১৭ নভেম্বর ২০২৩, শুক্রবার, ৩:৪০

তাহার কথা অমৃত সমান

-ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী

আওয়ামী লীগের সুদর্শন স্টাইলিস্ট সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত ৮ নবেম্বর বলেছেন, বিএনপির তথাকথিত রাজনৈতিক কর্মসূচি ও অবরোধের নামে সন্ত্রাসী কর্মকা- অব্যাহত রয়েছে। গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তি বিএনপির গণতান্ত্রিক পন্থায় আন্দোলনের শক্তি ও সামর্থ্য নেই বলেই তারা বরাবরের মতোই অগ্নিসন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। তিনি বলেন, তারা ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের মতো অগ্নিসন্ত্রাসের নির্দয় আগুনের লেলিহান শিখায় পোড়াচ্ছে সারাদেশ ও এবং মেতে উঠেছে নির্বিচার ভাঙচুর ও সহিংসতায়। তিনি এক লিখিত বিবৃতিতে বলেন, তথাকথিত আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েও বিএনপি তার চিরাচরিত নির্লজ্জ মিথ্যাচারের ধারা অব্যাহত রেখেছে। কাদের বলেন, অগ্নিসন্ত্রাস, সহিংসতা ও নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সাধন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিনষ্ট করা, মানুষ হত্যা, যানবাহনে অগ্নিসংযোগের মতো ধ্বংসাত্মক অপরাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। তথাকথিত সরকার পতনের আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের অন্তরের জ¦ালা কয়েক গুণ বেড়েছে। ব্যর্থতার সেই আগুনে তারা বাংলার জনগণের আগামীর সম্ভাবনাকে পুড়িয়ে ছাই করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। তাদের অগ্নিসন্ত্রাস থেকে জীবন্ত ও ঘুমন্ত মানুষ নারী ও শিশু কেউই রেহাই পাচ্ছে না। গণতন্ত্রের নামে বিএনপি লাশের রাজনীতি করছে। এদেশে রাজনীতিতে মানুষ পুড়িয়ে মারার যে পৈশাচিকতার প্রচলন বিএনপি করেছে, তা সভ্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিপন্থী।

কাদের বলেন, সন্ত্রাসী সংগঠন বিএনপি নেতারা ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনের নামে লাগাতার মিথ্যা অপপ্রচার ও গুজব সৃষ্টি করছে। সরকারের দায়িত্ব হলো জনগণের নিরাপত্তা রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এসব ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি নেতারা তাদের দলীয় নেতা কর্মীদের গ্রেফতার ও গুমের মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করছেন। আসলে বিএনপির সন্ত্রাসী, কর্মীরা যারা যানবাহনে অগ্নিসংযোগ ভাঙচুর সন্ত্রাস ও নাশকতা চালাচ্ছে, জনগণের জানমালের উপর হামলা চালাচ্ছে তারা নিজেরাই গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে থাকছে। অথচ বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে বরাবরের মতো গুমের মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করছে।

তিনি বলেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাজনৈতিক নেতাকর্মীর বিবেচনায় নয় কেবল সন্ত্রাসী কর্মকা-ে জড়িতদেরই গ্রেফতার করছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, আওয়ামী লীগ কখনো গুম, খুন, অগ্নিসন্ত্রাস ও বিরোধীদল দমনের রাজনীতি করে না। তিনি আরো অনেক সুললিত কথা বলেছেন। সেসব কথা লিখতে গেলে যে পরিসরে এই লেখাটি লিখছি তার দ্বিগুণ তিনগুণ পরিসরে শেষ হবে না।

