২২ নভেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৭:২১

একতরফা নির্বাচন, সম্ভাব্য ফলাফল

-সাকিব সাদমান

 

২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন কি একতরফা হতে যাচ্ছে? এ প্রশ্ন জনে জনে উচ্চারিত হচ্ছে। এই নিয়ে মিডিয়ায় শোনা যায় নানা আলোচনাও। একটি জাতীয় দৈনিককে দেয়া সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক বলেছেন, একতরফা নির্বাচন গণতন্ত্রকে আরো সঙ্কটে ফেলবে (প্রথম আলো, ১২ নভেম্বর)। গত ২৮ অক্টোবর প্রধান বিরোধী দলের সমাবেশ বিনা উসকানিতে ও অযৌক্তিকভাবে হটিয়ে দেয়া এবং দলটির প্রথম সারির নেতাদের জেলে ঢোকানোর মধ্যে প্রধান বিরোধী দলহীন আরো একটি নির্বাচন সম্পন্ন করার আভাস মিলছে। অধিকন্তু, সংলাপ বিষয়ে সরকারপ্রধানের কঠোর মনোভাব বিএনপিবিহীন নির্বাচনের বার্তায় সিলমোহর দিয়েছে বলেই অনেকে মনে করছেন। তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে; অথচ প্রধান বিরোধী দলের নেতারা জেলের ভেতরে। সবটা বিবেচনায় জনমনে ধারণা বাসা বেঁধেছে যে, আগামী নির্বাচনটি প্রধান বিরোধী দল ছাড়াই হতে যাচ্ছে।

 

বিএনপি না এলেই কি নির্বাচনটি একতরফা বিবেচিত হবে? এর জবাব এককথায় দেয়া যায় না, নানা ব্যাখ্যাও দেয়া সম্ভব যা নানা জনের কথায় উঠে আসবে বৈকি। এ কথায় দ্বিমত নেই যে, বিএনপি এখন দেশের প্রধানতম বিরোধী দল। বিগত নির্বাচনগুলোতে প্রাপ্ত ভোটের বিবেচনা ও নিকট অতীতে দু’বার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপালনসহ যেকোনো বিবেচনায় আওয়ামী লীগের পর বিএনপিই দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। অধুনা বিএনপির সাথে আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল জোট বেঁধেছে। সেটি আওয়ামী লীগের সাথেও আছে কিছু দল। ফলে একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কারোরই বর্তমান জনসমর্থনের ঠিক হার বলা মুশকিল। প্রসঙ্গত, বিভিন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ভোটপ্রাপ্তির হার যথাক্রমে এই রকমের- ১৯৭৯ সালে ২৪.৫৬ ও ৪১.১৭; ১৯৯১ সালে ৩০.০৮ ও ৩০.৮১; ১৯৯৬ (জুন) সালে ৩৭.৪৪ ও ৩৩.৬১; ২০০১ সালে ৪০.১৩ ও ৪০.৯৭; ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ (জোট) ৫৬.৩৫ ও বিএনপি (জোট) ৩৭.৬১ এবং ২০১৮ সালে ৭৪.৬৩ ও ১৩.০৬। এ পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, ২০১৮ সালের কথিত নৈশভোট ছাড়া বরাবরই বিএনপি দেশের দ্বিতীয় দলই আছে।

বিএনপিহীন নির্বাচন মানেই কমপক্ষে ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ ভোটার নিজ দলকে নির্বাচনে পাবে না এবং তারা ভোটকেন্দ্রেও যাবে না। ফলে নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হবে না। যারা রাজনৈতিক দল নয়; বরং জনভোটের অংশগ্রহণকেই কেবল অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ভাবছে, তাদের মন ও মগজে নিঃসন্দেহে হাতুড়ির আঘাত পড়বে।

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে প্রধান প্রধান দলকে নির্বাচনের বাইরে রেখে নির্বাচন করিয়ে নেয়া সম্ভব। এর উদাহরণ ১৯৮৮, ১৯৯৬ (ফেব্রুয়ারি) ও ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচনে যায়নি। এর ফলাফল ১৯৯১ সালে প্রতাপশালী এরশাদ সরকারের পতন হয়। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। ফলাফল, একই বছরে আরো একটি নির্বাচন। অবশ্য, বিরোধীদের দাবি মেনে নির্বাচনকালে একটি কেয়ারটেকার সরকার বিলের জন্যই বিএনপি নির্বাচনটি করেছিল। আর ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে সচেতনভাবেই যায়নি। আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনের পর নির্বিবাদে পাঁচ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। মোটা দাগে এর তিনটি কারণ দেখা যায়। ১. বিএনপি সেই নির্বাচনে জয়ী সরকারের বিরুদ্ধে যথার্থ অর্থে আন্দোলন করতে পারেনি। ২. সরকার রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহার করে বিএনপির আন্দোলন হঠাতে পেরেছে। ৩. এই নিয়ে আন্তর্জাতিক কোনো চাপ ছিল না। ফলে ১৯৮৮ সালের নির্বাচনের মত ২০১৪-এর বিরোধী দলহীন নির্বাচনের পরও সরকারকে সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়নি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ২০১৪ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সময়, ২০১৮-এর নির্বাচন-পরবর্তী সময় এবং বর্তমান সময় একই রকমের কিনা।

