১১ মে ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৩:৪২

হাওরের সর্বনাশ ঠিকাদারদের পোয়াবারো

হাওরে বাঁধ ভেঙে ফসলহানির ঘটনায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গাফিলতি, ঠিকাদারদের অনিয়ম নিয়ে আলোচনা চলছেই। বেরিয়ে আসছে পাউবো কর্তা ও ঠিকাদারদের একের পর এক দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র। তবে পাউবো কর্মকর্তাদের পেছনে রয়েছে বিশাল ছায়াবৃক্ষ। প্রভাবশালী হওয়ায় এদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ ফুটে কিছু বলতেও রাজি নন। হাওরের ফসল ভেসে যাওয়ার পর অনিয়মের কারিগর হিসেবে প্রথম যার নাম এসেছিলো-অভিযোগ রয়েছে 

তিনি এক প্রভাবশালী এমপির আশীর্বাদধন্য। পাউবো ও ঠিকাদারদের প্রতি এ আশীর্বাদ-প্রশ্রয়ে সব হারিয়ে নিঃস্ব সুনামগঞ্জের ১ লাখ ৭২ হাজার ১৭ পরিবার। সুনামগঞ্জের বিশিষ্টজনরা বলছেন, দুর্নীতির ছায়াবৃক্ষদের শুধু প্রত্যাহার বা তিরস্কার করলেই চলবে না। এদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেয়া উচিত।
এক ফসলের উপর নির্ভরশীল হাওর অধ্যুষিত এলাকা সুনামগঞ্জের সকল স্বপ্ন এবার ভেঙে গেছে হাওরের বানের জলে। যত্ন আর পরিশ্রমের শেষে যখন ঘরে সোনার ফসল তোলার কথা, তখনই দুঃস্বপ্ন হয়ে আসে আগাম বর্ষণ। ভারি বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে মার্চের শেষের দিকে সুনামগঞ্জের হাওরে বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করতে থাকে। বানের জলে তলিয়ে যেতে থাকে একের পর এক হাওর। ভেসে যায় হাওরের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো সোনালি ধান। হাওরের ফসলহানির পর সামনে আসে পাউবোর অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র। সময়মতো কাজ শুরু না করা, বিতর্কিত ঠিকাদারদের কাজ প্রদানসহ নানা অভিযোগে সবার আগে প্রশ্নের কাঠগড়ায় আসেন সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দিন। আফসার উদ্দিন কোনো নিয়মনীতির ধার না ধেরে নিজের ইচ্ছেমতো পছন্দসই ঠিকাদারদের কাজ দিয়েছেন। যারা আগেরবারও কার্যাদেশ পেয়ে কাজ করেনি এমন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন তিনি। নতুন ৪৮টি প্যাকেজে এ বছরও তাদের গত বছরের ২৮টি কাজ দেয়া হয়। কিন্তু এবারও তারা বাঁধে কোনো কাজ করেননি। আফসার উদ্দিনকে সঙ্গ দিয়েছেন তার উপরের দুই কর্তা পাউবোর সিলেটের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আবদুল হাই ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম সরকার। পদে ছোট হলেও অনিয়মের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব দেখিয়েছেন আফসার উদ্দিনই। একটি সূত্রে জানা গেছে, আফসার উদ্দিনের এক ভগ্নিপতি প্রভাবশালী এক এমপি। ভগ্নিপতির ক্ষমতার বলেই আফসার উদ্দিন খুব সহজেই নয়কে ছয় আর ছয়কে নয় করে ডুবিয়েছেন হাওরবাসীকে। অবশ্য তারাও এখন বিপদে আছেন। তিন প্রকৌশলীকেই প্রত্যাহার করা হয়েছে ইতিমধ্যে।
এ বছর সুনামগঞ্জে ২ লাখ ১৫ হাজার ৮১৭ হেক্টর জমিতে বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও চাষাবাদ হয়েছে এর চেয়েও বেশি জমিতে। ধানের চাষ হয়েছে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে। হাওরের ফসলরক্ষায় ‘হাওর এলাকার আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সুনামগঞ্জের বৃহৎ ৩৭টি হাওরসহ ৪২টি হাওরে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে বরাদ্দ ছিল ৬৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। বরাবরের মতোই বাঁধ নির্মাণের দায়িত্ব পান ঠিকাদাররা এবং স্থানীয়ভাবে গঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) পায় সংস্কারের