৯ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৭:৪৯

জাতীয় গ্রন্থাগারে পাঠক কমেছে

 

আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তরের বাংলাদেশ জাতীয় গ্রন্থাগারে বিশাল সংগ্রহ থাকলেও ব্যবহার কমে যাচ্ছে। প্রচারের অভাবে দিনের পর দিন অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকছে এসব বই ও পত্রপত্রিকা। গ্রন্থাগারের ব্যবস্থাপনাও সনাতন পদ্ধতির। গত সাত বছরের হিসাবে দেখা গেছে, গ্রন্থাগার ব্যবহার কমছে। ব্যবহারকারীরা বলছেন, এখানে এমন একটি প্রতিষ্ঠান আছে, সেটাই অনেকে জানেন না। অধিদপ্তর বলছে, প্রচার ও দক্ষ জনবলের অভাবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।

গত বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে জাতীয় গ্রন্থাগারে গিয়ে দেখা যায়, তাকের মধ্যে বইগুলো এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। কোনো কোনো তাকে কোন বিষয়ের বই, তা উল্লেখ নেই। কিছু তাকে নানা বিষয়ের বই একসঙ্গে জড়ো করে রাখা। 

কিছু বইয়ে ধুলাবালু জমে আছে। আধুনিক ব্যবস্থাপনারও অভাব। সেখানে বসে পড়ছিলেন একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তরিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এখানে এসে পড়ালেখা করা যায়, এতটুকুই। বাড়তি কিছু আমার খুব একটা লাগছে না।’ তবে আরেক শিক্ষার্থী তানহা তাসনিয়া বলেন, ‘অনেকেই লাইব্রেরিটি সম্পর্কে জানে না। তাই এখানে পাঠক কম। আমি আসি; কারণ, নিরিবিলি বসে পড়া যায়।’

১৮৯১ সালে কলকাতায় ইম্পেরিয়াল রেকর্ড ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১১ সালে এটি চলে যায় দিল্লিতে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এই প্রতিষ্ঠানের নাম হয় ন্যাশনাল আর্কাইভ অব ইন্ডিয়া। ১৯৫১ সালে করাচিতে ডিরেক্টরেট অব আর্কাইভস অ্যান্ড লাইব্রেরিসের অধীনে ন্যাশনাল আর্কাইভস অব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয় আর্কাইভসের কোনো শাখা পূর্ব পাকিস্তানে ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৯৬৭ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুরে ‘ডেলিভারি অব বুকস অ্যান্ড নিউজপেপার’ নামে একটি শাখা খোলা হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ক্রীড়া ও সংস্কৃতিবিষয়ক বিভাগের অধীনে আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। 

অধিদপ্তর কাজ করছে দুটি ভাগে—জাতীয় গ্রন্থাগার ও আর্কাইভস। জাতীয় গ্রন্থাগারের কাজ হলো নতুন, সৃজনশীল ও মৌলিক প্রকাশনা সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ, ডিজিটালাইজেশন, ডিজিটাল ক্যাটালগ তৈরি, সংরক্ষণ ও অনলাইন তথ্যসেবা; গ্রন্থাগারে পাঠক ও গবেষকদের সেবা দেওয়া, জাতীয় গ্রন্থপঞ্জি প্রণয়ন এবং বইয়ের আইএসবিএন দেওয়া।

জাতীয় গ্রন্থাগার বিভাগের তথ্যমতে, এর সংগ্রহ প্রায় ৫ লাখ ৫০ হাজার। এর মধ্যে বই ২ লাখ ২৫ হাজার। দুষ্প্রাপ্য বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো টেকচাঁদ ঠাকুরের ১২৬৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ‘আলালের ঘরে দুলাল’, ১৯০৭ সালে প্রকাশিত কেদারনাথ মজুমদারের ‘ময়মনসিংহ বিবরণ’। এ ছাড়া আছে ১৭৫২ সালের হাতে লেখা কোরআন শরিফ।

অধিদপ্তরের ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, আগের চার অর্থবছরের তুলনায় এই অর্থবছরে পাঠকসংখ্যা অনেক কম। তবে মাঝে ২০২০-২১ অর্থবছরে কোভিড মহামারির কারণে পাঠক সবচেয়ে কম ছিল। ছয় অর্থবছরে গড়ে ২০ হাজার পাঠক ও গবেষক সেবা নিয়েছেন গ্রন্থাগার থেকে। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেবা নিয়েছে ১১ হাজার ৫২৮ ব্যক্তি বা সংস্থা। যদিও গ্রন্থাগার অধিদপ্তরের এই বছরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ হাজার ৫০০ জন।

আগের বছরগুলোতে অধিক পাঠক থাকা সত্ত্বেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেন লক্ষ্যমাত্রা কম ধরা হয় এবং সেবাও কম দেওয়া হয়, জানতে চাইলে সহকারী গ্রন্থাগার পরিচালক মো. নাজমুস শাহাদৎ বলেন, ‘লাইব্রেরিতে এসে বিষয়ভিত্তিক পড়ালেখা করা পাঠক কমে গেছে। বেশির ভাগ পাঠকই আসেন বিসিএস কিংবা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য পড়ালেখা করতে। কিন্তু জাতীয় গ্রন্থাগারে এই ধরনের বই রাখা হয় না। বই নিয়ে ঢুকতেও দেওয়া হয় না। তাই বিগত বছরগুলোতে পাঠক বেশি থাকলেও ধীরে ধীরে তা কমে গেছে।’

তথ্যসামগ্রীর অটোমেশন, ডিজিটালাইজেশনে গত অর্থবছরগুলোর তুলনায় এই অর্থবছরে অগ্রগতি দেখা গেছে জাতীয় গ্রন্থাগারের। শুধু তা-ই নয়, এই অর্থবছরে গত অর্থবছরগুলোর তুলনায় বেশি বইয়ের আইএসবিএন দেওয়া হয়েছে। জাতীয় গ্রন্থাগার সূত্রে জানা যায়, কপিরাইটের আওতায় নেই এমন বই তারা ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে অনলাইনেই পড়ার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। ভার্চুয়াল লাইব্রেরির মাধ্যমে এই সেবা পাচ্ছে পাঠকেরা। তবে গ্রন্থাগারের দুর্লভ বই সংরক্ষণ করা হচ্ছে সনাতন পদ্ধতিতে। এসব বই নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেও মুক্ত নয়।

জাতীয় গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রচারের অভাব, দক্ষ ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের অভাব এবং বাজেটস্বল্পতার কারণে ইচ্ছা থাকলেও অনেক কিছু করা যাচ্ছে না। শিগগির নতুন একটি প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। এর মাধ্যমে গ্রন্থাগার আধুনিকায়ন সম্ভব হবে বলে তাদের আশা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, মানুষের পড়ার আগ্রহ কমেছে, এটি বলা যাবে না। পড়ার আগ্রহ তৈরির ব্যবস্থা আগে করতে হবে। লাইব্রেরি বানাতে হবে আরও। পড়ার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। প্রবীণ ব্যক্তি ও বাচ্চাদের জন্য আরও নানা জোন তৈরি করতে হবে। এত জনসংখ্যার ঢাকায় কটি লাইব্রেরি? পড়ার সংস্কৃতি তৈরি করাটা জরুরি।

https://www.ajkerpatrika.com/307154