২৫ নভেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৩:৪৯

পোশাকশিল্পে অস্থিরতা

-জালাল উদ্দিন ওমর

 

পোশাকশিল্প দেশে রফতানি আয়ের প্রধান খাত, অর্থনীতির চালিকাশক্তি। এ খাতকে কেন্দ্র করে বিশাল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অথচ এই শিল্পে প্রায়ই অস্থিরতা দেখা দেয়। কখনো শ্রমিকরা বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে, কখনো বকেয়া পরিশোধের দাবিতে বিক্ষোভ করে। কখনো তারা কারখানায় হামলা করে, মূল্যবান জিনিসপত্র ভাঙচুর করে। এই অস্থিরতা এই খাতকে কেবল ক্ষতিগ্রস্তই করে।

 

পোশাকশিল্প খাতে সরাসরি কর্মরত আছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। এ খাতকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে অনেক ব্যাকওয়ার্ড শিল্পকারখানা এবং এ খাতই দেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল করেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এত গুরুত্বপূর্ণ খাতটি এখনো অস্থিরতামুক্ত করা যায়নি। অস্থিরতার সূত্রে অনেক কারখানায় হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে। অনেক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়েছে। সরকার গত ৭ নভেম্বর পোশাকশিল্পে সর্বনিম্ন মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকায় নির্ধারণ করেছে যা ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে। কিন্তু শ্রমিকরা সেটি গ্রহণ করেনি। এখন মামলা, গ্রেফতারের প্রক্রিয়ায় আন্দোলন দমনের চেষ্টা চলছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে শিল্পটি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে, যা দেশের বিকাশমান অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত করবে। কারণ, বিদেশী ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং তাদের কাজের অর্ডার অন্য দেশে চলে যাবে। উৎপাদনের পরিবেশ ও কারখানার নিরাপত্তা যদি বিঘ্নিত হয় তাহলে তো কোনো বিনিয়োগকারীই শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনে এগিয়ে আসবে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ধারাবাহিকভাবেই পোশাকশিল্পে অস্থিরতা চলে আসছে। এই অস্থিরতার চির অবসান জরুরি।

দেশের মোট রফতানি আয়ের বেশির ভাগই আসছে পোশাকশিল্প থেকে। ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের মোট রফতানি আয় ছিল পাঁচ হাজার ২০৮ কোটি ডলার। এর মধ্যে পোশাকশিল্পের একক অবদান চার হাজার ২৬১ কোটি ডলার, শতকরা হিসাবে যার পরিমাণ ৮১.৮২ শতাংশ। একইভাবে ২০২২-২৩ অর্থবছরের চিত্রও প্রায় একই।

সুতরাং দেশের অর্থনীতিতে পোশাকশিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। কেউ বলে পোশাকশিল্পে অস্থিরতার পেছনে ষড়যন্ত্র আছে, কেউ বলে শ্রমিক অসন্তোষই কারণ। পোশাকশিল্পের মালিকরা শ্রমিকদের ওপর শোষণ ও বঞ্চনা চালালে, তার প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এই শ্রমিক অসন্তোষকে পুঁজি করে ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। সুতরাং বলা যায়, শ্রমিক অসন্তোষই অস্থিরতার মূল কারণ। এই আসল কারণটি আগে চিহ্নিত করতে হবে এবং তা সমাধানের কার্যকরী ও বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া বিকল্প যত পথই খুঁজি না কেন, তাতে সমাধান আসবে না।

শ্রমিকদেরকে দিয়ে জোর করে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালানো সম্ভব নয়। কারখানা চালাতে মালিকদের প্রয়োজন শ্রমিক। কিন্তু শ্রমিকরা যদি তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হয় এবং বৈষ্যম্য ও শোষণের শিকার হয় তাহলে তারা কখনো মালিককে সমর্থন করবে না; বরং বিদ্রোহ করবে। আর যদি শ্রমিক অসন্তোষ না থাকে তাহলে ষড়যন্ত্রকারীরা কিছুতেই ষড়যন্ত্র করার সুযোগ পাবে না। আর শ্রমিকরাও তখন ষড়যন্ত্রকারীদের পাতানো ফাঁদে পা দেবে না, নিজের কর্মরত শিল্পপ্রতিষ্ঠানে হামলা ভাঙচুর করবে না এবং উৎপাদন বন্ধ করবে না; বরং তারাই এক হয়ে সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেবে, ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিহত করবে।

