২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ২:১৫

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের স্বপ্ন এবং বাঁকবদল

-হারুন ইবনে শাহাদাত

 

[গতকালের পর]
সত্যি কী ইউটোপিয়া : নূহ-উল-আলম লেনিন তার মতের পক্ষে যুক্তি দিয়ে লিখেছেন, ‘কিন্তু এই একই ম্যানিফেস্টোতেই আবার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ঘোষিত হয়। সব ধর্মের মানুষের সমান অধিকারের ঘোষণাও দেয়া হয়।
নবগঠিত আওয়ামী লীগ নেতাদের ধারণা ছিল ব্রিটিশ কমনওয়েলথের সদস্য থাকা মানে দেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জিত না হওয়া। সে জন্যই কমনওয়েলথের প্রশ্নে সম্পর্কোচ্ছেদের ঘোষণা দেয়া হয়। অন্য দিকে কাশ্মির ইস্যুটি তখন পাকিস্তানের উভয় অংশের মানুষের কাছে খুবই আবেগ ও স্পর্শকাতর বিষয় ছিল। আওয়ামী লীগ তাই আগ বাড়িয়ে তিন মাসের আল্টিমেটাম দিয়ে জাতিসঙ্ঘ ত্যাগের হুমকি দেয়। এসব দাবিই ছিল তখনকার বাস্তবতায় জনগণের মনোস্তত্ত্বকে তুষ্ট করার কৌশল।

তবে ম্যানিফেস্টোতে ভূমি সংস্কার ও বিনাখেসারতে জমিদারি উৎখাতের দাবিটি যথার্থ ছিল। কিন্তু যৌথ খামার ও জমির সমবণ্টন এবং সব শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ ও শ্রমিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কারখানা পরিচালনার দাবিগুলো ছিল কিছুটা স্বপ্ন-কল্পনা বা ইউটোপিয়া। আমার মতে, আওয়ামী লীগের জন্মলগ্নের প্রথম সম্মেলনের ১২-দফা মূল দাবিই ছিল এই দলটির গড়ে ওঠা ও বিকাশধারার মূল ভিত্তি।’ এই ভিত্তি যে মূলত ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কৌশল বৈ অন্য কিছু ছিল না, তা হয় তো বা শামসুল হকের মতো নেতারা বুঝতে পারেননি। তারা চেয়েছিলেন, এর বাস্তবায়ন। জনগণের সামনে কোনো স্বপ্ন-কল্পনা বা ইউটোপিয়া হিসেবে তা উপস্থাপন তার লক্ষ্য ছিল না। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের বক্তব্য হলো, ‘আওয়ামী লীগের প্রথম ঘোষণাপত্রের তাৎপর্য বুঝতে হলে প্রতিষ্ঠালগ্নের পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবেশ, জনগণের মনস্তত্ত্ব এবং চেতনার স্তর এবং প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যেও ভাবাদর্শগত টানাপড়েন সম্পর্কে ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রথম ঘোষণাপত্রে ঘোষিত খিলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা, ধর্মাশ্রিত রাজনৈতিক সেøাগানের আড়ালে বাঙালির অধিকার এবং এমন কী ‘পূর্ণ স্বাধীন ও সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসঙ্ঘ’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বোঝা যাবে না। আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, মুসলিম লীগের গর্ভেই ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’-এর জন্ম। ১৯৪৯ সালে যারা স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠন করেন, তারা প্রায় সবাই ছিলেন ১৯৪৭-এর আগের নিখিল ভারত তথা অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সদস্য। দেশ ভাগের আগেই, পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখনই বেঙ্গল মুসলিম লীগে রক্ষণশীল ও উদারনীতির অনুসারী দু’টি অংশের মধ্যে সুস্পষ্ট বিভাজন সৃষ্টি হয়েছিল।’

অর্থাৎ এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আদর্শ বাদ দিয়ে ভারতকে খুশি করতে ধর্মনিরক্ষেতার নামে ধর্মহীনতা তথা ইসলামী দর্শনকে রাজনীতি থেকে উৎখাত করাকেই কি এখানে উদারনীতি বলা হচ্ছে? আসলে কি এর নাম উদারতা? প্রতিবেশী ভারত সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু সেই দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) কট্টরপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী দর্শনকে তাদের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে। অথচ সব জাতি-ধর্ম বর্ণের মানুষের অধিকার রক্ষার গ্যারান্টি দেয় ইসলাম। এখানে কট্টরপন্থার কোনো স্থান নেই। উদারতার বিচারে ঐতিহাসিকভাবে পরীক্ষিত আদর্শ ইসলাম, তার পরও কেন উদারনীতির নামে এই বিচ্যুতি? এই বিচ্যুতি মেনে নিতে পারেনি বলেই কি আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক আজো নিখোঁজ, তার কবরেরও কোনো সন্ধান কারো কাছে নেই?

