৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বুধবার, ৬:৪৯

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ধাক্কা এবার আবাসন খাতে

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ধাক্কা এবার লেগেছে আবাসন খাতে। আর গ্যাস বিদ্যুৎ পানির সংকট এখাতকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে। ফ্ল্যাটের দাম বৃদ্ধির পেছনে বৈশ্বিক সংকটের কারণে নির্মাণ সামগ্রীর উচ্চমূল্যকে দায়ী করছেন তারা। বাড়ছে শ্রমের মূল্যও। আবাসন ব্যবসায় গতি ফেরাতে নিবন্ধন খরচ ও ব্যাংক ঋণ সহজ করার দাবি জানিয়েছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা।

এসব বিষয়ে রিহ্যাব প্রেসিডেন্ট আলমগীর শামসুল আলামিন বলেন, মন্দাবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জমি ও ফ্ল্যাটের নিবন্ধন খরচ কমাতে হবে। যা চলতি অর্থবছর বাড়ানো হয়েছে। ব্যাংক ঋণ আরও সহজ করতে হবে। ব্যাংকগুলোকে আরও এগিয়ে আসতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে আবার ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে। তিনি বলেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে বিশ্বব্যাপী। এগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যেগুলো সরকারের হাতে আছে, সেগুলো বিশেষ করে নিবন্ধন খরচ ও ব্যাংক ঋণ সহজ করলে গতি পুনরুদ্ধার হতে পারে।

দেশের আবাসন ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে গত তিনটি অর্থবছরে প্রায় ৩৩ হাজার ফ্ল্যাট অবিক্রিত রয়ে গেছে। এ বিষয়ে প্যারাডাইজ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আল আমিন বলেন, ২০২০-২১, ২০২১-২২ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৮ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছিলেন উদ্যোক্তারা। যার মধ্যে প্রতি বছর গড়ে ১৫ হাজার করে মোট ৪৫ হাজার ফ্ল্যাট বিক্রি হয়েছে। অবিক্রিত রয়ে গেছে ৩৩ হাজার ফ্ল্যাট। চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ১০ হাজারের মতো ফ্ল্যাট। নির্মিত ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি না হওয়ায় লোকসান বাড়ছে প্রতিষ্ঠানগুলোর। অনেকেই পড়েছে ঋণ খেলাপির ঝুঁকিতে। আবাসন ব্যবসায়ীদের কপালে এতটা চিন্তার ভাঁজ আগে কখনোই পড়েনি বলে জানান তারা।

জানা গেছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মানুষের জীবন যাত্রায় চাপ পড়েছে। ভোক্তা ক্রয় সামর্থ্য হারিয়েছে। সংশ্লিষ্ট শিল্পের সঙ্গে যুক্তরা এ জন্য করোনা মহামারির পর শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে দায়ী করেছেন। তাদের মতে, মহামারি ও যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী সাপ্লাই চেইনে বিঘœ ঘটে। এর সঙ্গে যোগ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। ফলে দ্রুত বাড়তে থাকে কাঁচামালের দাম। সংশ্লিষ্ট খাতের অধিকাংশ কাঁচামালের জন্য বাংলাদেশকে বিদেশের ওপর নির্ভর করতে হয়।

এদিকে নতুন ফ্ল্যাটের বিক্রি কমায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন নির্মাণ সামগ্রী প্রস্তুতকারকরাও। কারণ আবাসন ব্যবসার সাফল্যের ওপর নির্ভর করে তাদের ব্যবসার ভবিষ্যৎ। কারণ রড, সিমেন্ট, বালু, ইট ও টাইলসের মতো ২৭০টির বেশি খাত সরাসরি ভবন নির্মাণ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত।

