৭ ডিসেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, ৬:৫৬

আদালতে একদিন

 

মঙ্গলবার সকাল ১০টা ৫ মিনিট। ঢাকার সিএমএম কোর্টের প্রবেশদ্বারে প্রচণ্ড ভিড়। আদালত ভবনে ওঠার প্রতিটি লিফটে লম্বা লাইন। তিল ধরার ঠাঁই নেই। বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী ও আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা- সবার মাঝে তাড়াহুড়া। অনেকে ভিড় ঠেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন। কেউ কেউ উঠতে না পেরে নেমে আসছেন। নারীদের ভিড় ঠেলে উপরে উঠতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দেখা গেল, যে যার গন্তব্যে যাচ্ছেন। কেউ ৪ নম্বর কোর্টে।

কেউ ৯ নম্বর কোর্টে। কেউ আবার ২৩ নম্বর কোর্টে। তবে প্রতি তলায় এজলাসের সামনে অস্বাভাবিক ভিড়।

সিএমএম কোর্টের ৪র্থ তলার ৪ নম্বর অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. তোফাজ্জল হোসেনের আদালত। দরজায় প্রচুর ভিড়। ভেতরে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের সমাগমে দাঁড়ানোর অবস্থা নেই। এজলাস কক্ষের ভিড় এসে পড়েছে বাইরেও। বাইরে যারা আছেন তারা ভেতরে উঁকিঝুঁকি মারছে। সকাল ১০টা বেজে ১৫ মিনিট। তখনো বিচারক এজলাসে উঠেননি। তবে আইনজীবীরা ফাইলপত্র রেডি করে ডায়াসের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। একে অপরের সঙ্গে আলাপ করছেন। মামলার কার্যতালিকা মেলাচ্ছেন। এজলাসে দাঁড়ানো বিচারপ্রার্থী কারও মুখে হাসি নেই। ডকের আসামিরা বাইরে দাঁড়ানো স্বজনদের সঙ্গে ফিসফাঁস আলাপ করছেন। একটু এগিয়ে গিয়ে স্বজনদের কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা সবাই রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার স্বজনদের জন্য এসেছেন। ঢাকার বিভিন্ন থানা থেকে এসেছেন। প্রায় সবাই পুলিশের কাজে বাধা, নাশকতা ও বিস্ফোরক মামলায় জেলে গেছেন। কেউ কেউ জামিন চাইতে ও হাজিরা দিতে আদালতে এসেছেন। অনেকে আবার চেক ডিজঅনার, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, অফিস চুরি, মাদক, মারামারির অভিযোগ সংশ্লিষ্ট মামলা করতে এসেছেন। তবে বিচারপ্রার্থীদের কেউ কেউ এসব মামলার হাজিরা ও সাক্ষ্য দিতে এসে ফিরে যাচ্ছেন এমন ঘটনাও দেখা গেছে।

ফিরে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তারা বলছেন, তাদের মামলার শুনানি হয়নি। আদালত অন্যদিন ধার্য করেছেন। তখনো পুলিশ একের পর এক আসামিদের এনে এজলাসের গারদখানায় (ডক) রাখছেন। ১০টা ২৬ মিনিট। হঠাৎ ৪ নং আদালতের পেশকার এসে মাইক্রোফোনে ঘোষণা করলেন, সবাই অপেক্ষা করেন। মাননীয় বিচারক ১০টা ৪৫ মিনিটে এজলাসে বসবেন। এই সময় সকলে প্রস্তুতি নিন। সাক্ষীরাও নিজেদের প্রস্তুতি সেরে নিন। পেশকার এই ঘোষণা দিয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। বিচারকের দেরি হওয়ায় আইনজীবীদের কেউ কেউ এজলাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। আসা-যাওয়ায় ২০ মিনিট পেরিয়ে গেল। বেলা ১১টা ৪৬ মিনিট। বিচারক এজলাসে ঢুকলেন। নিজের নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে সামনে থাকা ল্যাপটপ ওপেন করলেন। বুকে গাউনের সঙ্গে মাইক্রোফোন লাগালেন। ল্যাপটপ চেক করলেন। অল্প কিছু টাইপ করতেই দেখা গেল। ১ মিনিট পরেই বিচারক পেশকারকে ডাকলেন। কথা শেষে পেশকার ডায়াসের সামনে এসে মামলার কার্যতালিকা ধরে ধরে ডাকতে শুরু করলেন। তখন বিচারককে একের পর এক কাগজে স্বাক্ষর করতে দেখা গেছে।