অথচ তিনি ছিলেন দেশ ও জনগণের জন্য সব কিছু উজাড় করে দেয়া এক মহান নেতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শুরুর দিকে প্রায়ই উল্লিøখিত হয়েছে এ মহৎ রাজনীতিপ্রাণ মানুষটির নাম। অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে শেখ মুজিব বারবার স্মরণ করেছেন তাকে। বায়ান্নর উত্তাল ভাষা আন্দোলনের সময়ে রাজবন্দী হিসেবে দীর্ঘ সময় তাকে কাটাতে হয়েছে জেলের অভ্যন্তরে। সেই সময় শামসুল হকের অনুপস্থিতি অনুভব করেছেন শেখ মুজিব। তিনি তার লেখায় শামসুল হককে নিয়ে প্রতি মুহূর্তের উদ্বেগের কথা উল্লেøখ করেছেন। শেখ মুজিব লিখেছেন, ‘পাকিস্তান আন্দোলনে হক সাহেবের অবদানে যারা এখন ক্ষমতায় আছেন, তাদের চেয়েও অনেক বেশি ছিল তার অবদান। বাংলাদেশের যে কয়েকজন কর্মী সর্বস্ব দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলন করেছেন তাদের মধ্যে শামসুুল হক সাহেবকে সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মী বললে বোধ হয় অন্যায় হবে না। ১৯৪৩ সাল থেকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠানকে জমিদার, নবাবদের দালানের কোঠা থেকে বের করে জনগণের কুটিরে যারা নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে হক সাহেব ছিলেন অন্যতম। অথচ স্বাধীনতার সাত দিনের মাথায়ই তিনি মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কৃত হলেন। একেই বলে মন্দ কপাল’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা-২৩৬)।

তিনি আরো লিখেছেন, ‘১৯৪৯ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে অথবা এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে টাঙ্গাইলে উপনির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। আমরা ঠিক করলাম, শামসুল হক সাহেবকে অনুরোধ করব মুসলিম লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়তে। শামসুল হক সাহেব শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন, কিন্তু টাকা পাওয়া যাবে কোথায়? হক সাহেবেরও টাকা নেই, আর আমাদেরও টাকা নেই। তবু যেই কথা সেই কাজ। শামসুল হক সাহেব টাঙ্গাইলে চলে গেলেন, আমরা যে যা পারি জোগাড় করতে চেষ্টা করলাম। কয়েক শত টাকার বেশি জোগাড় করা সম্ভব হয়ে উঠল না। ছাত্র ও কর্মীরা ঘড়ি, কলম বিক্রি করেও কিছু টাকা দিয়েছিল’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, পৃষ্ঠা-১১৫)।

দেশ ও জনগণের জন্য রাজনীতির সেই মিশন ও ভিশন কোথায় হারিয়ে গেছে? গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও মানবতার মুক্তির জন্য ঘড়ি, কলম বিক্রি করেও কিছু টাকা দেয়া সেই তরুণ দেশপ্রেমিক ছাত্রনেতারা কেন আর এগিয়ে আসছেন না? শামসুল হকদের হারিয়ে যাওয়ার ইতিবৃত্ত খুঁজতে গেলে এমন অনেক প্রশ্ন বারবার সামনে আসে এবং আসবেই। শামসুল হকের রাজনৈতিক দর্শন বুঝতে হলে তার রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণের এবং তার লেখা বইগুলোও পড়তে হবে। বিশেষ করে, তার লেখা সাড়া জাগানো গ্রন্থ, ‘বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম’ গ্রন্থটি গবেষকের মন নিয়ে পড়তে হবে।

নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এবং পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ : ইসলামী আদর্শ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে ‘পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলেই হয় তো প্রথম সভাপতি করা হয়েছিল একজন মওলানাকে। প্রথম সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর পর যিনি সভাপতি হয়েছিলেন তিনিও ছিলেন একজন মাওলানা। তার নাম মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ।

