৯ মে ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৩৪

থামছে না শিশু ও নারী নির্যাতন

গত ৫ বছরে প্রতিদিন গড়ে ৮ জন শিশু এবং ৩ জন নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন : আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে বিচার প্রার্থীরা আইনের আশ্রয় নেয়ার প্রাথমিক পর্যায় থেকেই মানবাধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন

একের পর এক ঘটছে ধর্ষণ-নির্যাতন। নতুন উপসর্গ নৃসংসতা। নারীর প্রতি মাত্রা ছাড়া নির্মমতায় হতবাক বিবেকবান মানুষ। ধর্ষণের শিকার হচ্ছে ৪ বছরের শিশু থেকে কিশোরীরা। শুধু তাই নয় ধর্ষণের পর পাশবিক নির্যাতন করে হত্যা করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনেই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে এ ধরণের নির্মম নিষ্ঠুরতা। আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে শিশু ও নারী অপহরণ,ধর্ষণ এবং খুনের ঘটনা। সংশ্লিষ্ট সুত্র মতে,গত ৫ বছরে প্রতিদিন গড়ে ৮ জন শিশু এবং ৩ জন নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন । ১০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশের ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এছাড়া আইনি সীমাবদ্ধতা, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, লোকলজ্জা এবং পুলিশ ও সমাজের প্রভাবশালীদের অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে বিচার প্রার্থীরা আইনের আশ্রয় নেয়ার প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
পুলিশ সদর দপ্তরসূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলার সংখ্যা ২৬ হাজার ৯৮৭টি। এসব মামলার ৬০ শতাংশেই চার্জশিট দেয়া হয়েছে। চুড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া ছাড়াও বাকিগুলো তদন্তাধীন বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। এছাড়া ২০১৫ সালে দেশে নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২১ হাজার ২২০টি। এসব মামলার ৮০ শতাংশ চার্জসিট দেয়া হয়েছে।
ডিএমপি সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে রাজধানীতে নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ৮৯৫টি। জিডি হয়েছে ১ হাজার ৪৮৬টি। ২০১৫ সালে মামলার সংখ্যা ছিল ৯৮০টি। এ সংক্রান্ত জিডি হয়েছে ৭০০ টি।
শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য মতে, গত ৫ বছরে সারাদেশে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে প্রায় ১৫ হাজার। এরমধ্যে শুধু অপহরণই হয়েছে ৭৪৪ জন শিশু। একইভাবে সহিংসতার শিকার হচেছন নারীরাও। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার হিসেবে ২০১২ থেকে গত মাস পর্যন্ত নারীর উপর সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৬ হাজার। এ সময়ে অপরহরণের শিকার ২১৮ জন নারী।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম ও মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত ৫ বছরে প্রতিদিন গড়ে ৮ জন শিশু এবং ৩ জন নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে পারিবারিক কলহে ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ তো আছেই, সেই সঙ্গে ঘটছে হত্যা ও অপহরণের মতো ঘটনাও। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, সহিংসতা বন্ধে বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপনের পাশাপাশি, পরিবার ও সমাজকে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। সাধারণত বয়স্কদের দ্ব›েদ্বর বলি হচ্ছে শিশুরা। অপহরণ, ধর্ষণ, খুনসহ নানাবিধ সহিংসতা বন্ধে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবকেও দায়ী করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা।
এ ব্যপারে জানতে চাইলে আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলেন, শিশু ও নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ মামলার চার্জসিট দ্রæত প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অপরাধীরা যাতে কোন ধরণের ছাড় না পায় সে বিষয়টি বিবেচনায় রেখে তদন্ত সাপেক্ষে সঠিক প্রতিবেদন দিতে বলা আছে। কেউ অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার (বিএমবিএস) মিডিয়া এন্ড কমিউনিকেশননের তথ্য মতে, ১০ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই দেশের ৫ দশমিক ১৭ শতাংশ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বিবাহিত নারীদের ৮০ দশমিক ২ ভাগ জীবনে কোনো না কোনো সময়ে আর্থিক, শারীরিক কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার হন। ২০১১ সালে এই হার ছিল ৮৭ ভাগ।