মাইক্রোফোনে পেশকার থানা ও মামলার নম্বর বলছেন, বিচারক শুধু বলছেন, নামেন আজ না। বংশাল ২২ (৩) ১৩ চলে যান। যান সময় আছে। ৪৪ (৯) ১৮ চলে যান আপনাদের আসতে হবে না। চলে যান সবাই নেমে যান। শাহবাগ ৫৮ (১) ১৮ মামলায় বারবার ডাকা হয়। তখন হাজত থেকে আসামি হাত নাড়েন। এক মিনিট পরেই বিচারক বলেন, যান আপনারা নেমে যান। জামিন নামঞ্জুর। তখন পুলিশ হাজত থেকে আসামিকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যান। পল্টন থানা মামলা নং ১৪ (১) ১৫। আসামিদের উদ্দেশ্যে বিচারক বলেন, সবাই আছেন? ঠিক আছে নেমে যান। তখন পুলিশ ডকের ভেতর থেকে আসামিদের বের করে নিয়ে যান। একইভাবে মিরপুর থানার ২৭/৩১ মামলয় বিচারক বলেন, মিরপুর আছে? নেমে যান, কাজ শেষ। লালবাগ ২৯ (১০) ১১। যান লালবাগ নেমে যান। ভাটারা ১৭ (১২) ১৮। যান ভাটারা নেমে যান। পল্লবী ৭২ (১২) ১৪ আছে? নেমে যান। আপনাদের হয়ে গেছে নেমে যান। কামরাঙ্গীরচর ২৫ (২) ১৮ চলে যান। খিলগাঁও ২৫ (১) ১৫ নেমে যান। সবুজবাগ ২(৭)১৪ স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ। শাহ আলী ৩৬ (৯) ১৯ আজকে শুনবো না। যাত্রাবাড়ী ৯ (১) ১৫ নেমে যান। খিলগাঁও ৪৯ (০৯) ১৮ নেমে যান। এভাবে ২০ মিনিট সময় অতিক্রম হয়। এই সময়ে বেশ কয়েকজন আইনজীবীকে ডায়াসের সামনে আসতে যেতে দেখা গেছে। এভাবেই কার্যক্রম চলে।

বেলা ১২টা ৫ মিনিট। এক পায়ে ভর করে আদালতে আসেন সিরাজুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। কাছে গিয়ে কথা বলে জানা গেল, তিনি উত্তরা পশ্চিম থানার ১৭ (১) ১৫ মামলার আসামি। মামলাটি ৩২৩ ধারায় মারামারির অভিযোগে করা হয়েছিল। মঙ্গলবার এই মামলার হাজিরা ছিল। সিরাজুল জানান, গত ৮ বছর ধরে এই মামলা চলছে। বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি। ৭ থেকে ৮ মাস পর পর তারিখ পড়ে। ৪ বছর সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। কিন্তু ৬ মাস সাক্ষীরা আসেন আবার ফিরে যান। এই মামলার আইনজীবী বলেন, রাজনৈতিক মামলার চাপে সাধারণ মামলার বিচার প্রায় বন্ধ আছে। এজন্য আমাদের বিপাকে পড়তে হয়েছে। তারা আদালতে আসেন আর আদালত নতুন তারিখ দিয়ে দেন। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত সিরাজুল সড়ক দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পান। পরে তার পা কেটে ফেলতে হয়। গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় সিরাজুল ইসলাম আইনজীবীর মাধ্যমে স্বশরীরে হাজিরা থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেন। আদালতে মেডিকেল সার্টিফিকেট সংযুক্ত করেন। তবে আদালত তার আবেদন নামঞ্জুর করেন। মঙ্গলবার এই মামলা সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ছিল। তবে আদালত নতুন তারিখ নির্ধারন করে দেন। এমন আরও বেশ কয়েকজনকে দেখা দেছে যাদের যৌতুক, মাদক, জালিয়াতি, ছিনতাই, চুরির মামলায় আদালত নতুন তারিখ নির্ধারণ করে দেন।

