৯ ডিসেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৬:২৮

এক বছরে ৭ বার বাড়ল এলপি গ্যাসের দাম

চলতি ২০২৩ সালে সাতবার বেড়েছে রান্নার কাজে বহুল ব্যবহৃত তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম। এর মধ্যে কমেছে পাঁচবার। সর্বশেষ টানা পাঁচবার বেড়েছে জরুরি এই পণ্যটির দাম। এলপিজির মূল উপাদান কাঁচামাল হচ্ছে প্রোপেন এবং বিউটেন। 

সৌদি প্রতিষ্ঠান আরামকোর প্রোপেন এবং বিউটেনের ঘোষিত কন্টাক্ট প্রাইস (সৌদি সিপি) অনুযায়ী প্রতি মাসেই এলপিজির দাম নির্ধারণ করা হয়। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান, ডিলার ও খুচরা বিক্রেদাদের কমিশনসহ ভোক্তা পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট এই দাম নির্ধারণ করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এ বছরে দুইবার প্রোপেন ও বিউটেনের দাম অপরিবর্তিত থাকলেও দেশে দাম বাড়ে এলপিজির। আবার প্রতি মাসের শুরুতেই এলপিজির দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও প্রায় সারা বছরই ভোক্তাদের কাছ থেকে বাড়তি দাম নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বছরের শুরুতেই জানুয়ারি মাসে ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ৬৫ টাকা কমিয়ে এক হাজার ২৩২ টাকা নির্ধারণ করে দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। যার আগের দাম ছিল এক হাজার ২৯৭ টাকা। 

পরবর্তী সময়ে ফেব্রুয়ারি মাসে এক ধাক্কায় ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ২৬৬ টাকা বাড়িয়ে এক হাজার ৪৯৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়। মার্চ মাসে ৭৬ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ৪২২ টাকা। এপ্রিল মাসে আবারও ২৪৪ টাকা কমিয়ে দাম নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ১৭৮ টাকা। পরবর্তী সময়ে মে মাসে বাড়ে দাম। ওই মাসে ৫৭ টাকা বাড়িয়ে এক হাজার ২৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। 

এরপর জুন মাসে আবারও দাম কমে এলপিজির। ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১৫৯ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় এক হাজার ৭৪ টাকা। জুলাই মাসে হাজার টাকার নিচে নামে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম। ৭৫ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় ৯৯৯ টাকা।বিইআরসি ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে না। ব্যবসায়ীদের মুনাফার বিষয়টা সংরক্ষণ করে। মূল্য নির্ধারণের কমিটি করে মূল্য নির্ধারণ করা তো বে আইনি। মূল্য নির্ধারণ করতে হবে গণশুনানির ভিত্তিতে।

পরে টানা পাঁচ মাস ধরে বাড়তে থাকে এলপিজির দাম। আগস্ট মাসে ১৪১ টাকা বাড়িয়ে ১১৪০, সেপ্টেম্বরে ১৪৪ বাড়িয়ে ১২৮৪, অক্টোবরে ৭৯ টাকা বাড়িয়ে ১৩৬৩, নবেম্বরে ১৮ টাকা বাড়িয়ে ১৩৮১ ও ডিসেম্বর মাসে ২৩ টাকা বাড়িয়ে ১৪০৪ টাকা নির্ধারণ করে দেয় এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। সবশেষ গেল ৩ ডিসেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনে ১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ১৪০৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ১২ কেজি সিলিন্ডার ছাড়াও ১৫ কেজি ১৭৫৫ টাকা, ১৬ কেজি ১৮৭২, ১৮ কেজি সিলিন্ডার ২১০৭, ২০ কেজি ২৩৪০, ২২ কেজি ২৫৭৫, ২৫ কেজি ২৯২৬, ৩০ কেজি ৩৫১১, ৩৩ কেজি ৩৮৬২, ৩৫ কেজি ৪০৯৬, ৪৫ কেজি ৫২৬৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।    

বিইআরসির ঘোষণায় বলা হয়েছে, ডিসেম্বর ২০২৩ মাসের জন্য সৌদি আরামকোর প্রোপেন এবং বিউটেনের ঘোষিত সৌদি কন্টাক্ট প্রাইস (ঝধঁফর ঈচ) প্রতি মেট্রিক টন যথাক্রমে ৬১০.০০ মার্কিন ডলার এবং ৬২০.০০ মার্কিন ডলার এবং এবং প্রোপেন ও বিউটেনের অনুপাত ৩৫:৬৫ হিসেবে গড় প্রতি মেট্রিক টন ৬১৬.৫০ মার্কিন ডলার প্রতি মার্কিন ডলারের গড় বিনিময় মূল্য ১১৬.৩৯ টাকা বিবেচনায় ডিসেম্বর ২০২৩ মাসের জন্য বেসরকারি এলপিজি ও অটোগ্যাসের ভোক্তাপর্যায়ের মূল্য এ সমন্বয় করা হলো।

