৫ জানুয়ারি ২০২৪, শুক্রবার, ১১:৪০

নির্বাচনকে ঘিরে মারাত্মক অচলাবস্থায় বাংলাদেশ

 

আগামী রোববার ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। কর্তৃত্ববাদ ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের মধ্যে অনেকটাই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ওপর সরকারের দমনপীড়ন ও বিরোধী দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের গ্রেপ্তার উত্তেজনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে এবং বিরোধীদের নির্বাচন বর্জনের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ‘বিয়োন্ড দ্য ইলেকশন: ওভারকামিং বাংলাদেশজ পলিটিক্যাল ডেডলক’ শীর্ষক দীর্ঘ এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে ব্রাসেলসভিত্তিক অলাভজনক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন থিংকট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ। 

তারা ওই প্রতিবেদনে আরও বলেছে, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নিজ তত্ত্বাবধানে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতায় তার দলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে বেপরোয়া কর্মকা- চালিয়েছেন। কিন্তু অর্থনৈতিক সংকট, বৈদেশিক সম্পর্কের পালাবদল এবং নতুন করে উজ্জীবিত বিরোধী দল আওয়ামী লীগের জন্য আরেকটি একতরফা নির্বাচন করা কঠিন করে তুলেছে। 

এতে আরও বলা হয়, বিরোধীদের নির্বাচন বর্জন মানে ভোটার উপস্থিতি সম্ভবত কম হতে যাচ্ছে। ব্যালটে তেমন বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প না থাকায় অসন্তুষ্ট বাংলাদেশীরা রাজপথে নামছে এবং রাজনৈতিক সহিংসতার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর মধ্যেও দাঙ্গাহাঙ্গামা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে করণীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে, যদিও জানুয়ারির নির্বাচন পিছিয়ে দিতে এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের উচিত ভোটের পর উভয়পক্ষ থেকে ছাড়ের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক উত্তেজনা কমাতে কাজ করা। বিদেশী অংশীদারদের উচিত তাদের এই লক্ষ্যে উৎসাহিত করা।

রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি মারাত্মক অচলাবস্থার মধ্যে আটকা পড়েছে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার এবং বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং নির্বাচন তদারকির জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান সরকার প্রত্যাখ্যান করার পর বর্তমান সরকারের প্রতি ক্রমবর্ধমান অসন্তোষের প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও তার মিত্ররা ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। এর পরিবর্তে শেখ হাসিনা তাকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করতে বিরোধীদের প্রচেষ্টাকে দুর্বল করতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা-পুলিশ, বিচার বিভাগ ও বেসামরিক প্রশাসনের ওপর থাকা নিজ নিয়ন্ত্রণকে ব্যবহার করে আসছেন। ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় একটি বড় সমাবেশের পর, যা সহিংসতায় রূপ নেয়, বিরোধী দলের বেশিরভাগ জ্যেষ্ঠ নেতাদের আটক করে সরকার এবং বিএনপিকে ভেঙে দেওয়াটা উদ্দেশ্য বলে মনে হচ্ছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব ছিল। এরপর আরেকটি ত্রুটিপূর্ণ ভোট বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্তেজনাকে বাড়িয়ে তুলবে। যদিও এখন ভোট স্থগিত করতে অনেক দেরি হয়ে গেছে, সংকটের সমাধান এবং আরও অস্থিতিশীলতা রোধ করার লক্ষ্যে সরকার ও বিরোধীদের উচিত ভোটের পর আলোচনা শুরু করা।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার তাদের বিরোধীদের দমিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘকালীন প্রশাসনে পরিণত হয়েছে। এমনকি ১৯৮০’র দশকের সামরিক শাসনকেও ছাড়িয়ে গেছে। দেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হিসেবে পাওয়া উত্তরাধিকার এবং একটি শক্তিশালী দলীয় কাঠামো থাকায় তিনি ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে তার সাফল্য গড়ে তুলেছেন। তার সরকার এক দশকেরও বেশি সময় শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উন্নত স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তার তদারকিতে নিরাপত্তা বাহিনী ২০০০-এর দশকে উত্থান হওয়া জিহাদি গোষ্ঠীগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে। পুরোনো মিত্র ভারতসহ বিদেশি সমর্থন, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেও, যারা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে’ আওয়ামী লীগকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনে করে এবং ২০১৭ সালে মিয়ানমারে দমনপীড়ন থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে গ্রহণে তাদের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয়- এ বিষয়গুলোও শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে।

রিপোর্টে আরও বলা হয়, কিন্তু যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার আওয়ামী লীগের সংকল্প বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে অবক্ষয় সাধন করেছে। এক দশকে শেখ হাসিনা আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, নিরাপত্তা সংস্থা ও নির্বাচনী কর্তৃপক্ষসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন; অনুগতদের এসব জায়গায় বসিয়েছেন। তার সরকার বিরোধীকর্মী, সুশীল সমাজের ব্যক্তিত্ব এবং সাংবাদিকদের ওপরও নিপীড়ন চালিয়ে আসছে। নিরাপত্তা বাহিনী কয়েকশ বলপূর্বক নিখোঁজ (গুম) এবং কয়েক হাজার বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিল। আরও অনেক কর্মীকে অন্তহীন মামলায় আদালতে দৌড়াতে হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নতুন কঠোর আইনে করা মামলাও।