এভাবে চলে প্রায় ৩০ মিনিট। এই সময়ে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার আসামিদের কারাগার থেকে আদালতে এনে হাজিরা দিতে দেখা গেল। এই সময়ে অধিকাংশ মামলায় সমন, হাজিরা, সময়ের আবেদন, জামিন শুনানি ও জামিন নামঞ্জুরের ঘটনা ঘটতে দেখা দেছে। আইনজীবীদের কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা জানান, এই মামলাগুলো সব ‘রাজনৈতিক’ মামলা। যা আদালতে বিচারাধীন আছে। তবে আসামিদের কেউ কেউ অন্য মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। তাই কারাগার থেকে এনে পুরনো মামলায় হাজিরা দেয়ানো হচ্ছে। 

ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা ১২টা বেজে ৩৬ মিনিট। আদালতের পেশকার মাইক্রোফোনে ঘোষণা দেন। যাদের নতুন মামলার ফাইলিং আছে, তারা সামনে চলে আসেন। তখন আইনজীবীরা একে একে তাদের মক্কেলকে নিয়ে বিচারকের ডায়াসের সামনে আসলেন। ১২টা ৪০ মিনিট থেকে বিচারক একের পর বাদীদের জবানবন্দি শুনতে থাকেন। মিরপুর থেকে আসা আলেয়া নামের এক মহিলা তার স্বামীর বিরুদ্ধে যৌতুকের জন্য মারধরের অভিযোগে মামলা করতে আদালতে আসেন। এক পর্যায়ে আদালত বলেন, মামলার  আবেদন লেখা ঠিক হয়নি। যান আবার ঠিক করে লিখে নিয়ে আসেন। এভাবে ১২টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত সময় চলে যায়। বেলা ১২ টা ৫১ মিনিট। বিচারক এক আইনজীবীকে ডেকে বলেন আপনি সামনে আসেন। বলেন আপনার কী হয়েছে? তখন আইনজীবী বলেন- স্যার একটি চেকের মামলার আবেদন আছে। তখন বিচারক বলেন, এসব মামলা নিয়ে আর আসবেন না। এই মাইক্রোক্রেডিট কোম্পানিগুলো চেককে একটা ফাঁদ হিসেবে ব্যবহার করেন। প্রথমে লোন দেন। দেয়ার সময় গ্রামের সহজ সরল মহিলাদের কাছ থেকে ফাঁকা চেক গ্রহণ করে। পরে ঠিকমতো কিস্তি দিতে না পারলেই মামলা। চেক যেন টাকা উদ্ধারের হাতিয়ার! 

তখন দুপুর প্রায় ১টা ছুঁই ছুঁই। ওয়ারি থানার এক এসআই একটি মামলায় এক আসামিকে সংযুক্ত করতে আদালতে আসেন। বিচারক তাকে কাঠগড়ায় ডেকে নেন। বিচারক তাকে বলেন এই ব্যক্তি ঘটনাস্থলে ছিলেন, আপনার কাছে কী প্রমাণ আছে যে আসামি সরকারবিরোধী মিছিলে গেছেন। তখন ওই এসআই বলেন, স্যার আমার কাছে একটি ভিডিও ফুটেজ আছে। ভিডিওতে সে ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন তা দেখা যাচ্ছে। 

