যন্ত্র না থাকায় টেলিযোগাযোগ কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র থেকে কোনও ধরনের রেডিয়েশন নির্গত হয় কিনা কিংবা হলে তার মাত্রা কী তা জানার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। তবে শিগগিরই এই সমস্যার সমাধান হতে যাচ্ছে যন্ত্র কেনার মাধ্যমে।
তিনি বলেন, কমিশনের এ ধরনের কোনও যন্ত্র নেই ঠিক, তবে আমদানিকারকরা সাধারণত মোবাইল ফোন দেশে আনার সময় বিশ্বখ্যাত বিভিন্ন নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের সনদ যুক্ত করেন। ওইসব সনদ কমিশন পরীক্ষা করে দেখে। ফলে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব কম্পিউটেশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চের ভলিউম-৩, ইস্যু-৪-এ তুলে ধরা হয়েছে ‘ মোবাইল ফোন রেডিয়েশন ইফেক্টস অন হিউম্যান হেলথ’ শীর্ষক প্রবন্ধ। এতে বলা হয়েছে, মোবাইল ফোন সেটে থাকে ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক ফিল্ড বা ইএমএফ। মোবাইল কমিউনিকেশনে থাকে একটি সিগন্যাল যা ট্রান্সফারড হয় ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ওয়েভে, এটি যায় রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ও মাইক্রোওয়েভ সিগন্যাল দিয়ে। এই সিগন্যালই ক্ষতিকারক ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন তৈরি করে। এই ওয়েভ মোবাইলে কথা বলার সময় মানুষের শরীরের সংস্পর্শে এসে স্বাস্থ্যগত সমস্যা তৈরি করে। এ কারণে কান ও মাথার খুলির ক্ষতি হতে পারে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে মস্তিষ্কের নিউরনেও। নিবন্ধে আরও উল্লেখ করা হয় এই রেডিয়েশন শরীরে রক্তচাপ বৃদ্ধি ছাড়াও কান গরম, ত্বকে প্রদাহ সৃষ্টি, মাথা ব্যথাসহ আরও অনেক সমস্যা তৈরি করে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনের মহাপরিচালক মাহবুবুল হক বলেন, মোবাইল ফোনের টাওয়ার ও সেট থেকে অবশ্যই রেডিয়েশন হয়। এই রেডিয়েশন হলো নন আয়োনাইজিং রেডিয়েশন। বলা হয়ে থাকে, এই রেডিয়েশন কোনও ক্ষতিকর না। কথা হচ্ছে, ক্ষতি করে কী করে না তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না। তেমন করে কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয়নি। তবে এ বিষয়ে গবেষণা চলছে।
আণবিক শক্তি কমিশনের মহাপরিচালক জানান, হাইভোল্টেজ তারের নিচে ১০-২০ ফুট এলাকার মধ্যে কোনও ইঁদুর থাকে না। সুতরাং জীবদেহের বুদ্ধিবৃত্তি মানুষের চেয়ে বেশি। এ ধরনের কিছু কিছু প্রমাণ দিয়ে অনেকের ধারণা রেডিয়েশন হয় এবং রেডিয়েশন ক্ষতি করে। তিনি আরও জানান, আনবিক শক্তি কমিশনে নন আয়োনাজিং রেডিয়েশন নিয়ে কাজ করার কোনও স্কোপ নেই। কমিশনে নন আয়োনাজিং রেডিয়েশন পরিমাপের কিছু কিছু ব্যবস্থা আছে, কিন্তু তা জীবদেহে কি ধরনের ক্ষতি করলো তা পরিমাপের কোনও ব্যবস্থা নেই।
আমদানিকারকরা আমদানি করা মোবাইল সেট সনদসহ বিটিআরসিতে জমা দিয়ে থাকে। ওই সনদকে বলা হয় এসএআর (স্পেসিফিকেশন অ্যাবজরবেশন রেট বা নির্দিষ্ট শোষণ হার)। এই সনদই প্রতিটি সেটের বিপরীতে আমদানিকারকরা জমা দিয়ে থাকেন। আগে হার্ডকপি (প্রিন্ট কপি) জমা দেয়া হতো, এখন সফট কপি জমা দেয়া হয় বলে জানান বিআইএমপিএ’র (বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ইমপোর্টার্স এসোসিয়েশন) সাধারণ সম্পাদক রেজওয়ানুল হক।
জানা যায়, গত বছর দেশে আমদানি করা মোবাইল ফোন সেটের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ১০ লাখ। ২০১৫ সালে সংখ্যাটি ছিল ২ কোটি ৬০ লাখ। প্রতি বছর এ সংখ্যা বাড়ছেই। একটি মোবাইল সেটের গড় আয়ু (ব্যবহারের সময়কাল) তিন বছর। ফলে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কোনও ধরনের পরীক্ষা ছাড়াই দেশে ঢুকেছে কয়েক কোটি মোবাইল সেট।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন পরিমাপের জন্য একটি ল্যাব তৈরি করতে কয়েক কোটি টাকা প্রয়োজন। এই টাকা কে দেবে বা কোথা থেকে সংস্থান হবে সেই বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত না হওয়ায় এতদিন ল্যাব চালু করা যায়নি।