সৌদি প্রতিষ্ঠান আরামকোর তথ্য অনুযায়ী, নবেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে একই দাম থাকে প্রোপেন এবং বিউটেনের। তারপরেও দাম বেড়েছে এলপিজির। এছাড়া চলতি বছরের মে মাসেও প্রায় অপরিবর্তিত থাকে এলপিজির ওই প্রধান কাঁচামালের দাম। কিন্তু তারপরেও ওই মাসে দাম বাড়ানো হয় এলপিজির।

বিইআরসির চেয়ারম্যান মো. নূরুল আমিন বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারদর অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে ডলার ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে। গত মাসে ডলারের গড় দর ছিল ১১৩.৯২ টাকা, চলতি মাসে বেড়ে ১১৬.৩৯ টাকা হয়েছে। সমন্বয় করতে গিয়ে দাম বেড়েছে।

এদিকে প্রতি মাসেই বিইআরসির ঘোষণায় বলা হয়, কোনো পর্যায়ে (এলপিজি মজুতকরণ ও বোতলজাতকরণ, ডিস্ট্রিবিউটর এবং ভোক্তাপর্যায়ে রিটেইলার পয়েন্টে) কমিশন নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অধিক মূল্যে এলপিজি  (বোতলজাতকৃত এবং রেটিকুলেটেড সিস্টেমের মাধ্যমে সরবরাহকৃত) অটোগ্যাস বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু সারা বছরই যেদিন দাম ঘোষণা হয় সেদিন থেকেই দাম কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও খুচরা বাজারের চিত্র দেখা যায় উল্টো। দাম বাড়লে তা সাথে সাথে কার্যকর করেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। আবার যে মাসে দাম কমে সে মাসে আগের কেনা থাকার অজুহাত দিয়ে প্রায় সারা মাসেই তাদের খেয়াল খুশির দামে বিক্রি করেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। তবে এখনো বিইআরসি নির্ধারিত দাম ভোক্তা পর্যায়ে শতভাগ কার্যকর হয়নি। বাজারে প্রতি ১২ কেজি সিলিন্ডারে ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দাম নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়।

দাম বেশি নেওয়ার ক্ষেত্রে একে অপরকে দোষারোপ করছেন আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান, ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দামে তারা কিনতেও পান না। ডিলাররা বেশি দাম নিচ্ছে। আবার ডিলাররা বলছেন, কোম্পানিগুলো তাদের সরকার নির্ধারিত দামে পণ্য দিচ্ছে না। আবার কোম্পানিগুলো বলছে, ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা ভোক্তাদের কাছে দাম বেশি নিচ্ছে। এমনিতে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গণশুনানি ছাড়াই অপারেটরদের স্বার্থ রক্ষার জন্য যেভাবে প্রতিমাসে এলপিজির দাম যেভাবে বাড়িয়ে যাচ্ছে তা দুঃখজনক।

বিইআরসির চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, ‘আপনারা যে অভিযোগগুলা পাচ্ছেন আমরা তা পেয়ে থাকি। বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর আগে আমরা কয়েকটি কোম্পানিকে শোকজও করেছি। তবে গেল মাসে নির্ধারিত দামেই বিক্রি হয়েছে। এমনকি কিছু কিছু এলাকায় নির্ধারিত দামের থেকেও কমে এলপিজি বিক্রি হয়েছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে সেসব বিক্রেতার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, ভবিষ্যতেও নেওয়া হবে।’

অপরদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিইআরসি ভোক্তাদের থেকে ব্যবসায়ীদের মুনাফার বিষয়টা বেশি দেখেন। এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘বিইআরসি প্রতি মাসেই যে কম-বেশি করে বাড়ায় সেটাও তো কার্যকর হয় না। বিইআরসি ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে না। ব্যবসায়ীদের মুনাফার বিষয়টা সংরক্ষণ করে। মূল্য নির্ধারণের কমিটি করে মূল্য নির্ধারণ করা তো বে আইনি। মূল্য নির্ধারণ করতে হবে গণশুনানির ভিত্তিতে। এছাড়াও তাদের কমিটিতে আমাদের প্রতিনিধি থাকার কথা, সেটাও তারা করেনি। তারা যাই বলে দিচ্ছে সেভাবেই নির্ধারণ হয়ে যাচ্ছে। তারা ইচ্ছামাফি এগুলো করছে। এভাবে তো মূল্য নির্ধারণ হতে পারে না। আমরা প্রতিনিয়তই প্রতিবাদ করে আসছি। সাধারণ ভোক্তাদের পক্ষ থেকেও এসব প্রতিরোধ করা দরকার।’

 

https://www.dailysangram.info/post/542771