তখন বিচারক বলেন, ঠিকঠাক দেখেছেন তো? এসআই বলেন, জ্বি স্যার। তখন বিচারক তার আবেদন মঞ্জুর বলে আদেশ দেন। ওয়ারি থানা মামলা নং ১১(১১)২৩।  এরপরেই আরও দুটি মামলা শাহবাগ ৩১(৭)১৭ এসআই হিরন্ময়  কুমার ও গুলশান ২(১২)২১ এসআই মানিক চন্দ্র রায় সাক্ষ্য দেন। দুপুর ১টা ১০ মিনিট থেকে একটি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ১টা বেজে ১২ মিনিটে আদালতে আসেন বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। আদালতে এসে তিনি বেঞ্চে বসেন। একটু পরেই বিএনপিপন্থি একদল আইনজীবী আদালতে এসে হাজির হন। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন এডভোকেট মোসলেহ উদ্দিন জসিম। ৫ মিনিট পরেই খায়রুল কবির খোকন আদালতে এসে আলালের পাশে বসেন। দুপুর ১টা ১৭ মিনিটে পল্টন থানার ৩৭(২)১৮ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। এর প্রায় ১ ঘণ্টা আগে থেকেই ৪ জন এসআই ও একজন এএসআইকে এজলাসের বাম পাশে দাঁড়িয়ে মামলার এজহার মুখস্থ করতে দেখা যায়। পৃষ্ঠা উল্টিয়ে বার বার পড়ছিলেন। তখন তারা বার বার এজলাসের বাম কোণায় দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তার কাছে গিয়ে তালিম নিচ্ছিলেন। কীভাবে বলতে হবে ওই পুলিশ অফিসারকে তাদের শিখিয়ে দিতে দেখা গেল।  বেলা ১টা ২১ মিনিটে মামলার প্রথম সাক্ষী পল্টন থানার সাবেক এসআই আব্দুল হান্নানকে কাঠগড়ায় ডেকে নেন বিচারক। বিচারক তার কাছে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চান। 

সাক্ষ্যতে পুলিশ সদস্য বলেন, ২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে আদালত ৫ বছরের সাজা দেন। রায় ঘোষণার পরে ওইদিন বিএনপি নেতা আলাল ও খায়রুল কবির খোকনের নেতৃৃত্বে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের কয়েকশ’ নেতাকর্মী বিএনপি’র দলীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়ে সরকারবিরোধী নানা স্লোগান দেন। তখন সবার হাতে কালো পতাকা ও লোহার পাইপ ছিল। তারা মিছিল নিয়ে পল্টন থানার দিকে অগ্রসর হতে গেলে তখন পুলিশ তাদের বাধা দেয়। পরে তারা পুলিশকে ধাওয়া করেন। একপর্যায়ে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল ছোড়েন। এতে পুলিশের কয়েকজন সদস্য গুরুতর আহত হন। অনেকের হাত-পা কেটে যায়। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ বিপুল পরিমাণ ইটপাটকেল, লোহার রড ও ককটেলের টুকরো উদ্ধার করে। পরে ওই ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে পল্টন থানায় মামলা করেন। এভাবে একে একে এই মামলার অন্য সাক্ষী এসআই অলক কুমার দে, এএসআই আলী আকবর, এএসআই আব্দুর রহিম সাক্ষ্য দেন। ৪ জনের সাক্ষ্য শেষ হতে বেলা ২টা বেজে যায়। 

২টা ৫ মিনিটে বিচারক আসামিপক্ষের আইনজীবী এডভোকেট মোসলেহ উদ্দিন ও তার সহযোগীদের উদ্দেশ্যে করে বলেন, লার্নেড আপনাদের কোনো জেরা আছে? তখন এই আইনজীবী বলেন, জ্বী স্যার আমরা জেরা করতে চাই। ২টা ৮ মিনিট থেকে জেরা শুরু হয়। জেরার প্রথমে আইনজীবী মোসলেহ উদ্দিন প্রথম সাক্ষী এসআই আব্দুল হান্নানের কাছে জানতে চান, ঘটনার দিন কোথায় ছিলেন? ঘটনার সময় আপনার কোথায় জখম হয়েছে? পল্টনে ওই ঘটনা ঘটার পরে থানায় আপনার কোনো জবানবন্দি গ্রহণ করা হয়েছে কিনা? জব্দ তালিকার মালামাল পল্টন থানা থেকে এনে উদ্ধার দেখানো হয়েছে। এই কাজে আপনিও সহায়তা করেছেন। প্রায় প্রতিটি প্রশ্নের সময়ই বিচারককে কথা বলতে দেখা গেছে। জেরায় আইনজীবীরা এসআই অলক কুমারের কাছে জানতে চান ওই ঘটনার সময় বিএনপি’র কোন কোন নেতা ঘটনাস্থলে ছিলেন? তখন অলক মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের নাম বলেন। কিন্তু আলালের নামে মোয়াজ্জেম হোসেনের জায়গায় মোজাম্মেল হোসেন বলতে থাকেন। তখন বিচারক তাকে বলেন মোজাম্মেল হোসেন নয়, মোয়াজ্জেম হোসেন হবে। বার বার ভুল নাম উচ্চারণ করায় এজলাসে থাকা আলালও জোরে হেঁসে ওঠেন। তখন এজলাসে থাকা অন্যরাও হেসে দেন। 