এ প্রসঙ্গে বিটিআরসির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, দেশে মোবাইল ফোন পরীক্ষার কোনও ল্যাব নেই। এ কারণে আমদানিকারকদের দেয়া ফ্যাক্টরি রিপোর্ট দেখেই আমরা ছাড়পত্র দিই। কারণ বড় বড় ফ্যাক্টরির রিপোর্ট অনুযায়ী আমরা বুঝতে পারি মোবাইল সেটটির মান কেমন কিংবা সবকিছু ঠিক আছে কিনা। আমদানিকারকরা বিটিআরসিতে মোবাইল সেট নিয়ে আসেন, প্রেজেন্টেশন দেন। বিটিআরসি দেখে ফ্যাক্টরি রিপোর্ট এবং এনওসি (অনাপত্তিপত্র) আছে কিনা।
বড় বড় আমদানিকারকরা (ব্র্যান্ডেড মোবাইল সেট) সাধারণত এনওসি নিয়েই মোবাইল ফোন আমদানি করে থাকেন বলে বিটিআরসির ওই দায়িত্বশীল কর্মকর্তার দাবি।
জানা গেছে, কমদামের মোবাইল সেটে বেশিমাত্রায় রেডিয়েশন থাকে এবং তা স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। তারপরও কেন পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই, তা নিয়ে জানতে চাইলে বিটিআরসির ওই দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, মোবাইল সেট আমদানিকারকরা কম দামের মোবাইল এনওসি ছাড়া নিয়ে আসেন বলে আমাদের কাছে অভিযোগ রয়েছে। আমরা সেগুলো শনাক্ত করি, বাজার থেকে ধরে ফেলি এবং বাজেয়াপ্ত করি।
মোবাইল টাওয়াররেডিয়েশনের কারিগরি বিষয় জানতে চাইলে সিম্ফনি মোবাইলের হেড অব কোয়ালিটি কন্ট্রোল (বাংলাদেশ) মাজহারুল ইসলাম বলেন, রেডিয়েশনের তিনটি স্ট্যান্ডার্ড রয়েছে। এগুলো হলো ইউএসএ স্ট্যান্ডার্ড, ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ড এবং সাব-কন্টিনেন্টাল স্ট্যান্ডার্ড। বাংলাদেশে অনুসরণ করা হয় ইউএসএ স্ট্যান্ডার্ড। তাই দেশে রেডিয়েশনের আদর্শ মান ১ দশমিক ৬ ওয়াট পার কেজি পার গ্রাম অব টিস্যু। যার ফ্রিকোয়েন্সি মান ১০০ কিলোহার্টজ থেকে ৬ গিগাহার্টজ। নির্দিষ্টমানের চেয়ে রেডিয়েশন বেশি হলেই তা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশে এই রেডিয়েশনের মাত্রা এর চেয়ে নিচে থাকতে হবে।
উন্নত দেশগুলোতে ১৯৭৫ সালের আগে হার্ট অ্যাটাক, কিডনি রোগ এবং মস্তিষ্কে ক্যানসারের রোগীর সংখ্যা ছিল অনেক কম। পরবর্তী সময়ে মোবাইল ফোনের ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে এসব রোগের মাত্রাও বেড়েছে। মোবাইল ফোনে অধিক সময় কথা বললে কানের স্নায়ুতন্ত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়। অনেক সময় কানের ভেতরে ব্যথা এবং মস্তিষ্কের নিউরনের ক্ষতি করে। দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলতে থাকলে এটি মস্তিষ্কের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। অনেক শিশুই মোবাইল ফোনে গান শোনা, গেমস খেলা কিংবা কথা বলার প্রতি আকৃষ্ট হয়। এগুলো শিশুর জন্য চরম ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে মনে করা হয়।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস এন্ড হসপিটালের সহযোগী অধ্যাপক ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ ডা. জহিরুল ইসলাম চৌধুরীর কাছে রেডিয়েশনের ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, মোবাইল ফোনের রেডিয়েশনে নিউরোলজিক্যাল সমস্যা হতে পারে। তখন কানের পর্দায় চাপ পড়ে, মস্তিষ্কেরও ক্ষতি করে। যেহেতু এটি তরঙ্গর মাধ্যমে চালিত হয়, সেই কারণে তা মস্তিষ্কের নিউরনে ক্ষতি করে। এ কারণে বেড়ে যায় মানসিক চাপ, চাপ তৈরি করে মস্তিষ্ক ও কানের আন্তঃকর্ণের ওপর।
এসবের কারণে ক্যানসার এবং মস্তিষ্কে টিউমারও হতে পারে বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিসৎক। তিনি আরও বলেন, অন্যান্য রেডিয়েশন থেকে যেহেতু ক্যানসার হয় সেহেতু আমরা ধারণা করি এর কারণেও ক্যানসার হতে পারে। তবে সবই আমাদের ধারণা বা সন্দেহ। কারণ আমাদের হাতে কোনও প্রমাণ নেই।
ডা. জহিরুল ইসলাম চৌধুরী জানান, মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন থেকে টিউমার, ক্যানসারসহ আরও যা যা হয় সবই চিকিৎসকদের ধারণা। এ বিষয়ে চিকিৎসকদের কাছে কোনও তথ্য নেই। মেডিকেল বিষয়ক টেক্সট বুকেও কোনও কিছু উল্লেখ নেই।

 

http://www.dailysangram.com/post/283650-