৬ অক্টোবর ২০২৩, শুক্রবার, ১০:৪৮

খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৬ ব্যাংকের

- ব্যাংকভেদে শ্রেণিকৃত ঋণের হার ৮৭ শতাংশ পর্যন্ত উন্নীত

আমানতকারীদের অর্থ দিয়ে ব্যাংক গ্রাহকদের মাঝে ঋণ বিতরণ করে থাকে। আবার যথাসময়ে গ্রাহক ব্যাংকের অর্থ ফেরত দিলে আমানতকারীদের অর্থও ব্যাংক যথাসময়ে ফেরত দিতে পারে। আর এ আস্থার কারণেই মানুষ তার কষ্টার্জিত অর্থ নিজের ঘরে না রেখে ব্যাংকে রাখেন। কিন্তু গ্রাহক ঋণ নিয়ে ফেরত না দিলে আমানতকারীদের টাকা ফেরত দেয়ার সক্ষমতা ব্যাংক হারিয়ে ফেলে। তখনই বাধে বিপত্তি। আস্থার সঙ্কট দেখা দেয় ব্যাংকিং খাতে। দেশে ব্যাংকিং খাতের দিকে তাকালে দেখা যায়, বড় কিছু গ্রাহক ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। এতে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, কোনো ব্যাংকের এ খেলাপি ঋণের হার ৮৭ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁচেছে। অর্থাৎ ১০০ টাকার মধ্যে ৮৭ টাকাই খেলাপি হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, জুন প্রান্তিকে ৬১টি তফসিলি ব্যাংকের মধ্যে ৩৬টিরই খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। একসাথে এতো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি এর আগে কখনো হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ আমানতকারীদের নিরাপত্তার জন্য নির্ধারিত হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। আর এ প্রভিশন ঘাটতির কারণে ব্যাংকগুলোর মূলধন কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে বলে মনে করছে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে থাকতে হবে। তাই ৫ শতাংশের বেশি খেলাপি ঋণ হলে তা কমানোর জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বছরের পর বছর কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণ গড়ে ২০ শতাংশের ওপরে থাকছে। বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা বেশি নাজুক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাথে ব্যাংকগুলোর একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা আছে। প্রতি বছরের শুরুতেই খেলাপি ঋণ আদায়সহ বিভিন্ন সূচক উন্নতির জন্য লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তিন মাস অন্তর অগ্রগতি নিয়ে ব্যাংকগুলোর সাথে বৈঠক করে। কিন্তু পরিস্থিতি দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয় না। বরাবরই শীর্ষ ঋণ খেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার ধারের কাছেও যেতে পারে না ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে ২৩ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়ে ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। যেসব ঋণ মন্দ মানের হয়েছে এমন প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। যা খেলাপি ঋণের হিসেব থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে। উচ্চ আদালত থেকে স্থগিতাদেশ নিয়ে আরো বড় অঙ্কের ঋণ খেলাপি ঋণের হিসেবে দেখানো হচ্ছে না। এর বাইরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার নীতিমালা শিথিলতার সুযোগে বড় অঙ্কের ঋণকে পুনঃতফসিল করে রাখা হয়েছে। অথচ ছাড় না দেয়া হলে ওইসব ঋণ খেলাপি হয়ে যেত। এভাবে খেলাপি ঋণের হিসেবে যে তথ্য উঠে আসে বাস্তবে তার চেয়েও অনেক বেশি বলে মনে করেন ব্যাংকাররা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত জুন মাসে ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৩৬টি ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। এর মধ্যে সরকারি ছয়টি ব্যাংকের গড়ে খেলাপি ঋণের হার হয়েছে তাদের মোট ঋণের ২৫.০১ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেসিক ব্যাংকের। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণের হার তাদের মোট ঋণের প্রায় ৬৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ৪৪.০৫ শতাংশ। জনতা ব্যাংকের ৩২ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এর বাইরে অগ্রণী ব্যাংকের ২৩.৫১ শতাংশ, রূপালীর ১৯ ও সোনালী ব্যাংকের প্রায় ১৫ শতাংশ।

বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ প্রায় ৮৭ শতাংশ। সমস্যাকবলিত সাবেক ফার্মাস ও বর্তমানে পদ্মা ব্যাংকের প্রায় ৬৩ শতাংশ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৫০.৪৯ শতাংশ এবং ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রায় ২২ শতাংশ খেলাপি ঋণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ৮ ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ২৬ হাজার কোটি টাকার ওপরে। এর ফলে সামগ্রিক প্রভিশন ঘাটতি যেখানে মার্চে ছিল ১৬ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে জুনে এসে তা ৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ২১ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, ব্যাংকগুলোর প্রভিশন ঘাটতির কারণে মূলধন কাঠামোতে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/781898