আইনজীবী সাক্ষীর কাছে জানতে চান, জব্দ তালিকায় পুলিশের অন্য কোনো নম্বর ব্যবহার করেছেন কিনা? আইনজীবীরা সাক্ষীর কাছে জানতে চান, হোটেল ভিক্টোরিয়া থেকে বিএনপি’র পার্টি অফিসের দূরত্ব কতোটুকু? সিসিতে আপনার সঙ্গে কতোজন ছিল। তাদের নাম বলেন। আপনি কি আগে থেকে জানতেন বিএনপি নেতারা অফিসের সামনে মিলিত হবে? ঘটনার সময় অফিসের আশপাশের দোকানদারদের সাক্ষ্য নিয়েছেন কিনা? একপর্যায়ে জেরাকারী আইনজীবী বিচারককে উদ্দেশ্য করে বলেন, স্যার এই সাক্ষীরা তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। তখন বিচারক বলেন, প্লিজ শেষ করেন। জেরা হয়ে গেছে। জেরার একপর্যায়ে আইনজীবীদের প্রশ্নের দ্রুত উত্তর দিতে গেলে তখন সাক্ষী অলক কুমারকে বিচারক ধৈর্য ধরতে বলেন।  জেরার আইনজীবীরা বলেন, সেদিন পুলিশের কাজে কোনো বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটেনি। শেষপর্যায়ে আইনজীবীরা সময় চাইলে তখন বিচারক বলেন, টাইম পিটিশন দাখিল করেন। তারপরে শুনানিতে যা হয় তাই হবে। তখন বিচারক বলেন, আমরা আর পারছি না। আমরা লিখতে লিখতে এখন ক্লান্ত। মামলার চাপে আমরা ঠিকমতো দেখতে পারি না। শুনতে পারি না। বেলা ২টা ৩৬ মিনিটে এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। সাক্ষ্য গ্রহণকালে আদালতের নিজস্ব ক্যামেরায় আইনজীবীদের জেরা ভিডিও করা হয়। 

বেলা ২টা বেজে ৪০ মিনিট। মতিঝিল থানার ৩৭(৪)১৮ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। এই মামলাটিও জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে ৫ বছর সাজা দিয়ে রায় ঘোষণার পরে রায়-বিরোধী মিছিল করাকে কেন্দ্র করে। এই মামলায় যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল ইসলাম নিরব, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ও পটিয়া উপজেলা বিএনপি’র আহ্বায়ক এনামুল হক এনামসহ ৫৪ জন আসামি। এই মামলায় সাক্ষ্য দিতে আসেন এসআই সরোয়ার কামাল, পুলিশ পরিদর্শক আসলাম উদ্দিন, এসআই ফারুক হোসন ও পেপার বিক্রেতা মীর নাসির হোসেন। 

২টা ৫০ মিনিটে বিচারক সাক্ষীদের কাঠগড়ায় ডেকে নেন। তখন এজলাসে সাইফুল ইসলাম নিরব উপস্থিত ছিলেন। বিচারক প্রথমে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ফারুক হোসেনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। ফারুককে কোথায়, কখন, কারা এই ঘটনা ঘটালো তা বলতে গিয়ে বার বার ভুল করতে দেখা গেছে। একপর্যায়ে বিচারক সাক্ষীর সঙ্গে কথা বলা বাদ দিয়ে তিনি নিজেই দ্রুততার সঙ্গে তার হাতে থাকা নথি পড়তে থাকেন। তখন সাক্ষী কাঠগড়ায় চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এইভাবে একে একে ৩ জন পুলিশ অফিসারের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়। পরে বিচারক বেলা ৩টা ১০ মিনিটে এই মামলার আসামিপক্ষের আইনজীবী ফরহাদ হোসেন লিওনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনার কোনো জেরা আছে কিনা? তখন কিছুটা সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে আইনজীবী ফরহাদ এসআই ফারুক হোসেনকে প্রশ্ন করেন। 