১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার টিকাটুলির রোজ গার্ডেন প্রাঙ্গণে মুসলিম লীগের গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণ দেন মওলানা ভাসানী। ওই সম্মেলন থেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে ‘পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল। দলের উদ্বোধনী অধিবেশনে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকও উপস্থিত ছিলেন। কথা ছিল তিনিও আওয়ামী লীগে যোগদান করবেন। কিন্তু পরে তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। সম্মেলনে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। মওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও শামসুল হককে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন এটি ছিল মূলত তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশকেন্দ্রিক একটি রাজনৈতিক দল। অনেকের কাছেই আজ অজানা, ‘পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগ এবং নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নামক সংগঠন দু’টির সম্পর্ক ছিল কখনো পৃথক, কখনো এক। কৌশলগত কারণে গঠিত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ আলাদা সত্তা নিয়ে যাত্রা করে। ১৯৭১ সালে তা বিলুপ্ত হয়ে যায় ঐতিহাসিক কারণেই। পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার আগে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে (বর্তমান খাইবার পাখতুন প্রদেশ) গঠিত হয়েছিল মানকি শরিফের পীর সাহেবের সংগঠন। এ ধরনের নামকরণের ক্ষেত্রে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনুপ্রেরণাই ছিল মুখ্য। তার প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে পীর সাহেব এই দল গঠন করেছিলেন। ঢাকা হাইকোর্টে এক মামলা পরিচালনার জন্য সোহরাওয়ার্দী যখন ঢাকায় আসেন, তখন পীর সাহেবের অনুকরণে সংগঠনের নাম আওয়ামী মুসলিম লীগ রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তার আগে ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে সোহরাওয়ার্দী পশ্চিমবঙ্গে বাস্তুহারা হয়ে পাকিস্তান আসেন। কিন্তু পূর্ববঙ্গে শাসকগোষ্ঠীতে ঠাঁই না হওয়ায় লাহোরে যান এবং পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। সোহরাওয়ার্দী লাহোরে নবাব ইফতিখার হোসেনের সহায়তায় গঠন করেন ‘জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ’। সিন্ধু প্রদেশেও গঠিত হয় জিন্নাহ আওয়ামী লীগ। এর ক’দিন পর ২৩ জুন ভাসানীকে সামনে রেখে ঢাকায় গঠিত হয় পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। অবশ্য তত দিনে সোহরাওয়ার্দী হয়ে উঠেছেন পাকিস্তানের উভয় অংশের প্রধান সংযোগ সেতু। জিন্নাহর মৃত্যুর পর মুসলিম লীগের নেতৃত্বের কোন্দল তীব্র হতে থাকলে দলত্যাগ শুরু করে নেতাকর্মীদের একটি অংশ আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৪৯ সালের নভেম্বরে পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি চৌধুরী খালেকুজ্জামানকে লেখা এক পত্রে সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগকে একটি ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে পুনর্গঠিত করার আশা প্রকাশ করেছিলেন। অন্যথায় তারা তাদের নিজস্ব দল গড়ে তুলবেন বলে জানান। মুসলিম লীগের সংস্কার সাধনে ব্যর্থ হওয়ায় সোহরাওয়ার্দীর একটি জাতীয় বিরোধী দল গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেন। তার উৎসাহ ও নেপথ্য সহযোগিতায় পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলেও, গোড়ার দিকে তিনি দলটির সদস্য ছিলেন না। তিনি ছিলেন তখনো পাকিস্তান গণপরিষদে মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য। বিরোধিতার কারণেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে সোহরাওয়ার্দীর গণপরিষদের সদস্যপদ বাতিল করেন। তিনি যখন জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন তখন জিন্নাহর বোন ফাতিমা জিন্নাহ তাকে সমর্থন করেন। এই সংগঠনটি পৃথকভাবে কাজ চালায় পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্য না গড়েই। একপর্যায়ে সোহরাওয়ার্দী জিন্নাহ লীগ বিলুপ্ত করেন। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক কর্মীদের এক সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দীকে সভাপতি ও একমাত্র সংগঠক করে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কোনো অংশ হিসেবে গঠিত হয়নি। কিংবা ১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে বিলুপ্ত নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী লীগেরও অংশে পরিণত হয়নি। তবে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানের করাচির অফিসকে গণ্য করা হতো কেন্দ্রীয় অফিস। অপর দিকে, প্রাদেশিক শাখা হিসেবে গণ্য করা হতো পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগকে। আওয়ামী লীগ পূর্ববঙ্গে দুই বছর ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল। কৌশলগতভাবে ১৯৫১ পরবর্তী সময়ে পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের ভিন্নমতাবলম্বী মুসলিম লীগারদের দ্বারা গঠিত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক শাখার পরিচয় বহন শুরু করে। পূর্ববাংলার রাজনীতি থেকে সোহরাওয়ার্দীকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও যখন পূর্ববাংলায় অসন্তোষ ঘনীভূত হচ্ছিল, তখন ১৯৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের সিদ্ধান্তে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ও নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগকে অধিভুক্ত করা হয়। তবে এই অধিভুক্তি ছিল শর্তসাপেক্ষে। পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের নামকরণ, ম্যানিফেস্টো ও কর্মসূচি থেকে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। সম্মেলনে ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্বপাকিস্তান লীগের একটি প্রতিনিধিদল যোগ দিয়েছিল। নীতিগত মতভেদের কারণে জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগের সংগঠক নওয়াব ইফতিখার হুসাইন খানকে সম্মেলনে বহিষ্কার করা হয়। ভাসানী বলেন, জিন্নাহ লীগের সাথে কোনোরূপ বিরোধ দেখা দিলে পূর্বপাকিস্তান লীগ দলের কর্মসূচি ও ম্যানিফেস্টোর প্রতি অবিচল থাকবে। যদি কেউ আমাদের কর্মসূচিতে নাক গলাতে আসে তাহলে কেন্দ্রীয় পার্টির সাথে আমাদের অধিভুক্তির প্রশ্নটি পুনর্বিবেচনা করতে আমরা বাধ্য হবো। সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত হয় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কমিটি। প্রথম সাংগঠনিক কমিটির আহ্বায়ক হন সোহরাওয়ার্দী। পরে পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সেক্রেটারি জেনারেল হন মাহমুদুল হক ওসমানী’ ( সূত্র : দৈনিক জনকণ্ঠ, ২২ জুন ২০১৫)।
আওয়ামী লীগের আদি ও আসল উৎস খুঁজতে গিয়ে যে সত্য বের হয়ে এলো, তা হলো সংগঠনটির সূচনা একজন পীর সাহেবের হাতে। পকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের (বর্তমান খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশ) মানকি পীর সাহেবের দরবার শরিফ থেকে। উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে মানকি পীর সাহেবের ভূমিকা আজো ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। তিনি দেশ বিভাগের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন খেলাফতের আদর্শে একটি কল্যাণরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়েই। তবে কেন আওয়ামী লীগের এই বাঁকবদল।

