২৪ নভেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৩:৪৬

নতুন নামে ডাকো

কথায় বলে, ‘নতুন নামে ডাকো।’ আবার বিপরীত পক্ষের লোকজন বলেন, ‘গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক, তার সুগন্ধ একই থাকে।’ কিন্তু শুধু নিছক নাম নয়; নামের সাথে পরিচয়, সত্তা, স্বাতন্ত্র্য, বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি অনেক কিছু জড়িত। নামের পিছে রাজনীতিও আছে, যা ভারতে এখন চলছে হিন্দুত্ববাদী নরেন্দ্র মোদির শাসন আমলে।

গত শুক্রবার নয়া দিগন্তের প্রথম পৃষ্ঠার প্রথম কলামে একটি সংবাদ শিরোনাম চোখ এড়াতে পারে না, তাহলো ‘আলীগড়ের নাম বদলে হরিগড়।’ উত্তর প্রদেশের এই সেই বিখ্যাত শহর আলীগড় যেখানে বিখ্যাত স্যার সৈয়দ আহমদ খান ১৮৬৭ সালে মুসলিম অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ স্থাপন করেছিলেন যেটা বর্তমানে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়/ইউনিভার্সিটি (এএমইউ) নামে পরিচিত। এ পর্যন্ত ভারতের কোনো সরকারই এর স্বাতন্ত্র্যের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পারেনি, এমনকি ইন্দিরা গান্ধীও। শহরটি তার মুসলিম বৈশিষ্ট্য আজ পর্যন্ত ধরে রেখেছে, অথচ বিজেপি শাসিত হিন্দুত্ববাদী প্রাদেশিক সরকারের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের আমলে ভারতের সর্ববৃহৎ প্রদেশ উত্তরপ্রদেশের সেই খ্যাতনামা আলীগড়ের নাম বদলে দিতে চায়। তাহলে কি আমরা দিল্লিকে ‘ইন্দ্রপ্রস্থ’ ডাকব? নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির সরকার দেশকে পেছনের দিকে ঠেলে দিতে চায়। এটা ঐতিহ্যের পুনর্জীবন নয়; বরং আসলে পশ্চাৎদতা ও কূপমণ্ডূকতা।

 

আলীগড়ের নাম পরিবর্তন করে হরিগড় করার প্রস্তাব নাকি পাস হয়েছে। এবার গত ৭ নভেম্বর আলীগড়ের মেয়র প্রশান্ত সিংহাল এটা জানান (খবর : দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল)। আলীগড়ের মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের বৈঠকে এ প্রস্তাব পাস হয়। মেয়র আরো জানান, গত রোববার বৈঠকের সময়ে কাউন্সিলর সঞ্জয় পণ্ডিত আলীগড়ের নাম বদলের প্রস্তাব করেন। মেয়রের দাবিমাফিক, সব কাউন্সিলর হরিগড় নাম রাখার পক্ষে। ফলে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। এটা ‘দীর্ঘ দিনের’ দাবি বলেও মেয়র উল্লেখ করেন। মেয়রকে উদ্ধৃত করে শীর্ষস্থানীয় একটি সংবাদপত্র জানায়, ‘প্রস্তাবটি ২০২১ সালে জেলা পঞ্চায়েত সভায় অনুমোদন করা হয়েছিল। তখন এমনকি, সাম্প্রদায়িক মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথও এই বিষয় নিয়ে আর এগিয়ে যাওয়ার কোনো সাহস করেননি। তবে কেন্দ্রে ও প্রদেশে ক্ষমতাসীন বিজেপি নিয়ন্ত্রিত ‘নাগরিক সংস্থা’ এখন আবার নাম পরিবর্তনের বিষয়টিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পুনরুজ্জীবিত করেছে। সংবাদপত্র দাবি করেছে যে, আলীগড় এবং মঈনপুরী জেলা পরিষদ তাদের নাম পরিবর্তনের ‘দাবি জানিয়েছে’ গত বছর।