প্রশ্নে তদন্ত কর্মকর্তাকে বলেন, ঘটনার সময়ে ওই স্থানে সাইফুল ইসলাম নিরব উপস্থিত ছিলেন, তখন তিনি কোন পোশাকে ছিলেন? আপনি তাকে নিজের চোখে দেখেছেন? জবাবে এসআই বলেন, আমি ওই এলাকার লোকজনের কাছে শুনেছি। যাদের গ্রেপ্তার করেছি তারা বলেছে। তখন বিচারক বলেন, এসআই ফারুক সাইফুল ইসলাম নিরবকে ঘটনাস্থলে দেখেননি ইহা সত্য নহে এই বলে লিপিবদ্ধ করেন। পরে আইনজীবী সাক্ষী ফারুকের কাছে জানতে চান, আপনি ঘটনাস্থল থেকে কাউকে আটক করেননি এবং কোনো ঘটনা ঘটেনি। কোনো আলামত জব্দ করেননি। ঘটনাস্থলে আপনি যানওনি। পলাতক আসামিদের নাম কার কাছ থেকে জেনেছেন তা এজহারের উল্লেখ করেননি। কোন ব্যক্তি আঘাত করেছেন এটা উল্লেখ করেননি। ৩টা বেজে ২০ মিনিট। মামলার শেষ সাক্ষী মীর নাসির হোসেন কাঠগড়ায় ওঠেন। 

নাসির হোসেন কাঠগড়ায় গিয়েই বলেন, স্যার আমাকে পুলিশ অযথা হয়রানি করতেছে। আমি মামলার বিষয়ে কিছু জানি না। আমাকে ফুটপাত থেকে ধরে থানায় নিয়ে আমার স্বাক্ষর নিয়েছে। কি জন্য স্বাক্ষর নিয়েছে তা তখন আমি জানতাম না। পরে শুনলাম আমাকে বিএনপি’র মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে। আমি এই ঘটনা সম্পর্কে কিছু জানি না। আমি দৈনিক বাংলার মোড়ে পেপার বিক্রি করি। ওইদিন মতিঝিলে এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি স্যার। তারপরেও পুলিশ আমাকে সাক্ষী করেছে। আমার কবরে যেতে হবে, আমি কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষী দিতে পারবো না। স্যার, আমার নামটা কেটে দেন। নইলে আমি বাইরে গিয়ে গড়াগড়ি খাবো। আমাকে কোনো কারণ ছাড়াই হয়রানি করা হচ্ছে। ওইদিন মতিঝিলে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে তা আমার জানাও নেই। তাহলে আমি কীভাবে সাক্ষী দিবো? তখন বিচারক বলেন, একি বলেন, আপনার বক্তব্য সঠিক না। আপনার সাক্ষী দিতে হবে না। আপনি চলে যান। 

বিচারক হাসতে হাসতে বলেন, এ কেউ উনাকে এখান থেকে নিয়ে যান। বেলা ৩টা ২৫ মিনিট। মিরপুর থানা ৪৩(৪)১৩ মামলায় সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করেন। আইনজীবীরা সাক্ষ্য দেয়া দুই এসআই’র কাছে জানতে চান, সেদিন মিরপুরে কি ভাঙচুর করা হয়েছে? কার গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে? জবাবে সাক্ষী বলেন, সে গাড়ির নাম বলতে পারবো না। আইনজীবী জানতে চান, সেই গাড়ির নাম্বার বলতে পারবেন? জবাবে সাক্ষী বলেন, নাম্বার প্লেট আমি দেখিনি। আইনজীবী জানতে চাইলে সাক্ষীরা বলেন, ওইদিন পুলিশের ওপর হামলা হয়েছে। অনেকে আহত হয়েছে। তবে কে কী পরিমাণ আহত হয়েছে এবং কোন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে তা তাদের জানা নাই। এই মামলা আসামি সংখ্যা জানতে চাইলে  শেষে সাক্ষী বলেন, এই মুহূর্তে আসামিদের নাম বলতে পারবো না। বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে বিচারক এজলাস থেকে নেমে যান।

https://mzamin.com/news.php?news=87106