কল্পনার চোখে আমি ওবায়দুল কাদেরের এই ভাষণটি টিভিতে দেখতে চেষ্টা করলাম। তার কথার সুর, প্রকাশের মাধুর্য ডান কিংবা বাম হাতের তর্জনী তুলে অবিরাম ডানে বায়ে মাথা নেড়ে তিনি কথা বলছে। ভেবে দেখুন কি সুন্দরই না তার এই ভাষণ। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বনি¤œ পর্যায় পর্যন্ত নেতারা অবিরাম মিথ্যে কথা বলেন। এতে তাদের চোখের পাতা একটুও কাঁপে না। ওবায়দুল কাদেরের বিবৃতিতে যেসব কথা উদ্ধৃত করা হয়েছে তা সর্বৈব মিথ্যাচার। আওয়ামী লীগ দাবি করে যে, হত্যার মধ্য দিয়েই বিএনপির রাজনীতি শুরু। এটা যে প্রমাণ করা দরকার সেদিকে কেউ ভ্রুক্ষেপই করে না। এখন আওয়ামী লীগ বলে যে, বিএনপি ১৯৯১-১৯৯৬ শাসনকালে নাকি তাদের ২১ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। এখন তো সব পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশন আওয়ামী লীগের হাতেই রয়েছে। কোনো একটা কাগজে নামগুলো ছেপে দিন তো দেখি। কিংবা একটি ক্রোড়পত্র বানিয়ে সবগুলো কাগজে ছেপে দিন। লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা তো গায়েব করে দিচ্ছেন। এরকম ক্রোড়পত্র ছাড়তে দুই/তিন কোটি টাকার বেশি লাগবে? এরকম একটি তালিকা কোনো একটি পত্রিকা ধরে অনুসন্ধান করে, তাহলে দেখা যাবে গোটা তালিকাটাই ভুয়া আবার একে যদি সত্য বলে ধরে নেয়া হয় তাহলে জাসদ যে দাবি করছে, শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালে ৩০ হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে, সেটাকেও সত্য বলে মেনে নিতে হবে।

সময়ে সময়ে সরকার দাবি করে বিএনপি, জামায়াত সন্ত্রাস চালাচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কিন্তু সমাবেশ মহাসমাবেশ আয়োজনে যেসব হাঙ্গামা হয়েছে তার প্রায় প্রতিটির জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ-যুবলীগ।

আর অগ্নিসন্ত্রাস? ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগ যেসব অগ্নিসন্ত্রাসের অভিযোগ করেছে, অনুসন্ধানে দেখা গেছে তার প্রায় সব ঘটনাই ঘটিয়েছে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংঘটনগুলোর নেতা কর্মী।

ওবায়দুল কাদের বলেছেন আওয়ামী লীগ কখনো গুম, খুন ও বিরোধীদল দমনের রাজনীতি করে না। গুম যে করে তাতো জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশন এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ সকল পশ্চিমা দেশ একযোগে সোচ্চার হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের বিরুদ্ধে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। অন্তত ৬১ জন গুম ব্যক্তির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। পুলিশের সঙ্গে পুলিশের পোশাক পরা যেসব ব্যক্তি বিরোধীদলের উপর হামলা চালায়, তারা সরকার সমর্থক বলে মন্তব্য করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। তাদের হাতে দেখা গেছে পিস্তল, রাইফেল, রামদাসহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র। অনেক সময় দেখা যায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের হামলায় আহত হয়েছেন বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধীদলের শত শত নেতাকর্মী। বিএনপির মহাসমাবেশের প্রাক্কালে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন যে, বিএনপি যদি বাড়াবাড়ি করে তবে তাদের পরিণতি শাপলা চত্বরের চাইতেও ভয়াবহ হবে।

২০১৩ সালে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশ ডেকেছিলো হেফাজতে ইসলামী। সেখানে মধ্যরাতে ব্রাশ ফায়ার করে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়। সরকার স্বীকার করে ছিলো যে অন্তত ১১ জন সেদিন খুন হয়েছিলো। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ অন্তত ৬১ জনের তালিকা প্রকাশ করেছিলো বলে তাদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে দেওয়া হয়। সংগঠনের দুই শীর্ষ নেতা আদিলুর ও এলানকে কারাদন্ড দেওয়া হয়। পরে অবশ্য আন্তর্জাতিক চাপে তাদের জামিন দেওয়া হয়েছে। এদিকে শেখ হাসিনা পিলে চমকানোর মতো কথা বলেছেন। তিনি তার দলের সন্ত্রাসীদের এই বলে উস্কে দিয়েছেন যে, কেউ যদি কোথায়ও আগুন দেয়, তবে তাদের ধরে সেই আগুনে নিক্ষেপ করতে হবে। আর যে আগুন দেয় সে হাত ঐ আগুনে পুড়িয়ে দিতে হবে। কী ভয়ঙ্কর এখন থেকে তার সোনার ছেলেরা যে কোনো বাড়িতে আগুন দিয়ে ফের মানুষ পুড়িয়ে মারতে শুরু করবে।