এ বছরই এশিয়ার একটি দেশ কম্বোডিয়ায় জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। এই মহাদেশে হুনসেন সর্বাপেক্ষা বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আসীন। ৩৮ বছর। অবশ্য ২০২৩-এর নির্বাচনের পর ছেলের হাতে মসনদ ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার ক্ষমতা ধরে রাখার প্রশ্নে অগণিত অপকৌশল প্রয়োগের চেষ্টা করবেই। হুনসেনও সবটাই করেছিলেন। প্রধান বিরোধী দলকে হুনসেন নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন। কম্বোডিয়ায় গণতন্ত্র সঙ্কুচিত এবং নিপীড়ন-নির্যাতন করে প্রধান বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাইরে রেখেছেন। আর প্রশাসনযন্ত্র ব্যবহার এবং মধু-গুড় খাওয়া কয়েকটি ছোট দলকে ভিড়িয়ে নির্বাচনে আনতে সক্ষম হন। হুনসেনের দল নির্বাচনে ১২৫ আসনের মধ্যে ১২০টিতে জিতে পুনরায় ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে অনুরূপ একটি নির্বাচনে গণবিচ্ছিন্ন ও মেরুদণ্ডহীন ১৭ দল অংশ নিয়ে একটি আসনেও জিততে পারেনি। কিন্তু প্রধান বিরোধী দল ছাড়া প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচন বিশ^ব্যাপী নিন্দিত হয়েছে এবং কম্বোডিয়াকে এসব মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এমন ধারণাও দেখা দিতে পারে, কম্বোডিয়ার শাসকগোষ্ঠী সব চাপের মোকাবেলা করতে পারলে আমরাও পারব। এখানে বলে নেয়া দরকার, কম্বোডিয়ার ২০২৩ সালের পাতানো নির্বাচন যারা ভালোভাবে নেয়নি, তাদের মধ্যে আমেরিকা অন্যতম- কে না জানে, আমেরিকার পদক্ষেপকে আরো কয়েকটি দেশ হুবহু অনুসরণ করে থাকে। কম্বোডিয়ার মতো দূরবর্তী একটি দেশের জন্য আমেরিকার শাস্তিমূলক ব্যবস্থার মধ্যে অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ অন্যতম। আমেরিকা সে দিকেই গেছে। উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সব অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেও টিকে আছে কেবল চিন-রাশিয়ার সাথে গভীর সম্পর্কের কারণে। ইরানও পেরেছে। স্যাংশনে কাবু হয়নি নাইজেরিয়া। কিন্তু আমাদের দেশের সাথে আমেরিকা ও আমেরিকার একান্ত অনুসারী দেশগুলোর অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক বিষয়-আশয় এবং আমেরিকার সাথে ভূ-রাজনৈতিক ব্যাপারগুলোর ওপর নির্ভর করবে আমরাও কম্বোডিয়ার মতো পারব কিনা। এখানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশের সাথে আমাদের বাণিজ্যের মাত্রা, এফআইডি, রোহিঙ্গাদের জন্য ওসব দেশের অনুদান, বিশ^ব্যাংক-এডিবি-আইএমএফের ভূমিকা এবং পিসকিপিংও বিবেচনায় আসবে। আসবে চীনের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্যের প্রসঙ্গটিও।

