১০ মে ২০১৭, বুধবার, ১০:০৯

বেসরকারি আইসিডি চলছে অনিয়মে

দক্ষ ব্যবস্থাপনায় নীতিমালার অভাব : চট্টগ্রাম বন্দর যতটা নির্ভার হওয়ার কথা তা হয়নি 

প্রধান চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের আমদানি-রফতানিমুখী পণ্য ওঠানামার কর্মকান্ড বৃদ্ধির সাথে সাথে বন্দর-নির্ভর খাত বেসরকারি স্থল কন্টেইনার ডিপোসমূহ (আইসিডি) চাহিদা ও চাপ সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। ব্যবসা প্রসার হলেও বেসরকারি আইসিডি বা অফডকে অনেক ক্ষেত্রে অনিয়মই নিয়মে পরিণত হয়েছে। বেসরকারি আইসিডিগুলোতে প্রতিদিন শত কোটি টাকা মূল্যের শিল্প কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, ভোগ্যপণ্য প্রভৃতি হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে। অথচ আধুনিক যুগোপযোগী ও সুদক্ষ ব্যবস্থাপনায় নেই সুষ্ঠু নীতিমালা। এই সুবাদে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোর (আইসিডি) অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে আমদানি ও রফতানিকারক, ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তাদের নানামুখী হয়রানি দিন দিন বেড়েই চলেছে। চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা আইসিডি বা অফডক সঠিক ব্যবস্থাপনার ধারায় আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের রয়েছে সমন্বয়ের অভাব। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবে কার্যত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে আইসিডি খাত। চট্টগ্রাম মহানগরীর জনবহুল ও কর্মব্যস্ত এলাকাগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা বেসরকারি আইসিডিসমূহকে অন্যত্র সুবিধাজনক স্থানে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় প্রায় দু’মাস আগে। অথচ তা বাস্তবায়নের আলামত দেখা যাচ্ছে না। আইসিডির বিশৃঙ্খল অবস্থায় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা অতিষ্ঠ হলেও এর কোন প্রতিকার মিলছে না। ‘উপরে’ সবকিছু ‘ম্যানেজ’ করেই চলছে আইসিডির তাবৎ অনিয়ম, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনা। সময়মতো শিল্পের কাঁচামাল খালাসে গড়িমসি, হ্যান্ডলিং চার্জ যথেচ্ছহারে উসুলের অভিযোগ অনেক আইসিডিতে।
আমদানি-রফতানি কন্টেইনারবাহী হরেক ধরনের পণ্যসামগ্রী হ্যান্ডলিং ও মজুদ করছে বেসরকারি আইসিডিসমূহ। শিপিং বাণিজ্যের চাহিদা ও চাপ যতই বাড়ছে আইসিডিতে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের কর্মব্যস্ততাও সমানতালে বৃদ্ধি পাচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরে গতবছর পণ্য ওঠানামা বেড়ে গিয়ে ৭ কোটি ৭২ লাখ ৫৫ হাজার ৭৩১ মেট্রিক টনে এবং কন্টেইনার ২৩ লাখ ৪৬ হাজার ৯০৯ টিইইউএস-এ দাঁড়ায়। কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ, সার্বিকভাবে পণ্য হ্যান্ডলিং প্রবৃদ্ধি ১৭ শতাংশ। এর পেছনে মূল কারণটি হচ্ছে সমুদ্র পথে পণ্য পরিবহনে তুলনামূলক ব্যয় আকাশ-সড়ক বা রেলপথের চেয়ে অনেক কম। পৃথিবীর সব আধুনিক বন্দরে বর্তমান সময়ে বন্দরের সংরক্ষিত বা অপারেশনাল এলাকার ভেতরে বিশেষত কন্টেইনার খোলা-বাঁধা, মজুদ (স্টাফিং-আনস্টাফিং, স্টেকিং) করা হয় না। এর বিকল্পই হচ্ছে বেসরকারি আইসিডি বা অফডক।
