১১ মে ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৩:৪০

ঢাকায় অরক্ষিত ২৩ রেলক্রসিং

রাজধানী ও আশেপাশের ৩৫ কিলোমিটার রেলপথে ৫৮টি লেভেল ক্রসিংয়ের ২৩টিই অরক্ষিত ও অনুমোদনহীন। এর মধ্যে কোনোটায় নেই কোনো গেটম্যান। আবার কোনোটায় একজন গেটম্যান থাকলেও নেই সিগন্যাল বার। বাধ্য হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়াতে সিগন্যাল বারের বদলে বাঁশের ব্যবহার করছে গেটম্যানরা। আর এসব রেলক্রসিংয়ে কোনো গেটকিপার বা কর্মী না থাকায় মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে গিয়ে প্রায়ই রেলে কাটা পড়ছে সাধারণ মানুষ। বাদ যাচ্ছে না প্রাইভেটকার এমনকি গণপরিবহনও। মঙ্গলবার শ্যামপুর বরইতলা রেলগেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ট্রেন আসার সময় গেটম্যান এলাকাবাসীর সহযোগিতা নিয়ে হাতে করে বাঁশ ধরে মানুষ ঠেকাচ্ছেন। প্রথমে রেল আসার সময় বাঁশি বাজিয়ে সাবধান করেন। কাছে পৌঁছলে কারো সহযোগিতা নিয়ে বাঁশ উঁচিয়ে ধরেন। জানতে চাইলে গেটম্যান জানান, এখানে অনেকদিন ধরে লোহার সিগন্যাল বারও দেয় না। আবার লোকও বাড়ায় না। একজন করে ডিউটি করে সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করি। খিলগাঁও পুলিশ লাইন এলাকায়ও দেখা যায়, রেললাইনের সঙ্গে ক্রসিং রাস্তা থাকলেও নেই কোনো সিগন্যাল বার বা গেটম্যান। এলাকার মানুষ নিজ দায়িত্বে ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হন। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজধানী ও এর আশেপাশের অরক্ষিত ২৩টিসহ মোট ৫৮টি রেলক্রসিংয়ের কারণে নির্ধারিত গতিতে ট্রেনগুলো চালাতে পারেন না চালকরা। ঝুঁকি নিয়ে চলাচলের কারণে গত ৩ বছরে শুধু রাজধানীতেই রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫৪টি। এতে মারা গেছেন ২৩ জন। রেলওয়ের হিসাব অনুযায়ী, গত ৩ বছরে সারা দেশে লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে হাজারটি। এতে মারা গেছে দেড় শতাধিক মানুষ। আহত হয়েছে চারশ’রও অধিক। লেভেল ক্রসিংয়ে রেলরক্ষী না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে ট্রেন। অবৈধ ও অরক্ষিত লেভেল ক্রসিং নিয়ে রেল কর্তৃপক্ষ এ পর্যন্ত লোক দেখানো শতাধিক মামলা করেছে। কোনো কোনো মামলা মাঝপথে এসে ঝুলে রয়েছে। তবে রেলওয়ের ট্রাফিক ও সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা জানান, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় রেলের প্রায় ২৪ হাজার কর্মী সংকট ছিল। গত দুই থেকে তিন বছরে রেলে ৯ হাজার কর্মী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। চলতি বছরও অনেকগুলো গেটকিপার নিয়োগ দেয়া হবে। এ নিয়োগ সম্পন্ন হলে গেটকিপারের সমস্যা মিটে যাবে। তবে অনেক স্থানে অবৈধ লেভেল ক্রসিং গড়ে উঠেছে, এগুলো আমাদের মতামত গ্রহণ করে তৈরি করা হয়নি। একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, সারা দেশে রেলপথ রয়েছে ২ হাজার ৮৩৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে লেভেল ক্রসিং রয়েছে ২ হাজার ৫৪১টি। তবে এই ক্রসিংগুলোর মধ্যে অনুমোদন রয়েছে মাত্র ৭৮০টির। বাকি ১ হাজার ৭৬১টি লেভেল ক্রসিংয়ে কোনো গেটকিপার না থাকায় অনুমোদনহীন ও অরক্ষিত রাখা হয়েছে। এছাড়া, শুধু রাজধানী ও এর আশেপাশের এলাকায় রেলপথ রয়েছে ৩৫ কিলোমিটার। এই এলাকার মধ্যে লেভেল ক্রসিং রয়েছে ৫৮টি। এর মধ্যে ২৩টিই অরক্ষিত ও অনুমোদনহীন। ঝুঁকিপূর্ণ এসব লেভেল ক্রসিংগুলোতে রেল কর্তৃপক্ষ শুধু ‘সামনে রেলক্রসিং, সাবধানে চলাচল করুন’ সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড টানিয়ে তাদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন। এর বাইরে কিছুই করতে পারছে না। ফলে দুর্ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কর্মকর্তারা জানান, শুধু অনুমোদনহীন লেভেল ক্রসিংগুলোই মৃত্যুফাঁদ নয়, সারা দেশে অনুমোদিত ৭৮০টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে গেটকিপার আছে মাত্র ২৪২টিতে। বাকি ৫৩৮টি লেভেল ক্রসিংয়ের অনুমোদন থাকলেও কোনো গেটকিপার নেই। শুধু কর্মী দিয়ে সিগন্যাল কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। অতএব এগুলোও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে।

রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা জানান, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমোদন না নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় রেলপথের যেকোনো স্থানে লেভেল ক্রসিং তৈরি করছে স্থানীয় জনসাধারণ। এবং নগরের ভেতর অনুমোদনহীনভাবে লেভেল ক্রসিং তৈরি করছে সিটি করপোরেশন। রেলওয়ের পক্ষ থেকে অনুমোদনহীন লেভেল ক্রসিং নির্মাণে কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় দিন দিন বেড়েই চলছে অরক্ষিত ও ঝুঁকিপূর্ণ লেভেল ক্রসিংয়ের এসব মৃত্যুকূপ। আর আমাদের অনুমোদন না নিয়ে রেলক্রসিং বৃদ্ধি করায় সব ক্রসিংয়ে গেটকিপার দেয়াও সম্ভব না। রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক মানবজমিনকে বলেন, রেলের ব্যাপক উন্নয়নের জন্য ইতিমধ্যে আমরা দুটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। প্রকল্প দুটি হলো- লেভেল ক্রসিংয়ের মান উন্নয়ন ও গেটকিপার নিয়োগ। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে ১০৩৮ জন ও রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলে ৮৫১ জন গেটকিপার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করেছি। লেভেল ক্রসিং নির্মাণ ও গেটকিপার নিয়োগ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়ে গেলে আশা করছি অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ের কোনো সমস্যা থাকবে না।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=64971&cat=6/