২২ ডিসেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৮:৫৩

ব্যাংকিংখাতে তারল্য সংকট কাটছেই না

এইচ এম আকতার: ব্যাংকিংখাতে তারল্য সংকট কাটছে না। এতে করে বিভিন্ন ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়ে দৈনন্দিন কার্যক্রম চালাচ্ছে। এরই ধারবাহিকতায় বুধবার রেকর্ড ২৪ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি ধার দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে এক দিনে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এতটাকা ধার দেয়ার নজির নেই। এর আগে ব্যাংকটি গত সোমাবর ১৬ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা ধার দিয়েছিলো।

জানা গেছে, সরকার ব্যাংক থেকে বেশি পরিমানে ঋণ নেয়ার কারণে তারল্য সংকটে পড়ে ব্যাংকগুলো। এ সংকট কাটাতে ব্যংলদেশ ব্যাংক আমানতের সুদ হার বাড়িয়েছে। এতে করে সংকট কিছুটা কাটার কথা থাকলেও তা কাটছে না। অব্যাহত সংকটে ধারদেনা করে চলছে দেশের অধিকাংশ ব্যাংক। আর এ সংকটে রয়েছে দেশের অধিকাংশ ইসলামি ব্যাংক।

ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, প্রত্যাশা অনুযায়ী আমানত সংগ্রহ হচ্ছে না। একইসঙ্গে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। আবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রির কারণে বাজার থেকে বড় অঙ্কের টাকা উঠে আসছে। এসব কারণে কোনো কোনো ব্যাংকের তারল্য প্রবাহ কমে গেছে।

চলতি অর্থবছরের নবেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বিপরীতে বাজার থেকে ব্যাপক পরিমাণে টাকা উঠে এসেছে। এ অবস্থায় সাময়িক চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্য ব্যাংক থেকে ধারের চাহিদা বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন সরাসরি সরকারকে ঋণ দিচ্ছে না। সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকে গত বুধবার বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য রেপো, লিকুইডিটি সাপোর্ট সুবিধা, স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি এবং শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর জন্য ইসলামিক ব্যাংকস লিকুইডিটি সুবিধার (আইবিএলএফ) নিলাম অনুষ্ঠিত হয়।

এই নিলামে একদিন মেয়াদি রেপো সুবিধার আওতায় একটি ব্যাংক ৩৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা, সাতদিন মেয়াদি রেপো সুবিধার আওতায় ২৫টি ব্যাংক ও ৩টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ১২ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা, একদিন মেয়াদি লিকুইডিটি সাপোর্ট সুবিধার আওতায় ১৪টি প্রাইমারি ডিলার ব্যাংক মোট ৭ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকার বিড বা দরপ্রস্তাব দাখিল করে।

এছাড়া একদিন মেয়াদি স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি হিসেবে একটি ব্যাংক ২১৫ কোটি টাকার দরপত্র এবং ১৪ দিন মেয়াদি ইসলামিক ব্যাংকস লিকুইডিটি সুবিধার আওতায় ৬টি ব্যাংক ৪ হাজার ২৭ কোটি টাকার দরপ্রস্তাব জমা দেয়। নিলাম কমিটি সব দরপ্রস্তাবই গ্রহণ করে। ফলে রেপো, লিকুইডিটি সাপোর্ট সুবিধা, স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি ও আইবিএলএফের আওতায় সব মিলিয়ে ২৪ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বার্ষিক সুদের হার হচ্ছে ৭ দশমিক ৭৫ থেকে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত।

অনেকদিন ধরে দেশের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি থাকলেও তা কমানোর কার্যকর উদ্যোগ ছিল না। একদিকে সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশে আটকে রাখা হয়। আবার গত অর্থবছর ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার যে ১ লাখ ২২ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি দেয় ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি ঋণ দেওয়া মানে নতুন টাকা ছাপানোর মতো। এ প্রবণতা মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেয়। যে কারণে বেশ আগে থেকে এভাবে ঋণ সরবরাহ না করার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন অর্থনীতিবিদরা। আইএমএফের ঋণের শর্তের কারণে গত জুলাই থেকে সুদহারের সীমা তুলে নতুন ব্যবস্থা করা হয়েছে। আর গত ২৭ নবেম্বর রেপোর সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে।

অনেক ব্যাংক ঋণের অর্থ আদায় করতে পারছে না। একই সঙ্গে আমানতের পরিমাণও আগের তুলনায় কমছে। আবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনতেও ব্যাপক পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ঋণ নিলে তারল্য সংকট আরো বাড়তে পারে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৩১ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার। একই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে পরিশোধ করেছে ৩২ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই সময়ে সরকার ঋণ পরিশোধ করেছে বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকার যে ঋণ নিয়েছে চলতি বছরের জুন শেষে তার স্থিতি ছিল এক লাখ ৫৭ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। আর অক্টোবর শেষে তা কমে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংকে ৩২ হাজার ৭৫ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।

 দেশে চলমান তারল্য সংকটের কারণে মূল্যস্ফীতিও। প্রথাগত মুদ্রানীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোয় সুদহারসহ অর্থনীতির সব কাঠামোই বাজারভিত্তিক। কিন্তু আমাদের দেশে সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত। উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতি প্রায় শতভাগ ব্যাংকনির্ভর। আমাদের অর্থনীতির এখনো ৬০ শতাংশের বেশি ব্যাংকের আওতার বাইরে।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনীতির অন্য সব উপাদানের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে কেবল সুদহার বাড়ানোর পদক্ষেপ এ দেশে কার্যকর হবে না। বাজারে অর্থের প্রবাহ কমানোর যে উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে, তাতে এসএমই, কৃষিসহ উৎপাদনশীন খাতই সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যেসব প্রভাবশালী ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা বের করে নিচ্ছেন, তাদের ওপর মুদ্রানীতির কোনো প্রভাব পড়বে না। 

জানা গেছে সরকার তার বাজেট ঘাটতি মেটাতে প্রতিদিনই ব্যাংকিংখাত থেকে ঋণ নিচ্ছে। এতে করে একদিকে ব্যাংকিংখাতে তারল্য সংকট প্রকট হচ্ছে। অন্যদিকে দেশের বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে। এতে করে দেশের তেমন কোন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এনিয়ে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও কোন কাজে আসছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই চলমান তারল্য সংকট কাটাতে আমানতের সুদ হার বাড়িয়েছে। কিন্তু তার পরেও এ সংকট আরও প্রকট হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলো ধারদেনা করে চলতে বাধ্য হচ্ছে।

দেশের প্রায় সব কয়টি ব্যাংকই তারল্য সংকটে রয়েছে। কিন্তু দেশের সব কয়টি ইসলামি ব্যাংকই তারল্য সংকটে রয়েছে। ইসলামি ব্যাংকসহ শরীয়াহ ব্যাংকগুলোতে বিনিয়োগ বন্ধ রয়েছে। এতে করে দেশের এক ধরনের বিনিয়োগ স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এনিয়ে সরকার নানা উদ্যোগহ নিলেও কোন কাজে আসছে না।

https://www.dailysangram.info/post/543905