২৯ নভেম্বর ২০২৩, বুধবার, ১০:১৮

নাগরিক সমাজের আলোচনা

আরেকটি একতরফা নির্বাচন হলে রাষ্ট্রের সামর্থ্য সম্ভাবনা সংকটে পড়বে

 

রাজধানীতে আয়োজিত নাগরিক সমাজের এক আলোচনা সভায় বক্তারা বলেছেন আরেকটি একতরফা নির্বাচন হলে দেশের সামর্থ্য, সম্ভাবনা ও ভবিষ্যৎ সংকটে পড়বে। তারা বলেন, অতীতে অনেক অনিয়ম হয়েছে। কিন্তু নাগরিক সমাজ এ নিয়ে তেমন প্রতিবাদ করেনি। কথা বলেনি। তখন কথা বললে এখন এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না। 

গতকাল ‘মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি’র আয়োজনে ‘আবারো সাজানো নির্বাচন: নাগরিক উৎকণ্ঠা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল। আলোচক হিসেবে ছিলেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক, নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ব্রতী’র প্রধান শারমিন মুরশিদ, নারীপক্ষের প্রধান শিরিন হক, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সাল।

অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল তার লিখিত বক্তব্যে বলেন, সাজানো নির্বাচনের কিছু আলামত আমরা গত কয়েক মাসে দেশের প্রথম সারির কয়েকটি পত্রিকার প্রতিবেদনের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হবে। একতরফা সাজানো নির্বাচনের আলামত হিসেবে আসিফ নজরুল প্রধান ৭টি বিষয়কে তুলে ধরেছেন। 

তিনি বলেন- পুরনো মামলা হঠাৎ সচল করা, নির্বিচারে সাজা প্রদান, অস্বাভাবিক বিচারিক প্রক্রিয়া, নির্বিচারে নতুন মামলা ও গ্রেপ্তার, বাড়িতে হামলা ও স্বজন গ্রেপ্তার, কিংস পার্টি গঠন, নির্বাচন কমিশনের বিতর্কিত ভূমিকার মাধ্যমে বর্তমান সরকার একটি একতরফা নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা নিয়েছে। 

বর্তমান পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, আমরা অতীতের দুটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি- একতরফা, বিতর্কিত ও সাজানো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সংসদে বা অন্য কোথাও সরকারের কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকে না; রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। দেশে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-, নির্যাতন, প্রকল্প বাস্তবায়নে অনাচার, ব্যাংকের মূলধন লুটপাট, অর্থপাচার এবং বিদেশি রাষ্ট্রের খবরদারি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। 

ড. শাহদীন মালিক বলেন, বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট এখন ক্যান্টনমেন্টে পরিণত হয়েছে।

নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে শাহদীন মালিক বলেন, সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে প্রবেশের সময়ে গেটে আমার গাড়ি থামানো হয়েছে। গাড়িতে সুপ্রিম কোর্টের পরিচয় সংবলিত স্টিকার থাকা সত্ত্বেও আমার গাড়ি থামানো হয়েছে। আমার শরীরে আইনজীবীর কালো গাউন থাকার পরে আমাকে দেখে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়েছে। আমার জুনিয়র আইনজীবীরা বলছেন নিরাপত্তার নামে তাদের কাগজপত্র পোশাক সব পরীক্ষা করা হয়। এটা শুধু সুপ্রিম কোর্টের অবস্থা নয়। সারা দেশেই একই অবস্থা হয়তো।  বিজিবি, আনসার, পুলিশ, র‍্যাব এসবের সংখ্যা ১০-১২ লাখের মতো প্রায়। এরশাদ আমলে এত সংখ্যক ছিল না। এমন পরিস্থিতি ছিল না।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ এই আইনজীবী বলেন, বাংলাদেশকে এখন ধীরে ধীরে বাশার আল আসাদ মডেলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

সংবিধানের দোহাই দেয়া হচ্ছে। 
শারমিন মুরশিদ বলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে নির্বাচন পর্যবেক্ষকের কাজ করি। এমন পরিস্থিতি আগে কখনো দেখিনি। এর আগে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের অধীনে যখন ২০১৪ সালের নির্বাচনটি হলো তখন আমরা অনেকেই কথা বলিনি। এখন এসে স্বীকার করছি, সেটা আমরা ঠিক করিনি। সেদিন যদি আমরা কথা বলতাম, তাহলে পরিস্থিতি এখানে নাও আসতে পারতো। এরপরে ২০১৮ সালে নির্বাচন হয়েছে। সেই নির্বাচনে আমাদের পর্যবেক্ষক থাকতে দেয়া হয়নি। 

গত নির্বাচনে নাগরিকরা ভোট দিতে পারেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনটি একইভাবে হতে দেয়া যায় না। বর্তমান তফসিল বাতিল করে পুনরায় তফসিল করতে হবে। বিরোধী রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে আসার পথ তৈরি করতে হবে। নাগরিকরা ভয়ে দিনযাপন করছেন। এই পরিস্থিতিতে আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত নই। 