কেন এই বাঁকবদল : আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন মনে করেন, ‘ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে প্রথমে ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগের নামের সাথে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া তথা আওয়ামী লীগকে ধর্মনিরপেক্ষ দলে রূপান্তরিত করার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। ৫৭ সদস্যের ওয়ার্কিং কমিটির ২৭ জন সদস্য খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। অবশ্য ১৯৫৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ সেক্যুলার দলে পরিণত হয়। এই সময়ে আরো দু’টি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা সংঘটিত হয়। ১৯৫৭ সালের ৭ ও ৮ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কাগমারীতে আওয়ামী লীগের বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উপস্থিত ছিলেন। মওলানা ভাসানী পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি। সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। কাগমারী সম্মেলনে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে অত্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে উত্থাপিত হয়। কিন্তু এই সম্মেলনেই মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে তথা পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগের মধ্যে প্রধানত পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে চূড়ান্ত মতপার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। কাগমারী সম্মেলনের এক মাসের মধ্যেই মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করেন। ১৯৫৭ সালের ১৩ ও ১৪ জুন ঢাকায় আরমানিটোলা নিউ পিকচার হাউজে পূর্বপাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ভাসানী দল ত্যাগ করলেও আওয়ামী লীগ তাকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সভাপতির পদে বহাল রেখেছিল। কিন্তু ভাসানী সাহেব তখন নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার উদ্যোগ নেন। ১৯৫৭ সালের ২৫ ও ২৬ জুলাই এক নিখিল পাকিস্তানভিত্তিক সম্মেলনের মাধ্যমে মওলানা ভাসানী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গঠন করেন।’ বিভাজন ও বাঁকবদলের পথপরিক্রমার শুরু সেই থেকেই যে দিন ওয়ার্কিং কমিটির ২৭ জন সদস্যের মতামত উপেক্ষা করা হয়েছে। নাম থেকে শুধু মুসলিম শব্দ বাদ নয়, দলটি ধর্মনিরপেক্ষতাবাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছে।

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/802065