মনে রাখতে হবে, প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতেই শ্রমিকদের উন্নতি। মালিক-শ্রমিক সুস¤পর্ক থাকলে পোশাকশিল্পে হামলা-ভাঙচুর, বিক্ষোভ আর নৈরাজ্য হবে না, উৎপাদনও ব্যাহত হবে না। মালিক ও শ্রমিক একে অপরের প্রতিপক্ষ হলে কোনো প্রতিষ্ঠানই সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না। তাই পোশাকশিল্পে অস্থিরতা বন্ধ করতে হলে প্রথমেই শ্রমিকদের প্রতি আন্তরিক হতে হবে, শ্রমিকদের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের প্রতি শোষণ, বঞ্চনা বন্ধ করতে হবে।

পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের বেশ কিছু দাবি রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- চাকরির নিয়োগপত্র প্রদান, নির্দিষ্ট সময়ে বেতন প্রদান, ওভারটাইম, সাপ্তাহিক ছুটি, ন্যূনতম মজুরি, মহিলাদের মাতৃত্বকালীন ছুটি, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার এবং কথায় কথায় চাকরিচ্যুতি বন্ধ করা, ইত্যাদি। এসব দাবি ন্যূনতম, মানবিক ও মৌলিক। ন্যূনতম বেতন না পেলে শ্রমিকরা চলবে কী করে? পোশাকশিল্পের মালিকরা হয়তো বলবেন, তারা যে বেতন দেন তাতে না পোষালে শ্রমিকরা চাকরিতে যোগ দেয় কেন? এটি সহজবোধ্য। পেটে যখন ক্ষুধা থাকে তখন যা পাওয়া যায় তাই গ্রহণ করতে মানুষ বাধ্য হয়। তার দরকষাকষির কোনো সুযোগ থাকে না। তবে দারিদ্র্য ও অসহায়ত্বের সুযোগ দিয়ে শ্রমিকদের কম বেতন দেবো- এটি তো হতে পারে না।

কিছু গার্মেন্টে নির্দিষ্ট সময়ে বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয় না। আর বেতন-ভাতা যদি সময়মতো পরিশোধ করা না হয় তাহলে তো তার পেট চলবে না। পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের ৮০ শতাংশই নারী। বলতে গেলে পুরো পোশাকশিল্পই দাঁড়িয়ে আছে নারীদের ওপর। মা হতে গেলে চাকরি হারাতে হবে- এ ভয়ে পোশাকশিল্পে কর্মরত অনেক মহিলা মা হতে চান না। তা ছাড়া সামান্য কিছু হলেই চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে এ শিল্পের শ্রমিকরা সবসময় আতঙ্কে থাকে। অনেক পোশাক কারখানায় পর্যাপ্ত টয়লেট নেই, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নেই, অগ্নিনিরোধক ব্যবস্থা নেই। আর এ অবস্থায় তো কোনো শ্রমিকের পক্ষে স্বতঃর্স্ফূততা ও স্বাভাবিকতা নিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়। সুতরাং পোশাকশিল্পে অস্থিরতার মূল কারণ শ্রমিকদের প্রতি শোষণ আর বঞ্চনা। তাই আসল সমস্যার সমাধান করতে হবে। শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার দিতে হবে এবং মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শ্রমিকের উৎপাদন থেকেই মালিকের মুনাফা হয়। এ বিষয়টি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।

সরকার শিল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইন্ডাস্ট্রি পুলিশ গঠন করেছে। কিন্তু এটি সব সমস্যার সমাধান নয়। পুলিশ কারখানার নিরাপত্তা দেবে, কিন্তু কারখানার মালিকের নিরাপত্তা দেবে কে?

পোশাকশিল্পের সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধান করার জন্য মালিক সমিতির সাথে সরকারকে একযোগে কাজ করতে হবে।

লেখক : প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক
omar_ctg123@yahoo.com

https://www.dailynayadiganta.com/opinion/794081