১৫ নভেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৪:৪০

কঠিন শর্তে তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ নিচ্ছে সরকার

জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় ১৪০ কোটি, বাজেট সহায়তায় ৮০ কোটি ডলার

 

জ্বালানি তেল ক্রয় ও ঘাটতি বাজেট পূরণসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের জন্য প্রায় ২৯৮ কোটি (প্রায় ৩ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার ঋণ নিচ্ছে সরকার। রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে এই ঋণ নেওয়া হচ্ছে। সবগুলো ঋণই অনমনীয় অর্থাৎ কঠিন শর্তের। এর মধ্যে শুধু জ্বালানি তেল কেনার জন্যই ১৪০ কোটি ডলার ব্যয় হবে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি এসব ঋণের নয়টি প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছেন অনমনীয় ঋণসংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির (এসসিএনসিএল) সভাপতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আইনগত প্রক্রিয়া শেষ করে এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সঙ্গে ঋণের চুক্তি স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরের আগে এসসিএনসিএল বৈঠকে প্রস্তাব অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু এসব ঋণের ক্ষেত্রে সময়ের স্বল্পতা ও জরুরি বিবেচনায় এসসিএনসিএল বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়নি। তবে আগামীতে অনুষ্ঠেয় অনমনীয় ঋণ সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠকে তা অবহিত ও ভূতাপেক্ষ অনুমোদনের শর্তে ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।

সূত্র মতে, সামাজিক সুরক্ষায় ২৫ কোটি ডলার, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে প্রায় ২৮ কোটি ডলার, গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পে ১০ কোটি ডলার, বাজেট সহায়তা হিসাবে ৮০ কোটি ডলার, জ্বালানি পণ্য আমদানিতে ১৪০ কোটি ডলার, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলওয়ে প্রকল্পে ৪০ কোটি ডলার, যমুনা নদী ব্যবস্থাপনায় ১১ কোটি ডলার ও পানির উৎস ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে ৪ কোটি ডলার নেওয়া হয়। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর থেকে ১২ জুন অর্থাৎ গত সাত মাসে কঠিন শর্তের অনমনীয় ঋণের নয়টি প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যদিও সরকার বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে যে মধ্যমেয়াদি কৌশলপত্র তৈরি করেছে সেখানে নমনীয় উৎস অর্থাৎ সহজ শর্তে স্বল্প সুদে থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার কথা বলা আছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, কম সুদে বিদেশি ঋণ এখনই মিলছে কম, সামনের দিনে তা আরও কম পাওয়া যাবে। তবে নতুন ঋণের সুদ হার হচ্ছে বাজারভিত্তিক। এমন প্রেক্ষাপটে ঋণের সদ্ব্যবহার করে সর্বোচ্চ লাভ পেতে কৌশলী হওয়ার পরামর্শ এসেছে অর্থনীতিবিদদের।

জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ যুগান্তরকে জানান, জ্বালানি তেল অর্থনীতির ব্লাড বলা হয়। অনমনীয় ঋণ নিয়ে জ্বালানি তেল কেনা হলে সমস্যা নেই। কারণ এই মুহূর্তে বিকল্প পথও নেই। ঋণ করতেই হবে। তবে বিদেশি ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে দেশের রেকর্ড ভালো। তিনি আরও বলেন, এরপরও ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে বুঝে নিতে হবে। এখন ডলার সংকট চলছে। ঋণ নিয়ে জ্বালানি আমদানি করা হলে রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে জানান, জ্বালানি তেল কেনার ঋণ সাপ্লাই ক্রেডিট হওয়ার কথা। তবে এক্ষেত্রে অনমনীয় ঋণ না নিলে রিজার্ভ ভেঙে আমদানি ব্যয় মেটাতে গিয়ে চাপ সৃষ্টি হতো। এতে অর্থনীতিতে আরও সংকট হতে পারত। এই ঋণ কঠিন হলেও রিজার্ভের চাপ কমাতে সহায়ক হবে। তবে আগামীতে ঠিকমতো পরিশোধ করতে না পারলে চাপ বাড়বে। এমনিতে আগের নেওয়া ঋণের কিস্তি ২০২৭ সালে পরিশোধে চাপ বাড়বে। এসব ঋণ তখন যোগ হবে। তিনি আরও বলেন, এই সময়ে ডলারের ঘাটতি পূরণের জন্য বিকল্প উপায় নেই। তবে বৈদেশিক মুদ্রার আয় যেগুলো দেশে আসে না যেমন গত বছর ৫৫ বিলিয়ন রপ্তানি করে আসছে ৪৬ বিলিয়ন ডলার। রেমিট্যান্স প্রত্যাশার চেয়েও কম। এগুলো বাড়ানো গেলে কঠিন ও বেশি সুদের ঋণ এড়ানো সম্ভব হবে। এজন্য কিছু আর্থিক নীতি আছে সেগুলো ঠিক করতে হবে। বিশেষ করে মুদ্রা বিনিয়ম নীতি বাজারভিত্তিক করতে হবে।