কাজ। এবার নির্মাণ উঁচুকরণের জন্য ৭৬টি প্রকল্পের মধ্যে ৪৮টিতে ঠিকাদারদের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩৯ কোটি ৩৮ লাখ টাকা এবং ২৮টিতে ৯ কোটি ৫০ লাখ টাকার আর ভাঙা বাঁধের সংস্কারকাজের জন্য পিআইসি পায় ২০ কোটি ৮২ লাখ টাকার কাজ। পিআইসির কাজ ২৮শে ফেব্রুয়ারি আর ঠিকাদারদের কাজ ৩১শে মার্চের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। যথাসময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় ফসলসহ হাওর ভেসে যায় বানের জলে।
বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে চরম স্বেচ্ছাচারিতার পরিচয় দিয়েছেন ঠিকাদাররা। এমনকি মাথার উপর প্রভাবশালীদের ছায়া থাকায় কেউ কেউ কাজই করেননি। কেউ পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিয়েছেন আবার কারো নামে- বেনামে নিজস্ব ঠিকাদারিও ছিল। মূলত আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের প্রভাবশালী নেতাদের বেপরোয়া প্রশ্রয়ে ঠিকাদাররা বাঁধের কাজে কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করেননি। পাউবো কর্মকর্তারা প্রভাবশালী এসব ঠিকাদারদের ঘাঁটাতে সাহস করেননি। আবার নিজেদের লাভ থাকার কারণেও চুপ ছিলেন তারা। পাউবো কর্মকর্তারা সরাসরিই যুক্ত ছিলেন কোনো কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। গুডম্যান এন্টারপ্রাইজ নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দিন। আফসার উদ্দিন এ প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী টাঙ্গাইলের বাসিন্দা আফজাল হোসেন মাহবুব। হাওরের ফসল রক্ষায় নেয়া ৭৬টি প্রকল্পের ৭টিই পেয়েছে আফসার-আফজাল জুটির এ গুডম্যান এন্টারপ্রাইজ। গুডম্যান এন্টারপ্রাইজের পাওয়া ৭টি প্রকল্পের মধ্যে ৫টিই ছায়ার হাওরে। এছাড়া শনির হাওর, মাটিয়ান হাওরেও একটি করে প্রকল্প পেয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে মাটিয়ান হাওরে কোনো কাজই করেনি গুডম্যান এন্টারপ্রাইজ। বাকিগুলোর কাজও সম্পূর্ণ হয়নি।
৭৬টি প্রকল্পের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছেন খন্দকার শাহীন আহমেদ। ফরিদপুরের বাসিন্দা এ ঠিকাদার কাজ পেয়েছেন ৯টি প্রকল্পে। নাইন্দার হাওরে দুটি প্রকল্পসহ টাঙ্গুয়ার হাওর, খাই হাওর, মাটিয়ান হাওর, ঘোড়াডুবা হাওর, ছায়ার হাওর, দেখার হাওর ও বরাম হাওরে একটি করে প্রকল্প তার ভাগে পড়েছে। প্রভাবশালী এ ঠিকাদার তার ভাগে পড়া নয়টি কাজের মধ্যে নাইন্দার হাওরের ২টিসহ, টাঙ্গুয়ার হাওর, মাটিয়ান হাওর ও বরাম হাওরে পাওয়া প্রকল্পে কোনো কাজই করেননি।
সুনামগঞ্জের বাসিন্দা সজীব রঞ্জন দাশও ৯টি প্রকল্পে ঠিকাদারির দায়িত্ব পেয়েছিলেন। এর মধ্যে হাইল হাওর ও গুরমার হাওরে দুটি করে প্রকল্প, ছায়ার হাওর, নলুয়ার হাওর, সাঙ্গাইর হাওর, চন্দ্র সোনার থাল, ঘোড়াডুবা হাওরে একটি করে প্রকল্প। তবে গুরমার হাওরের দুটি কাজ তিনি ধরেনইনি। বাকিগুলোও সম্পূর্ণ করতে পারেননি। সুনামগঞ্জ শিল্প ও বণিক সমিতির সহ-সভাপতি এবং আওয়ামী লীগের অনুসারী সজীব রঞ্জন স্থানীয়ভাবে বেশ প্রভাবশালী।
