২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৭:২১

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে তিন দিন ধরে অচলাবস্থা

বহিরাগতদের সাথে আন্দোলনে শরিক কর্মকর্তারাও

 

বাংলাদেশ অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি কাউন্সিল আইন বাতিলের দাবিতে তিন দিন ধরে রাজধানীর প্রাণিসম্পদ অধিদফতর অবরুদ্ধ রেখে আন্দোলন করছে বাংলাদেশ ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশনের (বিভিএ)। গতকাল মহাপরিচালকের ভবনের ভেতরে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় তারা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশীদের শাস্তির দাবিতে নানা স্লোগান দেন। বহিরাগতদের সাথে আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন অধিদফতরেরও বেশ কিছু কর্মকর্তা। বিশৃঙ্খল অবস্থার কারণে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে তৈরি হয়েছে অচলাবস্থা। ভয় ও আতঙ্কে সেবা প্রার্থীরা প্রবেশ করতে পারছেন না। আতঙ্কের মধ্যে কেটেছে অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রিতে পাশ করা কর্মকর্তারা। শৃঙ্খলা ফেরাতে অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ডা: এমদাদুল হক তালুকদারকে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি; বরং আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে কথা বলতে ফোন দিলেও রিসিভ করেননি ডা: এমদাদুল হক তালুকদার।

মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশীদ আগামী ১ জানুয়ারি অবসরে যাবেন। অধীনস্থ সংস্থার কর্মকর্তারা তারই অপসারণ এমনকি অবসরোত্তর বিচারের আন্দোলনের কর্মসূচিতে যোগদান করছেন। চাকরির শেষ সময় হওয়ায় এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা সচিব নিচ্ছেন না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। তবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় পুরো বিষয়টিকে সুবিধাভোগী একটি গোষ্ঠীর ইন্ধন ও উসকানি হিসেবে দেখছে বলে জানা গেছে।

গত তিন দিনের আন্দোলনে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের অন্তত ১০ কর্মকর্তাকে সক্রিয় দেখা যায়। ইতোমধ্যে সমাবেশে অংশ নেয়া কর্মকর্তাদের চিহ্নিতও করেছে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয়ের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এভাবে মাঠে নামতে পারেন না। তারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে কর্মস্থলের বাইরে গিয়ে সভা-সমাবেশ করছেন, উসকানিমূলক বক্তব্য রাখছেন, যা সরকারি কর্মচারী আচরণবিধির পরিপন্থী।

ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশন অনুমতি নিয়ে এ সমাবেশ করছে কি না- এমন প্রশ্নে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের প্রশাসন শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, আমি যত দূর জানি এখনো এ-সংক্রান্ত কোনো অনুমতি তারা নেয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পশু পালন ও জাত উন্নয়নে অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি ডিগ্রিধারীদের বড় অবদান আছে। কিন্তু তাদের জন্য নেই কোনো কাউন্সিল। অথচ প্রাণিসম্পদ খাতে ভেটেরিনারি কাউন্সিল আছে। এ কারণে গত ১৮ ডিসেম্বর সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় বাংলাদেশ অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি কাউন্সিল আইন প্রণয়নে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। নিরাপদ প্রাণিজাত খাদ্য উৎপাদন, রফতানি বাড়ানো, পশু পালনের সাথে জড়িতদের আইনি শূরা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে এ আইনকে এ খাতসংশ্লিষ্ট অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন। এতে একচেটিয়া আধিপত্য খর্বের আশঙ্কা করছেন আন্দোলনকারীরা। তারা আন্দোলনে ভুল বুঝিয়ে উসকানি দিচ্ছেন বলে অভিযোগ। বিশেষ করে বিভিএর মহাসচিব মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান মোল্লা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে নিজের শক্তিমত্তা আরো পাকাপোক্ত করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