আর বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের জন্য তেমনই গুরুত্বপূর্ণ ছিল ২০১১ সালের সংবিধানের সংশোধনীগুলো। এর মাধ্যমে ভোটের আগে তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনকে পথ করে দিতে নির্বাচিত দলীয় সরকারগুলোকে সরে দাঁড়ানোর প্রয়োজনীয় বিধানগুলো বাদ দেয়া হয়। এই সংশোধনীর কারণে বিরোধী দল ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে এবং ২০১৮ সালের ভোটে অংশ নেওয়ার সময় তারা কর্তৃপক্ষের হাতে ক্রমাগত দমনপীড়নের সম্মুখীন হয়। এ নির্বাচনে ব্যালটবাক্স ভর্তির ব্যাপক অভিযোগের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা ৯৬ শতাংশ আসনে জয়ী হয়। এই ভোট এভাবে সংসদের ভূমিকাকে শেখ হাসিনার নির্বাহী আদেশ কার্যত দ্বিমত ছাড়াই অনুমোদনে কুক্ষিগত করে ফেলে, যেখানে ২০১৪ সালে বিরোধী দলের নির্বাচন বয়কটের পর ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ ছিল।

রিপোর্টে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের এসব পদক্ষেপ বিরোধী দলকে জাগিয়ে তোলে। তারা ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে ঢাকা ও অন্য শহরগুলোতে অসংখ্য বড় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে, যা প্রায় এক দশকের মধ্যে প্রথম। তাদের ব্যর্থ করে দেয়ার সরকারি প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ২০২২ সালের ডিসেম্বর এবং ২০২৩ সালের জুলাই ও অক্টোবরে বড় সমাবেশগুলোতে লাখো সমর্থক অংশ নেন। এ সমাবেশগুলোর মধ্যে সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরের সমাবেশটি বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের পর পুলিশ টিয়ারগ্যাস ও স্টান গ্রেনেড দিয়ে উপস্থিত লোকজনকে ছত্রভঙ্গ করে দিলে আগেভাগেই শেষ হয়ে যায়। রাস্তায় সংঘর্ষের সময় বিএনপির সমর্থকরা একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। প্রতিক্রিয়ায় সরকার দলটির বেশিরভাগ জ্যেষ্ঠ নেতাকে গ্রেপ্তার করে এবং কারাগারে রিমান্ডে নেয়।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ তার প্রতিবেদনে আরও বলেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘনকে খতম করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসা সত্ত্বেও এই সরকার এই অধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগের মুখে, কখনো তা লঙ্ঘন হয়েছে রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশী মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে কমপক্ষে ৬০০ মানুষকে জোরপূর্বক গুমের জন্য দায়ী নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা। ভিকটিমদের মধ্যে এখনও প্রায় ১০০ জন নিখোঁজ। সবচেয়ে খারাপ যেটা তা হলো, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের অভিযোগ আছে র‌্যাবের মতো আইন প্রয়োগকারী এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে। তারা একে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ বলে চালিয়ে দেয়। ২০১৮ সালে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হিসেবে এমন ক্রসফায়ার হলেও অনেক সময় রাজনৈতিক বিরোধীরা ভিকটিমে পরিণত হয়েছেন। বিরোধী নেতাকর্মী, নাগরিক সমাজের সদস্য এবং সাংবাদিকদের দমনপীড়নে পুলিশ এবং ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ আইনি ব্যবস্থার ওপর নিয়ন্ত্রণকে ব্যবহার করেছে সরকার। সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে মানহানির ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনেকের কারাদ- হয়েছে। এসব ঘটনা আতঙ্কের আবহ সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছে। এর ফলে সেলফ-সেন্সরশিপ একটি আদর্শ হয়ে উঠেছে। এটা শুধু সংবাদমাধ্যম নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের জন্যও। 

গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের স্থান ‘ক্লোজড’ হিসেবে মূল্যায়ন করেছে অধিকার বিষয়ক গ্রুপ সিভিকাস মনিটর। এর মধ্য দিয়ে চীন, মিয়ানমার ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোর র‌্যাংকিংয়ে গেছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যাহত ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট ২০২৩ সালে এক জরিপে দেখতে পায় যে, জরিপে অংশ নেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা মাত্র ৪৪ ভাগ মানুষ মনে করেন দেশ সঠিক পথে এগুচ্ছে। ২০১৯ সালে এই হার ছিল শতকরা ৭৬ ভাগ। যদিও গণতান্ত্রিক অবস্থা নিয়ে অসন্তোষ ছিল, তবু ক্রমবর্ধমান পণ্যমূল্য উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রাথমিক কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বিরোধীদলের প্রতি দ্রুতগতিতে জনসমর্থন বৃদ্ধি পায়। ২০১৯ সালে এই হার ছিল শতকরা ৩৬ ভাগ। তা বেড়ে হয়েছে শতকরা ৬৩ ভাগ। এর ফলে বর্তমান নির্বাচন পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করা কঠিন বলে দেখতে পেয়েছে সরকার।

 

https://www.dailysangram.info/post/545221