২৩ অক্টোবর ২০২৩, সোমবার, ৬:১৪

সঙ্ঘাত নয় চাই সংহতি

অধ্যাপক -ডা: শাহ মো: বুলবুল ইসলাম

ক’দিন আগের একটি ঘটনা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। চট্টগ্রামের একজন ছাত্র তার বাবা ভিন্ন দল করার কারণে বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। সে নিজে উপজেলা ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় হওয়ায় পিতার রাজনৈতিক ভিন্নতা সহ্য করতে পারেনি। যে রাজনীতি পিতা-পুত্রের স্বাভাবিক সম্পর্কের মাঝখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়; এই রাজনীতির আদর্শপুষ্ট তারুণ্য জাতিকে ভবিষ্যতে কোন পথে নিয়ে যাবে ভাবলে গা শিউরে ওঠে। জাতীয় নেতা, সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, শিক্ষক, সংস্কৃতিককর্মীরা এ ব্যাপারে কিছু বলছেন না। একেবারে মুখে তালা লাগিয়ে বসে আছেন। ভাবখানা এমন- এটি কোনো ঘটনাই নয়। জাতীয় নেতারা দল-মত নির্বিশেষে জাতির গৌরব, জাতির অহঙ্কার, জাতির অভিভাবক। জাতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে, ভবিষ্যৎ কারিগরদের জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করানোর দায়িত্ব তাদের। তাদের এ ভূমিকার জন্য তারা মহিয়ান গরিয়ান হয়ে ইতিহাসে স্থান করে নেন। কিন্তু যখন এর ব্যত্যয় ঘটে তখন তারা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হন। এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে নিকট অতীতে। ইরানের রেজা শাহ, আফগানিস্তানের দাউদ, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার গাদ্দাফি, চেকশ্লোভাকিয়ার মার্শাল ব্রজ টিটো, চিলির পিনোসের ঘটনাগুলো নিকট অতীতের। তারা একদিকে যেমন নিজেরা সঙ্কটে পড়েছিলেন; সাথে সাথে পুরো জাতিকে সঙ্কটে ফেলেছিলেন। যার প্রভাব এখনো এসব জাতিকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

উপরে উল্লিখিত ঘটনাটি আপাত ছোট মনে হতে পারে। কিন্তু এর প্রভাব অত্যন্ত গভীর। সমাজে, পরিবারে, জাতিগত পরিচয়ে আমরা আজ কোথায়? ঘটনাটি তার সাক্ষী হয়ে সতর্কবার্তা দিচ্ছে জাতিকে। আমাদের তরুণ প্রজন্ম যারা তাদের চিন্তা-চেতনায় ভাবনায়, স্বপ্নে, দেশপ্রেমে নিজেকে দীক্ষিত করবে, ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেবে, দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নেবে আলোকোজ্জ্বল পথে, তারা কি মানসিকতায় বড় হচ্ছে তার প্রকাশ এই ঘটনা। তারুণ্য এবং ভবিষ্যৎ অভিযাত্রায় আমরা কোথায় তা ওই ঘটনার আলোকে ভাবা দরকার। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবাটা এখন দূরের কথা, সবাই এখন শুধু নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত। আখের গোছানোর এ প্রতিযোগিতায় তারুণ্য ও সৃষ্টির ঝলমলে আলোর অপার সম্ভাবনাময় তরুণরাও পিছিয়ে নেই। এ প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতে, আখের গুছিয়ে নেয়ার নেশায় তারা নির্দ্বিধায় শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতা, শিক্ষকের মর্যাদা, সর্বোপরি জীবনের মর্যাদাকে কলঙ্কিত করতেও সঙ্কোচ বোধ করে না। পরিবার, সমাজ, জাতি, অফিস-আদালত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়, বিচারালয় আজ ক্ষমতা চর্চার অবাধ, অবৈধ ও অনৈতিক লীলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষাঙ্গনগুলোও এর বাইরে নেই। মূল শিক্ষা ছেড়ে আমাদের তরুণ প্রজন্ম এখন ক্ষমতার নিঃশর্ত প্রহরী। এখন পিতা, পুত্র, ভাই, বোন, এমন কি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে বিভাজন। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মাতো গভীর খাদ।

