২৫ নভেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৫:১৯

৩৯ শতাংশ মানুষ ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই ওষুধ সেবন করছে

কয়েক দিন ধরে তিন বছরের মেয়ে তামান্নার জ্বর-ঠাণ্ডা-কাশি। নাপা খেয়ে জ্বর কমছে না। এতে চিন্তিত তার বাবা রাজধানীর বংশাল এলাকার মুদি দোকানি তাওহীদ হোসেন। ঠিক করলেন ওষুধের দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক এনে মেয়েকে খাওয়াবেন।

শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) ওই ওষুধের দোকান থেকে তাওহীদ হোসেন অ্যান্টিবায়োটিক কেনার সময় তাঁর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের পরিচয়।

চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া এভাবে ওষুধ সেবনে যে স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে, তা জানেন কি না—এমন প্রশ্নে তাওহীদ হোসেন বলেন, ‘শুনেছি অনেক সময় ক্ষতি হয়। কিন্তু আমরা তো কত ওষুধ খেয়েছি, কখনো কিছু হয়নি।’

শুধু তাওহীদ হোসেন নন, দেশের প্রায় ৩৯ শতাংশ মানুষ চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া এভাবে ওষুধ সেবন করছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্ল্যানিং, মনিটরিং অ্যান্ড রিসার্চের (পিএমআর) সার্বিক তত্ত্বাবধানে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।

২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত এই গবেষণা পরিচালিত হয়। এতে আটটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও চারটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান থেকে মোট ১৩ হাজার ৩৫০টি প্রাথমিক কালচার সংগ্রহ করা হয়েছে। গবেষণা কার্যক্রমের জন্য ক্ষতস্থান, মূত্র, রক্ত, মল, এন্ডোট্র্যাকিয়াল অ্যাসপিরেট পুঁজ এবং অন্যান্য মাধ্যম থেকে পাওয়া এক হাজার ১৪৯টি নমুনা গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ফলাফলে দেখা যায়, ৮.৬১ শতাংশ নমুনার জীবাণু সব ধরনের ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে উঠেছে।

এ ছাড়া ২০ বছরের নিচে রোগীর মধ্যে ওষুধপ্রতিরোধী জীবাণু পাওয়া গেছে ২৯.২ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ রোগী ৫১.৪ শতাংশ। এসব রোগীর মধ্যে ৭১.৮ শতাংশের অ্যান্টিবায়োটিক বা জীবাণুপ্রতিরোধী ওষুধ গ্রহণ করার ইতিহাস রয়েছে।

চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফার্মেসিগুলোতে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই।

তবে কিছু নির্দেশনা আছে। তদারকি না থাকায় এই নির্দেশনা ক্রেতা বা বিক্রেতা কেউই মানে না।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে নিম্ন আয়ের মানুষ চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ফার্মেসি থেকে এখন অ্যান্টিবায়োটিক কিনে সেবন করে। অ্যান্টিবায়োটিকের নাম মুখস্থ। দোকানে গিয়ে বলে, এই অ্যান্টিবায়োটিক দেন। তাদের মধ্যে ধারণাই নেই যে এতে তার শরীর অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী হয়ে যাচ্ছে এবং পরে কোনো সংক্রমণ হলে কোনো ওষুধে হয়তো সারবে না।’

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শাহেদ আলী জিন্নাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরিবারের কেউ ক্যান্সার আক্রান্ত হলে চিকিৎসা কিভাবে হবে, এ নিয়ে রোগীর স্বজনদের পাগল দেখা যায়। কিন্তু সাধারণ কাশি-ডায়রিয়া বা সংক্রমণ হলে যে মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, এটা নিয়ে মানুষের মধ্যে ভাবনা নেই। কারণ আমাদের হাতে তো ওষুধ নেই। সব প্রতিরোধী হয়ে যাচ্ছে।’

মোহাম্মদ শাহেদ আলী জিন্নাহ বলেন, ‘পল্লী চিকিৎসক ও ফার্মেসি দোকানদার রোগী এলেই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিচ্ছেন। এটা বন্ধ করতে হবে। কারণ এতে পুরো সমাজকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছেন। কোনোভাবেই অপ্রয়োজনে চিকিৎসকরা অ্যান্টিবায়োটিক দেবেন না। দিলে সেটি সঠিক মাত্রার হতে হবে। একই সঙ্গে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া রোগীরা ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনবেন না। এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে পারছি না।’

প্রতিষ্ঠানটির সহকারী অধ্যাপক ডা. সানজিদা ইরিনা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গবেষণায় সবচেয়ে বেশি জীবাণু পাওয়া গেছে সিউডোমোনাস। এর পরই ই-কোলাই। এর কারণ হলো, নমুনা সংগ্রহে আমরা কিছু নিয়ম বেঁধে দিয়েছিলাম। মাল্টিড্রাগ প্রতিরোধী জীব (এমডিআরও) ও প্যান ড্রাগ প্রতিরোধী জীব (পিডিআর)—তিন বা ততোধিক অ্যান্টিবায়োটিক ক্যাটাগরির কমপক্ষে একটি করে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট পাওয়া গেলে তাকে এমডিআরও এবং সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট পাওয়া গেলে তাকে পিডিআর বলা হয়।’

তিনি বলেন, ‘অ্যান্ট্রিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স নিয়ে দেশের অনেক মেডিক্যাল কলেজে গবেষণা হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা রেজিস্ট্যান্স ব্যাকটেরিয়ার জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছি, যেটা বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো করা।’

ডা. সানজিদা ইরিনা বলেন, গবেষণায় সবচেয়ে বেশি নমুনা নেওয়া হয়েছে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে। বার্নের রোগীদের ক্ষেত্রে সিউডোমোনাস একটু বেশি থাকে অন্যান্য রোগীর চেয়ে, যে কারণে বেশি ছিল।

https://www.kalerkantho.com/online/national/2023/11/25/1339504