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন, বাংলাদেশে এখন যে পরিস্থিতি তাতে একজন নাগরিক হিসেবে আমি ভীত, শঙ্কিত, আতঙ্কিত, সন্দিহান এবং বিপদগ্রস্ত। যারা ক্ষমতায় আছেন তারা একতরফাভাবে একটি নির্বাচন আয়োজনের দিকে যাচ্ছেন। এইভাবে চলতে পারে না। অনেক দুঃখজনক ঘটনার মাঝে এটাও আরেকটি দুঃখজনক ঘটনা যে- সাংবাদিক সমাজ যারা রয়েছেন, তারা তাদের কাজটি সঠিকভাবে করছেন না বা করতে দেয়া হচ্ছে না।  

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, বর্তমান সরকারের প্রধান সমস্যাজনক কাজ হচ্ছে- সকল প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া। কোনো প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো কাজ করছে না। পুলিশ বাহিনী, নির্বাচন কমিশন, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি আদালত পর্যন্ত তারা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে এসেছে। পুলিশ বাহিনী দলীয় বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন একতরফা নির্বাচন আয়োজনের সহায়ক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এমনকি বিচার বিভাগ আদিষ্ট হয়ে বা নির্দেশনা মোতাবেক বিচারের রায় দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শত শত শিক্ষক এই সরকারের অন্যায় কর্মকা-কে সমর্থন করছে। ২০১৮ নির্বাচনের পরে দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সেই নির্বাচন ভালো নির্বাচন হয়েছে উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছে। এমন একটা নির্বাচনকে ভালো নির্বাচন বলতে পারার মতো নির্লজ্জ তারা হতে পেরেছে। 

যার যা কাজ নয় তা করছে উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে শহরে। সীমান্তে মানুষ মারা পড়ছে, সেটি নিয়ে কোনো তৎপরতা নেই। অথচ যারা ভোটের দাবিতে রাস্তায় নেমেছে তাদের লাঠিপেটা করছে বিজিবি। আবার মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে রাস্তায় নামা ক্ষুধার্ত পোশাক শ্রমিককে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে চারজন শ্রমিক নিহত হয়েছে। 

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ‘খেলা হবে’ বক্তব্য কোনো নিছক হাস্যরসের কথা নয় উল্লেখ করে আনু মুহাম্মদ বলেন, ওবায়দুল কাদের বার বার বলেছেন, ‘খেলা হবে’। এখন দেখতে পাচ্ছি মুখোশ পরে বিভিন্ন বাড়িঘরে হামলা চালানো হচ্ছে। বিএনপিসহ বিরোধীদের হামলা, মামলা, আটক করা হচ্ছে। পুলিশ দিয়ে পেটানো হচ্ছে। হাত-পা বেঁধে এখন নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। এমন আচরণের পরে নির্বাচনে ডাকা হচ্ছে ‘খেলা হবে’ বক্তব্যের সমর্থন। এই বক্তব্য একটি পরিকল্পনার অংশ। 

শিরিন হক বলেন, দেশে এখন একতরফা নির্বাচনের যে পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, তাতে বেশি দুশ্চিন্তা হচ্ছে তরুণ ভোটারদের নিয়ে। বিগত নির্বাচনে প্রথম ভোটার যারা হয়েছিল, তারা ভোট দিতে পারেনি। আবার একই অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে। এই তরুণ ভোটাররা আমাদের ক্ষমা করবেন না।  

সমাপনী বক্তব্যে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বর্তমান সরকার এই নির্বাচনটিকে আবারো নিজেদের মতো করে করতে চাইছে। তারা সংবিধানের কথা বলছে। কিন্তু এই নির্বাচন কমিশন যেভাবে গঠিত হয়েছে তা অসাংবিধানিক। তাই এই সরকারও অসাংবিধানিক। তাই তাদের মুখে সংবিধানের কথা মাননসই নয়। ‘প্রধান নির্বাচন কমিশন ও অন্যান্য কমিশনার নিয়োগ আইন- ২০২২’ যে প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে, সেটিও সংবিধান সম্মত নয়। এ ছাড়া যে প্রক্রিয়ায় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে, তাতে আদালতের নির্দেশনা অমান্য করা হয়েছে। নিজেরা ক্ষমতায় থাকতে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন করা হচ্ছে। নির্বাচন মানে হচ্ছে- বাছাই করা। বিকল্পের মধ্য থেকে বাছাই করা। সেটা এইভাবে কিংস পার্টি কিংবা বিএনএম বানিয়ে অন্য প্রধান রাজনৈতিক দলকে বাইরে রেখে প্রার্থী বাছাই করা নয়। তাই এই প্রক্রিয়াকে নির্বাচন বলা যাবে না।

https://mzamin.com/news.php?news=85791