ষাটের দশকে চট্টগ্রাম এলাকায় দেখেছি ওহাবি সুন্নি বিরোধ। এদের এক সম্প্রদায়ের সাথে আরেক সম্প্রদায় সম্পর্ক রাখত না, একজন আরেকজনের বাড়ি যেত না, বিয়ে-সম্পর্ক স্থাপন তো দূরের কথা মাঝে মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ হতে দেখেছি দু’পক্ষের মধ্যে সামান্য কারণে । বর্তমানে আমাদের তরুণ প্রজন্মেও এ ধরনের এক সর্বনাশা চেতনা ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক বিভাজনের বিষময় পরিণতি নিয়ে কেউ ভাবছেন কি না জানি না। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে গোরস্তানও হয়তো বিভাজিত হবে!

জাতীয় নেতাদের কাছে জাতি প্রত্যাশা করে, তারা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলোর পথ দেখাবেন। দেশপ্রেমের চেতনা সঞ্চারিত করবেন তাদের মধ্যে। সততা, সচ্চরিত্রতা, নৈতিকতা পরমতসহিষ্ণুুতার মতো মহান মানবীয় গুণাবলি জাতীয় নেতারা সঞ্চারিত করেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে। পারস্পরিক ঘৃণা, অপরের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ, বিপক্ষকে হেয়প্রতিপন্ন করা, মিথ্যাচার, অসততা, দুর্নীতির শিক্ষা কখনো জাতিকে সমৃদ্ধির পথ দেখায় না। জাতীয় ঐক্য, সহমর্মিতা, সহযোগিতা পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার পথে জাতি গঠনের আলোকোজ্জ্বল অভিযাত্রায় জাতীয় নেতাদের দেখার প্রত্যাশা সবার।

জাতীয় নেতাদের কাছে জনগণ প্রত্যাশা করে, চারিত্রিক মাধুর্য, সরলতা, সততা, সুবিচার ও সদাচারের আলোকে একটি কল্যাণমুখী সমাজ ও জাতি গঠন। এ ক্ষেত্রে ঘৃণা, অসম্মান ও অসহিষ্ণুতার দায়ভারও জাতীয় নেতাদের। তাদের ব্যর্থতা জাতির ব্যর্থতা। পরস্পরের প্রতি তাদের প্রান্তিক মনোভাবে জাতীয় ঐক্যের যে ফাটল তৈরি হয় তার ফাঁকে সুযোগসন্ধানী শক্তি চেপে বসে জাতির কাঁধে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের জাতীয় জীবনে এ ধরনের আশঙ্কা এখন অমূলক নয়। জাতির বৃহত্তর কল্যাণে জাতীয় নেতারা জাতিকে আলোর সন্ধান দেবেন এ প্রত্যাশা গোটা জাতির। নেতারা জাতিকে শেখাবেন নৈতিকতাবোধ, দায়িত্ববোধ ও দায়বদ্ধতা।

বর্তমান বৈশ্বিক ও জাতীয় দুর্যোগের প্রাক্কালে বড় প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। এই ঐক্য ও সংহতির কথা শুনতে চায় জাতি। পারস্পরিক নিন্দা, ঘৃণা, মিথ্যাচারের যন্ত্রণা থেকে জাতি মুক্তি পেতে চায়। রাজনৈতিক মতানৈক্যে পিতা-পুত্রের, স্বামী-স্ত্রীর, ভাইয়ে-ভাইয়ের সঙ্ঘাত শুধু অন্ধকার ডেকে আনবে। রাজনৈতিক সঙ্ঘাতে পুত্রের আত্মহননের সমাপ্তি হোক, পুরো জাতি জেগে উঠুক সম্মিলনের ঐকতানে। এ প্রত্যাশা আজ সবার।
লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ
Email-shah.b.islam@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/786113