৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বুধবার

প্রশিক্ষণের চেয়ে ভবনে তোড়জোড়

দেশের যুবাদের কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে ৫২৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর। প্রকল্পে প্রশিক্ষণের চেয়ে ৬৪ জেলায় ভবন নির্মাণে বেশি তোড়জোড় চলছে। যদিও ৬৪ জেলায়ই প্রশিক্ষণ ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ১১ জেলায় তিন-চার বছর আগে নতুন প্রশিক্ষণ ভবন করা হয়। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সম্প্রতি এই প্রকল্প প্রস্তাব মূল্যায়ন নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনে সভা হয়েছে। সভা সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পটির মাধ্যমে ৩০ হাজার ৫৬০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এতে ব্যয় হবে ১৪০ কোটি ৯১ লাখ টাকা।

অথচ প্রকল্পটিতে ৬৪টি ভবন নির্মাণে ১৭০ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে। প্রশিক্ষণ যন্ত্রপাতি কিনতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৯ কোটি টাকা। আর আউটসোর্সিংয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৮ কোটি টাকা। প্রকল্পে ভবন নির্মাণে ৩২ শতাংশ অর্থ ব্যয় ধরা হয়েছে, যা দিয়ে আরো বেশি যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেত।

প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের জেলা ও উপজেলা পর‌্যায়ে স্থাপিত যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এর মধ্যে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় তিনটি ট্রেডের জন্য তিনটি পৃথক শেড বা একটি বড় শেড নির্মাণের জন্য যে জায়গার প্রয়োজন, বর্তমানে তা নেই। প্রকল্পের প্রশিক্ষণ ও ব্যাবহারিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সীমিত জায়গায় একটি ঊর্ধ্বমুখী ভবন নির্মাণ করা হলে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন ও জায়গা সাশ্রয় হবে। বর্ণিত অবস্থা বিবেচনায় রেখে প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় শেড নির্মাণের পরিবর্তে চারতলা ভবন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। ভবনের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় তিনটি ট্রেডের জন্য তিনটি ল্যাব স্থাপন করা হবে এবং চতুর্থ তলায় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।

৬৪ জেলায়ই ভবন আছে বলে জানান যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা) কাজী মোখলেসুর রহমান। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভালো ভবন নেই। অনেক জেলায় টিনশেড বা পুরনো ভবন আছে, যেখানে অনেকে প্রশিক্ষণ নিতে চায় না। কোনো কোনো জায়গায় ভবন একেবারেই ব্যবহারের অযোগ্য।’

যুগ্ম সচিব বলেন, ‘তবে সব জেলায় ভবন করা হবে না। যেখানে প্রয়োজন, সেখানে হবে। তবে পরিকল্পনা কমিশন যদি আমাদের সব কিছু দেখে মনে করে ভবন নির্মাণের দরকার নেই, তাহলে দেবে না। প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ চলবে, আবার ভবন নির্মাণও করা হবে। ভবন করেই তাতে প্রশিক্ষণ দেব, তেমন নয়।’

তবে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা) এম এ আখের কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ভবন নয়, প্রশিক্ষণের জন্য শেড করব। সেটা ৬৪ জেলায়ই করব। আগে ভবন করার সিদ্ধান্ত ছিল। পরে ভবনের বদলে শেড করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

পরিকল্পনা কমিশনের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো বিভাগের স্কাইসোয়াম অনুবিভাগের যুগ্ম প্রধান যুগ্ম সচিব মো. আশরাফুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভবন থাকলে সেখানে তা নির্মাণের প্রয়োজন নেই। আমরা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে প্রকল্প সুপারিশ করব। এর আগেও বিভিন্ন খাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় দেখে প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব দুইবার ফেরত পাঠানো হয়েছে।’

প্রকল্পটির উদ্দেশ্য হিসেবে প্রস্তাবে বলা হয়, কারিগরি ট্রেডে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা, কারিগরি ও প্রযুক্তি খাতে যুবা নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করা, দক্ষ মানবসম্পদের জন্য দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা, যুবকদের উপার্জনমূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে দেশে দারিদ্র্য হ্রাস করা এবং বিদেশে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বৃদ্ধি করা।

প্রস্তাবে বলা হয়, আমাদের দেশে যাঁদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর, তাঁদের যুবক-যুবতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই জনসংখ্যা দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ, যা ২০১১ সালের আদমশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী চার কোটি ৮০ লাখ ২৪ হাজার ৭০৪ জন। যুবসমাজ দেশের জনশক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেশের মোট জনসংখ্যার সম্ভাবনাময় ও প্রতিশ্রুতিশীল এ অংশকে জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করার সার্বিক দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ওপর। তাই যুব সম্প্রদায়কে দেশের সার্বিক উন্নয়নে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে অধিদপ্তরের কার্যক্রম তৃণমূল পর‌্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হয়েছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে ২২ লাখ যুবক ও যুব মহিলাকে প্রশিক্ষণ এবং ওই প্রশিক্ষিত যুবদের মধ্যে সাত লাখ যুবকে আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী সব সময় অপ্রয়োজনীয় ভবন নির্মাণে নিরুৎসাহিত করেন। সম্প্রতি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরেরই প্রস্তাবিত দেশের অশিক্ষিত জনশক্তিকে কর্মমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরির নিট (নো এডুকেশন, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং) প্রকলগু একনেক সভা থেকে ফেরত দেওয়া হয়।

একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ পরিচালনার জন্য যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সংস্থার বিদ্যমান প্রশিক্ষণকেন্দ্রের ভবন ব্যবহার করতে হবে এবং প্রকল্পের আওতায় ভবন নির্মাণের সংস্থান বাদ দিতে হবে। ভবিষ্যতে বিদ্যমান অবকাঠামো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদান করে প্রকল্প গ্রহণে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন।

নতুন ৫০ টিটিসি করছে বিএমইটি
বিদেশে দক্ষ শ্রমিক পাঠানো ও দেশের শ্রমবাজারের চাহিদা মেটাতে তরুণদের প্রশিক্ষণের জন্য আগে যে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) ছিল, সেগুলোর মধ্যে কিছু জায়গায় প্রশিক্ষণার্থী না পাওয়ায় ভাড়ায় চলছে। সেখানে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) তিন হাজার ৭৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে আরো ৫০টি টিটিসি করছে। সম্প্রতি প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন পেয়েছে।
সরকারের প্রকল্প মনিটরিংয়ের একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। সংস্থাটি ২৭টি টিটিসি নিয়ে প্রতিবেদন দেয়। এতে বলা হয়, প্রশিক্ষণের বিষয় যুগোপযোগী ও আধুনিক না হওয়া, ব্যাবহারিকের সুযোগ না থাকা এবং প্রশিক্ষক সংকটসহ নানা জটিলতায় উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে এসব টিটিসি। টিকে থাকতে কিছু কিছু টিটিসি হলরুম ভাড়া দিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে সেন্টারগুলোর টিকে থাকাই দায়।

এত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করার বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যদি সঠিকভাবে পরিচালনা না করা যায়, তাহলে এত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশে ভালো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রয়োজন আছে, তবে শুধু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র করে ফেলে রাখলে চলবে না।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2024/02/07/1361451