তবে সমন্বিত নীতিমালার অভাবে বাংলাদেশে সুষ্ঠু অফডক ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। প্রধান বন্দরকে ঘিরে চট্টগ্রামে বেসরকারি আইসিডি ব্যবসা ক্রমাগত বাড়লেও এর সুষ্ঠু পরিচালনায় অনিয়ম-অদক্ষতার অভিযোগ প্রায়ই উঠছে। আইসিডিসমূহে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং, মজুদ-স্টেকিং ও পরিবহনের উপযোগী ভারী যান্ত্রিক সরঞ্জামের অভাব প্রকট। আবার কোন কোন আইসডিকে ঘিরে সুকৌশলে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে দুর্নীতিবাজরা। চট্টগ্রাম বন্দর-সুবিধার ফলে বন্দরনগরী, শহরতলী, কাছাকাছি সীতাকুÐে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোর (আইসিডি) সংখ্যা এখন ৩২টি। অথচ এসব আইসিডির যান্ত্রিক ও অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা তেমন বৃদ্ধি পায়নি। অফডক পরিচালনায় পদে পদে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব। আইসিডিগুলোতে বিরাজ করছে সমস্যা-সংকটের বহর। কন্টেইনার হ্যান্ডলিং উপযোগী হালকা ও ভারী ইকুইপমেন্ট খুবই অপ্রতুল। এসব কারণে আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে পড়ছে বিরূপ প্রভাব।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উপরোক্ত অনিয়ম, অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নির্দেশনা ও শর্ত পরিপূরণ করছেন না আইসিডির মালিকরা। জনবহুল এলাকায় যেনতেন প্রকারে আইসিডি স্থাপন করে নিত্য যানজটসহ নানামুখী জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হচ্ছে। বেসরকারি আইসিডি তথা অফডককে একটি শিল্পখাত হিসেবে বিকাশিত করতে সার্বিক গ্রহণযোগ্য একটি নীতিমালা তৈরির তাগিদ দিয়েছেন শিল্পোদ্যোক্তা ও আমদানি-রফতানিকারকগণ। তারা বলেছেন, আইসিডি খাতে বাড়ছে প্রতিযোগিতা। রফতানিমুখী প্রচলিত ও অপ্রচলিত পণ্য এবং গার্মেন্ট শিল্পোদ্যোক্তারা অফডক সুবিধার দিকে বেশি হারে আকৃষ্ট হচ্ছেন। তবে খাতটি বন্দরের গতি ও দক্ষতার উন্নতিতে যতটা ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে তা হয়নি। প্রধান বন্দর প্রত্যাশিত হারে ‘নির্ভার’ হয়নি। বছরের বেশিরভাগ সময়জুড়ে বন্দরে কন্টেইনার ও পণ্যের জট তার অন্যতম প্রমাণ। সমস্যা-সঙ্কট ও সীমাবদ্ধতা কাটানো গেলে বেসরকারি আইসিডি খাত দেশে বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়ানোর ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। এ খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয়ও বেড়ে যাবে। তবে এখনও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
বেসরকারি আইসিডিগুলোতে বিভিন্ন ধরনের ভারী, মাঝারি ও হালকা ব্যবহার্য যান্ত্রিক সাজ-সরঞ্জাম (ইকুইপমেন্ট) চাহিদার তুলনায় অনেক অপ্রতুল। অধিকাংশ যন্ত্রপাতি সেকেলে, অকেজো, লক্কর-ঝক্কর ও বিকল অবস্থায় রয়েছে। কন্টেইনার ওঠানামা, স্থানান্তর, মজুদের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্ট্র্যাডেল ক্যারিয়ার, রীচ স্টেকার, ফর্ক লিফট, স্প্রেডার, ফর্ক, কন্টেইনার মুভার, এম্পটি হ্যান্ডলার, টার্মিনাল ট্রাক্টর, ট্রেইলর, মোবাইল ক্রেন, লগ হ্যান্ডলার, লো-মাস্ট ফর্ক লিফট, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাক্টর, হেভি ট্রেইলর ও লাইট ট্রেইলর রয়েছে অপর্যাপ্ত। এতে করে কন্টেইনার পণ্য ওঠানামায় সময় ও খরচ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অফডকসমূহকে ঘিরে বন্দরনগরীর বিভিন্ন এলাকায় যানজট সমস্যাও জটিল আকার ধারণ করেছে। বন্দর ব্যবহারকারী তথা স্টেক হোল্ডাররা বেসরকারি আইসিডি পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি সুষ্ঠু ও সমন্বিত নীতিমালা অনুসরণের ব্যাপারে জোরালো তাগিদ দিয়েছেন।

 

https://www.dailyinqilab.com/article/78882/