মঈনদুরী জেলা পরিষদ তাদের নাম বদলে মায়ানগর করার চেষ্টা করেছিল। পরিষদ সভাপতির মতে, ঋষি মায়ান মঈনপুর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাই এটার নাম বদলের চেষ্টা করা হয়েছে।

আসলে মোদি সরকার সব ক্ষেত্রেই হিন্দুত্বের ওপর জোর দিচ্ছে; এ জন্য সর্বসম্মত ইতিহাসকে অস্বীকার করে সাম্প্রদায়িকতাকে সবার ওপর চাপিয়ে দেয়ার জোর চেষ্টা চলছে। তাই এটাই প্রথম নয়, এর আগেও ভারতের বহুস্থান ও শহরের নাম বদলানো হয়েছে। অথচ মুসলমানসহ সংখ্যালঘুদের সাথে বিন্দুমাত্রও আলাপ করা হয়নি। জনগণের মতই নেয়া হয়নি।

২০১৮ সালে ৩০০ কোটি রুপিরও বেশি ব্যয়ে ঐতিহ্যবাহী এলাহাবাদ শহরের নাম পরিবর্তন করে ‘প্রয়াগরাজ’ রাখা হয় বিপুল অপচয় ঘটিয়ে। আসলে এলাহাবাদ নামে ‘আল্লাহ’ কথাটা ছিল। এখানেই নেহরু পরিবারের পৈতৃক নিবাস এবং ভারতীয় হাইকোর্টের শাখা অবস্থিত। ১৮৬৭ সালে স্থাপিত হয়েছিল উত্তর ভারতে ঐতিহ্যবাহী মুঘলসরাই জংশন। এর নাম বদলে সাম্প্রদায়িক দীনদয়াল উপাধ্যায় জংশন করা হয়েছে। এ দিকে ২০২১ সালে ফয়েজাবাদের নাম রাখা হয় অযোধ্যা জেলা। মুসলিম ঐতিহ্যবাহী উত্তরপ্রদেশের যোগী সরকার গোরকপুর শহরের উর্দুবাজারকে হিন্দিবাজার, হুমায়ুনপুরকে হনুমান নগর এবং আলীপুরের নাম বদলে আর্যনগর করেছে। ২০১৯ সালে স্বয়ং আদিত্যনাথ বলেছেন, তার বিজেপি সরকার নাম বদলের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আগ্রার একজন আইনপ্রণেতা ঐতিহাসিক শহর হলেও এর নাম পরিবর্তন করে আগ্রাবন বা আগারওয়াল করার প্রস্তাব করেছেন। অন্য একজন উত্তরপ্রদেশের মুজাফফর নগরের নাম বদলে লক্ষ্মীনগর করার প্রস্তাব করেছেন।

উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে রাজধানী নয়াদিল্লির ঐতিহ্যবাহী আকবর সড়কের নাম বদলে ফেলা হয়েছে। দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলা স্টেডিয়ামের নামও পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। কারণ এতে মুসলমানের নাম রয়েছে।

পাঞ্জাবের গুরগাঁওয়েরনাম (রাজধানী নয়াদিল্লির কাছে অবস্থিত এবং এখান থেকেই কংগ্রেসের সাবেক সভাপতি মওলানা আবুল কালাম আজাদ পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন) নাম পরিবর্তন করে গুরুগ্রাম রাখা হয়েছে। বোম্বে মহানগরের নাম পরিবর্তন করে মুম্বাই নামে এক কাল্পনিক দেবীর নামে রাখা হয়েছে বর্তমান মোদি আমলে। তাহলে কি বিহারের রাজধানী পাটনার নাম পাটলিপুত্র এবং কলকাতার নাম তার সাবেক নাম গোবিন্দপুরে ফিরে যাবে? বরং এর চেয়ে কলকাতার নাম আলীপুর/আলীনগর (নবাব সিরাজউদদৌলার আমলের) রাখাটাই যুক্তিযুক্ত। আসলে মুসলিম ঐতিহ্য ভারতের সব জায়গা থেকে উৎখাত করা হচ্ছে। এটাই হিন্দুত্ববাদী বিজেপির মিশন ও ভিশন।

 

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/793698