সূত্র মতে, ইআরডি, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ, বিপিসি, অর্থ বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি সমম্বয়ে গঠিত কমিটি বৈঠক করেছে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি) টিমের সঙ্গে। গত ২১ মার্চ বৈঠকটি হয় মূলত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য জ্বালানি পণ্য আমদানির জন্য। ওই বৈঠকে ১৪০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ আইটিএফসি গ্রহণের বিষয়ে উভয়পক্ষ একমত হয়। অনমনীয় শর্তের এই ঋণটি ৬ মাস মেয়াদি।

সূত্র আরও জানায়, বাজেট সহায়তা হিসাবে ৮০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের আর্থিক ব্যবস্থা মজুত করে জনগণের কাছে সেবা সহজে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ৪০ কোটি ডলারের ঋণ নেওয়া হয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে। এই অর্থায়নে নতুন আয়কর কোড, সরকারি ক্রয় কর্তৃপক্ষ অ্যাক্ট ও নিরাপদ লেনদেন পদ্ধতি অ্যাক্ট বাস্তবায়ন করা হবে। ১৫ বছর মেয়াদে এই ঋণের গ্রেজ পিরিয়ড তিন বছর। এর মধ্যে অনুদানের অংশ দশমিক ৮১ শতাংশ। এছাড়া এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে নেওয়া হয়েছে ৪০ কোটি ডলার। এ ঋণ নেওয়ার প্রেক্ষাপটে বলা হয়, কোভিড-১৯. রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও পরবর্তী চলমান অর্থনৈতিক মন্দার ফলে দেশের অর্থনীতি চাপের মুখে পড়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগত, আমদানি পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন। এই চাপ সামলানোর জন্য বাজেট সহায়তা হিসাবে এ অর্থ নেওয়া হয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, এআইআইবি থেকে পৃথক ২৫ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয় সামাজিক নিরাপত্তা, সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে যুক্ত করা এবং জীবনচক্রে সামাজিক ও স্বাস্থ্য চাহিদার প্রতি রেসপন্স সিস্টেম শক্তিশালীকরণে। এছাড়া গাজীপুর থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট অবকাঠামো নির্মাণে এডিবি থেকে নেওয়া হচ্ছে ১০ কোটি ডলার। এই ঋণের মেয়াদ ২০ বছর। আর দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার এবং রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে গুনদুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়েলগেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পে এডিপি থেকে নেওয়া হচ্ছে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার।

বর্তমানে কম সুদের বা নমনীয় ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ২ শতাংশের মধ্যে রয়েছে। আর বাজারভিত্তিক (ফ্লোটিং রেট) ঋণের ক্ষেত্রে সোফর (দ্য সেকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেট) এবং এর সঙ্গে অন্যান্য ফি ও চার্জ হিসাব করে সুদ নির্ধারণ করা হচ্ছে। ইআরডির বিশ্লেষণ বলছে, বর্তমান ধারা বজায় থাকলে ২০২৬ সালে বাজারভিত্তিক ঋণের অংশ হবে ৪২ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০৩১ সালে তা মোট ঋণের ৫৫ দশমিক ৭ শতাংশে এবং ২০৪১ সালে তা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৮২ শতাংশে। অপরদিকে ২০২৬ সালে গিয়ে সস্তা ঋণের সুযোগ কমে নেমে আসবে ৪৬ শতাংশে। ২০৩১ সালে তা আরও কমে ২৫ শতাংশে এবং বর্তমান অগ্রগতি বজায় রেখে ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর লক্ষ্য বাংলাদেশ অর্জন করলে তা ৪ শতাংশে নেমে আসতে পারে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/740260