১১ জানুয়ারি ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১১:৪১

সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের নিবন্ধ

বিভক্ত দেশটির বিপদ ঘনিয়ে আসছে

বাংলাদেশের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জয় গণতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর ফলে দেশটি আরো রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যেতে পারে। বিরোধী দল একে ‘ভুয়া নির্বাচন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এটিকে বয়কটের ডাক দিয়েছিল। নির্বাচনের দিন জনগণকে ঘরে থাকার আহ্বান জানায় বিরোধী দলটি, এতে তারা সাড়া দিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২২২টি আসনে জয় পেয়েছে। বাকি আসনগুলোর বেশির ভাগ জিতেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, যাদেরকে ‘ডামি’ বলে আখ্যায়িত করেছে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ভোট বর্জন করার পর নির্বাচনে মাত্র ৪০ শতাংশ ভোটার ভোট দেন। দলটির দাবি, শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানায়। যাই হোক, সর্বশেষ নির্বাচনের ফল অনুযায়ী ৭৬ বছর বয়স্ক শেখ হাসিনা আরো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকছেন। এর আগে টানা তিন দফা ক্ষমতায় ছিলেন তিনি, যে সময়ে বাংলাদেশ একই সাথে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং বৈষম্য দেখেছে।

সমালোচকদের মতে এই সময়কালকে ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদ, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের দমন দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা যায়।
পঞ্চম মেয়াদে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় বসা নিয়ে ব্যাপক হতাশা দেখা গেছে। বিশেষ করে অল্পবয়সী ও শহুরে ভোটারদের মধ্যে এটি বেশি দেখা যাচ্ছে। ৩৩ বছর বয়সী কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম হক বলেন, আমার এই প্রহসনে অংশ নেয়ার কোনো আগ্রহ নেই। এটি আওয়ামী লীগের নতুন নাটক।

সজিব উজ জামান নামের আরেকজন বলেন, এই নির্বাচনে জাতীয় নির্বাচনের আসল আমেজ নেই। একটি স্থানীয় ম্যাগাজিনে কাজ করা ২৬ বছর বয়সী এই লেখক বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলো বাকস্বাধীনতা এবং ভিন্নমতের সুরক্ষার পতন হয়েছে। আমি নিজেই শুধু অল্প কয়েক জনের সাথে আমার চিন্তাভাবনা এবং মতামত প্রকাশ করতে পারি, কারণ তাদেরকে আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি। এই সতর্কতার কারণ হলো, আমি জনসমক্ষে বা সোস্যাল মিডিয়ায় খোলামেলা কথা বলতে গেলে আমার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে কিংবা আমাকে শারীরিক আক্রমণের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে হবে।

শেখ হাসিনা তার জয়ের পর সাধারণ নির্বাচন নিয়ে সমালোচনাকে ‘অবৈধ’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। যারা সমালোচনা করতে চান তারা সমালোচনা করতে পারেন।

আওয়ামী লীগের বিজয় বাংলাদেশের ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর পাশাপাশি অবকাঠামো, টেলিযোগাযোগ, জ্বালানি এবং টেক্সটাইল প্রকল্পে ধারাবাহিকতা চাওয়া বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বস্তির কারণ হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। গত এক দশকে বাংলাদেশ চীন থেকে ২.৬ বিলিয়ন ডলারের বিশাল বিনিয়োগ পেয়েছে, যা জাপানের ৩৮০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগকে ছাড়িয়ে গেছে।

ক্রাইসিস গ্রুপের এশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক পিয়েরে প্রকাশ বলেন, আপনি যদি ভারত বা চীন হন তাহলে আপনার মনে হবে যে, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখা নিজের জন্য আরো স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।

কিন্তু সমালোচকরা বলছেন যে, শেখ হাসিনার প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি নিরবচ্ছিন্ন হয়রানির কারণে বাংলাদেশ তার গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি থেকে দূরে সরে গেছে। প্রকাশ বলেন, একটি স্বাস্থ্যকর ও প্রাণবন্ত গণতন্ত্রের প্রসঙ্গে বলতে গেলে এই নির্বাচনকে গণতন্ত্রের কফিনে পেরেকের মতো দেখায়। আপনি একটি স্বৈরাচারী প্রবণতা, বাকস্বাধীনতা হ্রাস, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা হ্রাস ও গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য হ্রাস দেখতে পাবেন। আপনি ধারণা করতে পারেন যে, সরকারের কণ্ঠস্বরের সাথে ভিন্নমত পোষণ করা অন্য যেকোনো কিছুর ওপর দমন আরো বাড়তে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনা ‘বিএনপির রাজনীতি করার অধিকার নেই’ বলে মন্তব্য করেছেন। ফলে এই নির্বাচনের পর রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হওয়ার আশঙ্কা জানান প্রকাশ। ভোটকে কেন্দ্র করে সারা দেশে ছোটখাটো সহিংস ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। পুলিশ বলছে, অগ্নিসংযোগকারীরা কয়েকটি ভোটকেন্দ্রসহ অন্তত ১০টি গাড়ি ও একাধিক স্থাপনায় আগুন দিয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ডেপুটি এশিয়া ডিরেক্টর মীনাক্ষী গাঙ্গুলী সতর্ক করে বলেন, যেহেতু শেখ হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার আধিপত্য সুসংহত করেছেন, ফলে সমালোচনামূলক কণ্ঠের ওপর নিপীড়ন আরো বাড়তে পারে। এটি টানা তৃতীয় নির্বাচন যেখানে বাংলাদেশীদের তাদের নেতা নির্বাচনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। উল্টো অনেকেই আশঙ্কা করছেন যে, সরকারের কোনো সমালোচনা হলে তার বিরুদ্ধে আরো দমন-পীড়ন নেমে আসবে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/805524