গত এক মাসে দেশে ধর্ষিত হয়েছে ২৪৫ নারী ও শিশু। এর মধ্যে ৮৭টি শিশু। গণধর্ষণের শিকার হন ৩৫ নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৭ জনকে। পারিবারিক কলহে আপনজনের হাতে খুন হন ১২৬ নারী। যৌতুকের বলি ২৩ নারী, নির্যাতন করা হয় ৮৫ জনকে। এসিড সন্ত্রাসের শিকার হন ৫ জন। খুন হয় কোমলমতি ১৫টি শিশু।
কেরানীগঞ্জের ৫ম শ্রেণীর শিশু আবদুল্লাহকে নিজের দাদার আপন ছোট ভাই অর্থের লোভে অপহরণ কোরে মুক্তিপণ নিয়েও খুন করে । বড় ছেলের শোক ওলটপালট করে দিয়েছে মা রিনা বেগমের জীবন। সে ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বেশিরভাগ আসামীই এখন জামিনে মুক্ত।
আব্দুল্লাহর কবরের পাশে মাঝেমধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকেন বাবা আর ছোটভাই। শুধু আব্দুল্লাহ নয় নারায়ণগঞ্জের ত্বকী হত্যার বিচার আলোর মুখ দেখছে না বহু বছরেও।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, শিশু ও নারীর উপর সহিংসতা রোধে যত উচ্চ বাচ্যই শোনা যাক না কেনো, এসব ঘটনা থামছে না কোনোভাবেই।
সংশ্লিষ্টদের অভিমত, বিচারহীনতায় দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতন। গত ৩ বছরে খুন হয়েছে ৯৪৫ শিশু। ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৪২৮ জন নারী। এসিডে ঝলসে গেছে ৭৩৩ নারী-শিশুর মুখ। এছাড়া যৌন হয়রানি এবং অন্যান্য নির্যাতনের শিকারও হয়েছেন অনেকে। বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে বিচার না হওয়া এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে নারী ও শিশুদের প্রতি নৃশংসতা বাড়ছে।
গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলায় নিতু মন্ড নামে ১৫ বছরের এক কিশোরীকে একই গ্রামের মিলন মন্ডল নামে এক বখাটে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। বখাটেদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর মাগুরা সদর উপজেলার সাংদা লক্ষীপুর গ্রামের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী হ্যাপী (১২) গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। এর আগে ঢাকার উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশাকে ছুরিকাঘাতে মারাত্মক জখম করে ওবায়দুল খান নামে আরেক বখাটে। পরে হাসপাতালে মৃত্যু হয় রিশার। এরও আগে কুমিল্লায় ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় মেধাবী ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকে।
ন্যায্য বিচার না পাওয়ার কারণে নারীর ওপর হামলা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছে উল্লেখ করে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, বর্তমানে চোখের সামনে নারী নির্যাতন হলেও কেউ এগিয়ে আসছে না। এতে করে এক ধরনের ভয়ার্ত পরিবেশ সৃষ্টি হচ্ছে। কোনো নারী যদি তার ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেন, তাহলে সমাজ তাকে নানাভাবে হেয় করে। নারী নির্যাতনে বিচারকার্য বিলম্বিত করতে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাব বিস্তার করা হয়। আর ন্যায্য বিচার না হওয়ায় বিভিন্ন কৌশলে নারী নির্যাতনের ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে।
এদিকে মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, গত এক বছর চার মাসে প্রায় ৬ হাজার নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। সামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাব এর নেপথ্য কারণ। এছাড়া, দ্রæত বিচার না হওয়াকেও দায়ী করা যেতে পারে। তবে নারীদের সাহস করে প্রতিবাদ করতে হবে। আইনের ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সাদেকা হালিম বলেন, নারীর সুরক্ষায় যেসব আইন আছে, সেসব আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। ফলে নির্যাতনকারীরা নারী নির্যাতন করতে আর ভয় পাচ্ছে না। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। নারীর প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তাদের ওপর সহিংসতার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।

 https://www.dailyinqilab.com/article/78789/