নির্মাণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় এক বছরের ব্যবধানে রাজধানীতে ফ্ল্যাটের দাম এলাকাভেদে ২০ থেকে ৩০ শতাংশের মতো বেড়েছে। ব্যবসায়ীদের হিসাবে এই সময়ে নির্মাণ সামগ্রীর দাম গড়ে ৩০ শতাংশের মতো বেড়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাড়তি নিবন্ধন ফি আর করের বোঝা। আবাসন ব্যবসায়ীরা জানান, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রতি টন রডের দাম ছিল ৬০ হাজার টাকা। পরে দাম বেড়ে ৮২-৮৩ হাজার টাকা হয়। বর্তমানে প্রতি টন রড বিক্রি হচ্ছে ৯০-৯২ হাজার টাকায়। বর্তমানে ৫০ কেজি প্রতি ব্যাগ সিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে ৫২০ থেকে ৫৭০ টাকায়। দুই বছর আগেও যার দাম ছিল ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা। এখন প্রতি ট্রাক (তিন হাজার) ইট বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকায়। যা আগের বছরের তুলনায় অনেকটা বেশি। একইভাবে দাম বেড়েছে টাইলস, স্যানিটারি ওয়্যার। সবকিছু মিলিয়ে ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে গেছে। এমন বাস্তবতায় কমেছে ফ্ল্যাটের চাহিদা। যা কমিয়ে দিয়েছে এ খাতের ব্যবসার গতি।

এ বিষয়ে রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি তানভীরুল হক প্রবাল গণমাধ্যমকে বলেন, আট-দশ বছর আগে প্লটের মাটি কাটা শুরু হলেই ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে যেত। সেটা আর এখন নাই। এখন প্রতিযোগিতা বেড়েছে। ধীরে ধীরে ভবন নির্মাণ করবেন ফ্ল্যাট বিক্রি হবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না, ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে স্লো। ফলে ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়ছে। কাজেও আসছে শ্লথ গতি। মোট কথা আমরা নির্মাণ সামগ্রী পাচ্ছি না।

লিফট, জেনারেটর বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এলসি সংকটে আমদানি বন্ধ রয়েছে। এতে প্রকল্প সম্পন্ন হচ্ছে না সময়মতো।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় ৩৫ হাজারের মত ফø্যাট এখনও অবিক্রিত রয়েছে। এতে করে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতি বছরই তাদের সুদ গুণতে হচ্ছে। তারা কোনভাবেই বিনিয়োগ রিটার্ন পাচ্ছে না। গ্যাস সংযোগ না থাকায় পুরাতন ফ্ল্যাট কিনতে আগ্রহী ক্রেতা। এতে করে মোটা অংকের বিনিয়োগ আটকে রয়েছে।

জানা গেছে, ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলো সাধারণত নিজেদের আত্মীয়স্বজন মিলে ৬/১০ কাটা জমি নিয়ে নিজেরাই আবাসন নির্মাণ করছে। এতে করে ফ্ল্যাট তেমন বিক্রি হচ্ছে না। নিজেরা ফ্ল্যাট নির্মাণ করলে মজবুত হয় এবং নির্মাণ ব্যয়ও কম হয়। এতে করে সরাসরি ধাক্কা লেগেছে আবাসন খাতে।

জানা গেছে গত কয়েক বছর ধরেই বাজেটে কালো টাকা আবাসন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ রাখা হচ্ছে। এবং এখানে কালো টাকা বিনিয়োগ করলে অর্থের উৎসও জানতে চাওয়া হবে না। এনিয়ে নানা সমালোচনা হলেও কাংখিত বিনিয়োগ এখাতে আসেনি। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে নির্মাণ শ্রমিকরাও এখন আগের মত কাজ পাচ্ছে না। অনেক নির্মাণ শ্রমিক ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। আবাসন খাতে যারা ঢাকায় বিনিয়োগ করছেন তারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ ঢাকার বাহিরেও অনেক ব্যবসায়ী এখাতে বিনিয়োগ করেছেন। এতে করে ঢাকায় ফ্ল্যাট ব্যবসা কমেছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার যদি এখাতে প্রণোদণা না দেয় তাহলে এ ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।

https://www.dailysangram.info/post/548213