৪টি প্রকল্পে কাজ পেয়েছে শোয়েব এন্টারপ্রাইজ। এ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ভাগে পড়ে ঘোড়াডুবা হাওর, কল্যাণী হাওর ও বান্ধাবিল হাওরের কাজ। ৩টি করে প্রকল্পে কাজ পেয়েছেন কাজী নাসিম উদ্দিন, মো. আতিকুর রহমান। নিম্মি অ্যান্ড মুমু কনস্ট্রাকশন, মালতী এন্টারপ্রাইজ, বোনাস ইন্টারন্যাশনাল, নূর ট্রেডিং, বসু নির্মাণ সংস্থাও পেয়েছে ৩টি করে কাজ। এর মধ্যে কাজী নাসিম উদ্দিনের ভাগে পড়েছে সুরাইয়া বিবিয়ানা হাওর, ছায়ার হাওর, কল্যাণী হাওরের ১টি করে কাজ। মো. আতিকুর রহমান পেয়েছেন চন্দ্র সোনার থাল হাওরে ২টি ও জোয়ালভাঙা হাওরে ১টি কাজ। নিম্মি অ্যান্ড মুমু কনস্ট্রাকশন ছায়ার হাওরে ২টি ও পুঁটিয়ার হাওরে ১টি কাজ পেয়েছে। মালতী এন্টারপ্রাইজ ঘোড়াডুবা হাওর, চন্দ্র সোনার থাল হাইল হাওরে ১টি করে কাজ পেয়েছে। বোনাস ইন্টারন্যাশনাল সুরাইয়া বিবিয়ানা হাওরে ২টি ও ছায়ার হাওরে ১টি কাজ পেয়েছে। নূর ট্রেডিং পেয়েছে নলুয়ার হাওর, পাগনার হাওর, ধানকুনিয়া হাওরে একটি কাজ। বসু নির্মাণ সংস্থা পেয়েছে চাপতির হাওর, মাটিয়ান হাওর ও কালিকোটা হাওরে ১টি করে কাজ। ৩টি করে কাজ পাওয়াদের মধ্যে মো. আতিকুর রহমান সুনামগঞ্জ যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান পিন্টুর শ্যালক। আর নূর ট্রেডিংয়ের স্বত্বাধিকারী খায়রুল হুদা চপল সুনামগঞ্জ জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক ও সুনামগঞ্জ শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি। মালতী এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী বিপ্রেস রায় বাপ্পী জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আসাদুজ্জামান পিন্টুর ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
২টি করে কাজ পেয়েছেন শেখ আশরাফ উদ্দিন, আকবর আলী, কামাল হোসেন, রেনু মিয়া। ২টি করে কাজ পেয়েছে ইব্রাহিম ট্রেডার্স, প্রীতি এন্টারপ্রাইজ, হান্নান এন্টারপ্রাইজ, এল এন কনস্ট্রাকশন, লুনা ট্রেডার্স। এর মধ্যে শেখ আশরাফ উদ্দিন কাজ পেয়েছেন ধানকুনিয়া হাওর, মোহালিয়া হাওরে। আকবর আলী কাজ পেয়েছেন মোহালিয়া হাওর ও জামখলা হাওরে। কামাল হোসেন কাজ পেয়েছেন কাঁচিভাঙা হাওর ও সাঙ্গাইর হাওরে। রেনু মিয়া কাজ পেয়েছেন পুঁটিয়ার হাওর, ছায়ার হাওরে। ইব্রাহিম ট্রেডার্সের ভাগে পড়েছে চন্দ্র সোনার থাল হাওরের কাজ আর মো. শামীম আহসানের সঙ্গে মিলে পেয়েছেন দেখার হাওরের কাজ। প্রীতি এন্টারপ্রাইজ পেয়েছে জয়ধুনা হাওর ও ছায়ার হাওরের কাজ, হান্নান এন্টারপ্রাইজের ভাগে পড়ে হাইল হাওর ও মাটিয়ান হাওরের কাজ। এল এন কনস্ট্রাকশন পেয়েছে শনির হাওর ও কড়চার হাওরের কাজ। লুনা ট্রেডার্স পেয়েছে ভেড়ার ডহর হাওর, ছায়ার হাওরের কাজ। বাকি কাজগুলোর মধ্যে সামসুর রহমান শনির হাওরে, ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্স কল্যাণী হাওরে, মাহিন কনস্ট্রাকশন টাঙ্গুয়ার হাওরে, টেকবে ইন্টারন্যাশনাল চন্দ্র সোনার থাল হাওরে, নিয়াজ ট্রেডার্স সোনামোড়ল হাওরে, ম্যাম কনস্ট্রাকশন হুরামন্দিরা হাওরে, মাহিন কনস্ট্রাকশন কালিকোটা হাওরে, সৈকত কনস্ট্রাকশন আঙ্গুর আলী হাওরে ১টি করে কাজ পেয়েছে।
পাউবো’র সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, হাওর এলাকায় আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্পের ৭৬টি কাজের মধ্যে ৯টিতে কোনো কাজই হয়নি। বাকিগুলোর কাজও সম্পূর্ণ হয়নি। কাজ বুঝিয়ে দিতে না পারলেও এ পর্যন্ত ৩৯টি কাজের আংশিক বিল হিসেবে ঠিকাদাররা ইতিমধ্যেই ৯ কোটি ৩৭ লাখ ৯৭ হাজার টাকা তুলে নিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার মতিঝিলের মেসার্স লুনা ট্রেডার্স নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি একাই উঠিয়ে নিয়েছে ২ কোটি ১৫ লাখ ৭ হাজার টাকা। এখন বাকি টাকা উঠিয়ে নিতে তৎপর হয়েছেন ঠিকাদাররা। বিলের দাবিতে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন তারা। বানের জলে সব ভেসে যাওয়ায় তাদের লাভই হয়েছে। কে কতটুকু কাজ করেছেন তার আর প্রমাণ নেই। কাজ না করেও কেউ কেউ তাই টাকা দাবি করতে পারছেন।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=65042&cat=2/-