হাবিবুর রহমান মোল্লার বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন সংগঠনের পরিচয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে টেন্ডার, নিয়োগ, বদলি ও তদবির বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক খামারি বলেন, হাবিবুর রহমান মোল্লা তার দুই প্রতিষ্ঠান এথেনা এন্টারপ্রাইজ ও হেসপার ফার্মার নামে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে বাণিজ্য করছেন। তার প্রতিষ্ঠানের সরবরাহকৃত কৃমিনাশক, ভিটামিন, অ্যান্টিবায়োটিকসহ নানা ওষুধ খুবই নিম্নমানের। এ বিষয়ে বারবার অভিযোগ করেও লাভ হয়নি। এতে দেশের প্রাণিসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে এবং প্রান্তিক খামারিরা প্রতারিত হচ্ছেন। মাঠ থেকে তার ওষুধ সংগ্রহ করে নমুনা পরীক্ষা করলে প্রকৃত তথ্য উদঘাটিত হবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, হাবিবুর রহমান মোল্লা বিভিন্ন প্রকল্প থেকে সুবিধা আদায়ে মরিয়া হয়ে থাকেন। স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটলেই কর্মকর্তাদের সাথে অসদাচরণ করেন। কয়েক মাস আগে এলডিডিপি প্রকল্প থেকে সুবিধা না পেয়ে তার অনুসারীদের দিয়ে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করেন।

অভিযোগ রয়েছে, একসময় প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ে লাল রঙের একটি ভবন ছিল। দীর্ঘ দিন ভবনটি হাবিবুর রহমানসহ ভেটেরিনারি অ্যাসোসিয়েশনের কয়েকজন নেতার দখলে ছিল। ভবনে রুম ভাড়া দিয়ে চলেছে বাণিজ্য, খালি জায়গায় করা হয় রেস্তোরাঁ।

এ বিষয়ে গত ২০ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন। গত তিন দিন প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে আন্দোলন প্রসঙ্গে ড. হাবিবুর রহমান মোল্লা গণমাধ্যমকে বলেন, এখানে আমাদের কোনো স্বার্থ নেই। আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছি। কোনো বিশৃঙ্খলা হচ্ছে না। আমরা প্রাণিসম্পদ খাতকে রায় মাঠে নেমেছি, কিন্তু মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিনিধি এখনো আমাদের সাথে দেখা করেননি।

বাংলাদেশ অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বাহা) সভাপতি ও সাবেক সচিব জাকির হোসেন আকন্দ বলেন, সারা পৃথিবীতে দু’টি আলাদা আইন আছে। এখানে দু’টি আইন হলে একটি গোষ্ঠীর দাপট কমে যাবে। ফলে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছেন।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশীদ বলেন, হাবিবুর রহমান মোল্লা বেপরোয়া। দীর্ঘ দিন প্রাণিসম্পদ অধিদফতরে লাল বিল্ডিং তাদের দখলে ছিল। সেটা ভাঙতে বাধা দিয়েছে। কিন্তু আমরা ভেঙেছি। সেখানে নতুন ভবন হবে। হাবিব মোল্লাসহ তাদের অনেকেই টেন্ডারবাজির সাথে জড়িত বলেও অভিযোগ সচিবের। তিনি বলেন, কিছু দিন আগে আমরা যখন ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড গঠনের উদ্যোগ নিই, তখনো এটি না করতে বাধা এসেছিল। কিন্তু আমরা করেছি। সামনে আমরা পোলট্রি বোর্ডও করব। ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি, দু’টি আলাদা সাবজেক্ট। যারা অ্যানিম্যাল হাজবেন্ড্রি গ্র্যাজুয়েট তারা পোলট্রি উৎপাদন, জাত উন্নয়ন, পুষ্টি উন্নয়নের সাথে সম্পৃক্ত। আর ভেটেরিনারিয়ান গ্র্যাজুয়েটরা পশু চিকিৎসা করবেন। নতুন আইনের মাধ্যমে দু’টি বিষয় আলাদা হবে।

 

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/802191