ওবায়দুল কাদের বলেছেন আওয়ামী লীগ বিরোধীদল দমনের রাজনীতি করে না। তাহলে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ২৫ হাজার মামলা কী করে হলো। যার আসামী ৫০ লক্ষ। হয়রানিমূলক মামলায় আসামী ৫০ লক্ষ। কারো কারো নামে তিন-চারশ’ পর্যন্ত মামলা হয়েছে। বিএনপি’র শীর্ষ স্থানীয় সকল নেতা গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাড়া করা হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীদের বাড়িতে গিয়ে হানা দিচ্ছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। একথা এখন সত্য প্রমাণিত হয়েছে যে, “বাংলাদেশ এক বিশাল কারাগার।” মামলাগুলো এমনভাবে করা হয় যাতে অজ্ঞাত আসামী করা হয় শ’শ’ লোককে। গ্রেফতার এড়াতে হয় তারা আত্মগোপন করেন না হয় ধরা পড়ে জেলে ঘানি টানেন।

কিন্তু তাতে বিএনপি বা জামায়াতের জনসমাবেশে লোক আসা বন্ধ হয়নি বরং বেড়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, সরকারের প্রতি মানুষের ঘৃণা প্রবলতর হয়েছে। শেখ হাসিনাও শেষ পর্যন্ত স্বীকার করেছেন যে, দেশে কিছু মানুষ আছে যারা চায় না আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় আসুক। এখন আর বলা যাবে না যে এরা ‘কিছু’ মানুষ বরং দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ।

গত ১০ নবেম্বর দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় “পেট লইয়্যাই বাঁচি না জামিন করমু কীভাবে” শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তাতে একজন রিক্সা চালকের মা বলেছেন কারাগারে আটক তার ছেলের রিক্সার আয়ে তার সংসার চলতো। এখন হিমশিম অবস্থা। তার দাবি ছেলেকে শুধু একবার দেখতেও পুলিশকে ৫০০শ টাকা দিতে হবে। এক টাকা কমেও হবে না। রিক্সা চায়ের দোকানের সামনে রেখে সে দোকানে চা খাচ্ছিল। তখন পুলিশ তাকে তুলে নেয়। তার মা বিলকিস বেগম বলেন, ‘কার কাছে বিচার দিমু গরিবের কথা কে শুনবে।’ ক্যান্টনমেণ্ট থানার ১৫ নং ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি শহিদুল। রাতের বেলা পুলিশ ডাকাতের মতো এসে তাকে  টেনে-হিঁচড়ে থানায় নিয়ে যায়। কারণ জানতে শহিদুলের স্ত্রী থানায় যান ১৮ অক্টোবর রাতে। তখন পুলিশ তার স্ত্রীকেও গ্রেফতার করে। বাড়াবাড়ি করলে তার ছেলেকেও গ্রেফতার করা হবে বলে পুলিশ হুমকি দেয়। তার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মেহেদি হাসান জানান, ছাত্র লীগ নেতা রিফতিহাসান রনির কাছে তারা কিছু টাকা পান। সে টাকা ফেরত চাওয়ায় রনি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং পুলিশ দিয়ে তার বাবাকে গ্রেফতার করায়। গ্রেফতারের সময় সেখানে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন।

গত ৫ অক্টোবর অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে যাত্রাবাড়ির আইডিয়াল স্কুল গেট এলাকা থেকে গ্রেফতার হন জাকির হোসেন। চলন্ত বাস থামিয়ে জাকিরের সঙ্গে আরো কয়েকজনকে তুলে নিয়ে যায় থানা পুলিশ। তাকে বিস্ফোরক মামলা দিয়ে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। জাকিরের মা বলেছেন, আমার ছেলে কেন গ্রেফতার হইবো ? শুধু শুধু ওকে ধরে নিয়ে বিএনপির মামলা দিছে। জাকিরই ছিলো সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এখন সংসার প্রায় অচল। ছেলেটাকে নাকি পুলিশ অনেক মারধর করেছে।

৩ অক্টোবর আদাবর থানার স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বয়াক মানিককে দোকান থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার কোনো খোঁজ ছিল না। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন সে এখন কাশিমপুর কারাগারে বন্দি। পত্রিকায় লিখেছে প্রতিদিন সকালে হাজতখানার সামনে স্বজনদের এক নজর দেখার জন্য ভিড় করেন শত শত লোক। আদালত সংশ্লিষ্টের খবর ২৮ শে অক্টোবর থেকে ৯ ই নবেম্বর এই ১৩ দিনে বিএনপির ৩০১৯১ জন নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছেন। কেউই জামিন পান নি। দু’একজন জামিন পেলেও অন্য মামলায় জেলগেট থেকে আবার জেলে পাঠানো হয়েছে। অনেকে উচ্চ আদালতে জামিন পেলেও একই পদ্ধতিতে তাদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হচ্ছে।

এই ওবায়দুল কাদের সাহেব, এগুলো কী বিরোধী দল দমনের রাজনীতি নয়? 

 

https://www.dailysangram.info/post/540860