২০১৪-এর নির্বাচনে বিএনপি না এলেও কয়টি বিরোধী দল ছিল। আদপে, ভোটারহীন একটি নির্বাচনের আয়োজন হয়েছিল ৭২.১৪ শতাংশ ভোট নিয়ে ২৩৮ আসনই ছিল আওয়ামী লীগের। বাকি আসনের সব কটিই আবার আওয়ামী লীগের মিত্রদের। ফলে সংসদে বিরোধী দল বলতে যা বোঝায়, ছিলই না। এখানে ২০০৮ সালের নির্বাচনে জিতে আসা সরকারের একটি যুক্তি ছিল, কেউ নির্বাচনে না এলে নির্বাচন বন্ধ রাখা যায় না। আর নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপির কথা ছিল, আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কেয়ারটেকারের মতো একটি ব্যবস্থা বাতিল করেছে কেবল নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘ সময়ের জন্য স্থায়ী করতেই। বিএনপির এই দাবি অসার নয় এবং পরবর্তী ২০১৮-এর নির্বাচনে সেটিই প্রমাণিত হয়েছে। এখন এই কথা তো রাজনৈতিক প্রপঞ্চে রূপ নিয়েছে যে, ক্ষমতায় আসীন থেকে নির্বাচন করলে হারার সম্ভাবনা নেই এবং দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন বস্তুত এই দেশের নির্বাচনব্যবস্থায় ধস নামিয়েছে। রাষ্ট্রীয় মেশিনারি ব্যবহার করে এমন একটি নির্বাচন করা হলো, যা বিশ^ব্যাপী একটি চর্চার পরিসরে মোড় নিয়েছে। কথিত হয়েছে ‘নৈশ নির্বাচন’ অভিধায়। লাখ লাখ নতুন ভোটার তথা তরুণ ভোটারসহ সাধারণ মানুষ ভোট দিতে পারেনি। আওয়ামী লীগ একাই ৭৪.৬৩ শতাংশ ভোট নিয়েছে, আসন ২৭৩। বিএনপি ১৩.০৬ শতাংশ ভোট পেয়ে সাতটি আসন পেয়েছে- অতীতের যেকোনো নির্বাচনের সাথে তুলনা করলে বিএনপির এই ভোটপ্রাপ্তি যায় না। বিশাল কারচুপির এটিই বড় প্রমাণ। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতির পিতার একান্ত সংসদীয় আসনটিতেও সকাল-সন্ধ্যা ঠিকঠাক ভোট হয়নি বলে অভিযোগ শোনা গেছে; এ বড় কষ্টের কথা! আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতাকর্মীর মধ্যে এই নিয়ে অপ্রকাশিত চাপা ক্ষোভ কান পাতলেই বুকে ধ্বনিত হতে পারে। এসব কারণেই হয়তো আভাসে-ইঙ্গিতে একটি ভালো নির্বাচনের কথা হচ্ছে। কিন্তু বিরোধী দলকে ২০১৮ সালেও কথা দেয়া হয়েছিল। আওয়ামী লীগ সেটি পরিপালন করেনি। ২০১৪-এর নির্বাচনের পরও দ্রুত সময়ে নির্বাচন দেয়ার প্রতিশ্রুতি আওয়ামী লীগ রক্ষা করেনি। ফলে সরকারের তরফে একটি ভালো নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি নিদেনপক্ষে বিএনপির কর্ণকুহরে যৌক্তিক কারণেই প্রবেশ করার কথা না। অন্যদিকে সারা দেশে আওয়ামী লীগের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী একটি ভালো নির্বাচনের জন্য সহায়ক কি না ভেবে দেখার আছে। এই সাথে বিরোধী দল মনে করে, সরকারের সমুদয় হাতও একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়ার পক্ষে বড় বাধা। বস্তুত, গত মাসে বিএনপির সমাবেশ পণ্ড করা এবং নেতাদের পাইকারি হারে জেলে নেয়ার পর বিএনপির নির্বাচনে আসার সামান্য সম্ভাবনার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া হয়েছে।

বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচনের আয়োজন কার্যত একতরফা নির্বাচনই। বিএনপির সাথে যেসব দল জোট বেঁধেছে সম্মিলিতভাবে তাদের ভোটের সংখ্যা ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। এই আধেক মানুষের ভোটে অংশগ্রহণ না করা একদিকে একতরফাকেই মান্যতা দেয়।
তাহলে বিএনপি ছাড়া নির্বাচন হয়ে গেলে কী হতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর সময়ই বলে দেবে। নানা দল ও প্রার্থীকে নির্বাচনে নিয়ে আসা সরকারের জন্য সহজ কাজ। সংসদ সদস্য হয়ে গেলে কী কী সুবিধা হয়, তা সবার জানা। কোথায় কোথায় গুড়-বাতাসা-সন্দেশ পাওয়া যায়, তাও অজানা নয়। ফলে এমপি হওয়ার জন্য মানুষের অভাব নেই। কয়েকটি নামসর্বস্ব দল মুখিয়ে আছে। বিএনপি থেকে কতিপয়কে নিয়েও নির্বাচন হতে পারে। তাতে ভোট প্রদানের হার একটুও বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ নেই- এসব জনবিচ্ছিন্ন ও মেরুদণ্ডহীনদের কে ভোট দিতে যাবে? আওয়ামী লীগের ভোট তো তাদের বাক্সে পড়বে না- কাজেই প্রার্থী থাকবে, ভোটার পাওয়া যাবে না। কিন্তু বিশ^ মোড়লদের কাছে এ ধরনের নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে কিনা প্রশ্ন সেখানে। ২০১৮-এর নির্বাচনের আগে এই দেশে সুষ্ঠু ভোট নিয়ে আমেরিকা সেভাবে কিছু বলেনি। এবার বলছে। জাতিসঙ্ঘ ছাড়াও যুক্ত হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কথা বলছে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে আমেরিকা চূড়ান্ত বিচারে কী করবে, সে তো জানা যাচ্ছে না। তবে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে সম্ভাব্য জটিলতার দায় তো বর্তমানের সরকারের ওপরই বর্তাবে।
একতরফা ও অগ্রহণযোগ্য আরো একটি নির্বাচন হলে গণতন্ত্র নির্ঘাত হেরে যাবে।

 

 

 https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/793209