৪ অক্টোবর ২০২৩, বুধবার, ১০:২৯

উপকূলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে যেতে পারে

বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৪ শতাংশ এলাকার মাটির নিচের পানি ব্যহারে অনুপযোগী হবে। একই সঙ্গে উপকূলীয় ১৯ জেলার দুই হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা তলিয়ে যাবে। এতে বাস্তুহারা হবে ২৫ লাখ মানুষ। যে প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। এতে সুন্দরবনের দুই হাজার ২৬১ বর্গকিলোমিটার বা ৪২ শতাংশ পুরোপুরি ডুবে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গ্রীনহাউজ ইফেক্টে জলীয় বাষ্পের বিরূপ প্রভাবে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধিতে দুই মেরুতে এবং সুউচ্চ পর্বত-শৃঙ্গগুলোতে বিপুল পরিমাণ সঞ্চিত বরফ গলতে থাকায় সুমদ্রের পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের পানির উচ্চতা বিপজ্জনক হারে বাড়ছে। বছরে এই বৃদ্ধির হার তিন থেকে আট মিলিমিটার। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ‘সুন্দরবনের সুস্থিত উন্নয়নের জন্য স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা কৌশলগত প্রতিবেদন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে কার্যকরি পদক্ষেপ না নিতে পারলে ২০৫০ সাল নাগাদ সুন্দরবনের ৪২% তলিয়ে যেতে পারে ।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সারা দেশে আবহাওয়া অধিদপ্তরের ২৪টি স্টেশনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ তথ্য বের করেছে বুয়েটসহ ১৬টি প্রতিষ্ঠান। তাতে দেখা গেছে, বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ যে হারে বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে ২০৪০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি এবং ২০৮০ সালে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। যদিও প্যারিস চুক্তিতে বাংলাদেশসহ জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ বৈশ্বিক তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বিজ্ঞানিরা বলছে, মহাসাগরগুলোতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি কারণে পৃথিবীর উষ্ণতা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাপমাত্রা যতবৃদ্ধি পাচ্ছে পানির বাষ্পীভবনের হারও তত বাড়ছে। ফলে গ্রীনহাউজ ইফেক্টে জলীয় বাষ্পের প্রভাবও বেড়ে যাচেছ। এছাড়া শিল্পউন্নত দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণহীন আধিপত্যের কারণে বাংলাদেশের মত অনুন্নত দেশ এর কবলে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পুথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের পানির উচ্চতা বিপজ্জনক হারে বাড়ছে। বছরে এই বৃদ্ধির হার তিন থেকে আট মিলিমিটার। প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরে এখন সুন্দরবনের পানির উচ্চতা তিন থেকে আট মিলিমিটার হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা এখানকার জৈববৈচিত্র্যের জন্য বিপদ ডেকে আনছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক আরো জানায়, আসছে দশকে সুন্দরবনের ঘোড়ামারা দ্বীপ সম্পূর্ণ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। সেই সঙ্গে এখানকার জীববৈচিত্র্যও বিলীন হয়ে যাবে। এছাড়া কাছাকাছি আরো দু’টো দ্বীপ এরই সাগরে ডুবে গেছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ধারাবাহিকভাবে বাড়লে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বোরোর উৎপাদন ২০৪০ সালের মধ্যে ১৫ শতাংশ এবং ২০৮০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশ কমে যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে এক হাজার ৫শ জন বসবাস করে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ০.৫ মিটার বাড়লে উপকূলীয় এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনবসতির ঘনত্ব বেড়ে হবে তিন হাজার ৫শ জন, এক মিটার বাড়লে পাঁচ হাজার ৭৭৭ আর দেড় মিটার বাড়লে সাত হাজার ৫৮৮ জন। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে আগাম বর্ষায় (মার্চ-মে) বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ছে। ২০২০ ও ২০৫০ সালে এটি ১২৫ মিলিমিটার থেকে ৬১৫ মিলিমিটার পর্যন্ত বেশি হতে পারে। এ ছাড়া বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতিনিয়তই বাড়বে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ০.৫ মিটার বাড়লে উপকূলীয় এলাকার ১৯ জেলার ২৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাতে দুই হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লবিত হবে। এক মিটার উচ্চতা বাড়লে তিন হাজার ৯৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লবিত হবে উপকূলীয় এলাকায়। তাতে ৬০ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর দেড় মিটার উচ্চতা বাড়লে ৮০ লাখ মানুষ বাস্তুহারা হবে। আর তাতে পাঁচ হাজার ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ডুবে যাবে। সুন্দরবন নিয়ে করা ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, পানির উচ্চতা ০.৫ মিটার বাড়লে ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের সুন্দরবনের ৪২ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হবে বা তলিয়ে যাবে। আর এক মিটার উচ্চতা বাড়লে ৬৯ শতাংশ এবং দেড় মিটার বাড়লে বনের ৮০ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যাবে।

বাংলাদেশের ওপর সম্পাদিত গবেষণা থেকে জানা গেছে, ২০৩০ ও ২০৫০ সাল নাগাদ বর্তমানের তুলনায় বার্ষিক গড় তাপমাত্রা যথাক্রমে ১ ও ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২১০০ সাল নাগাদ ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেতে পারে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ২০৩০ ও ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমানের তুলনায় যথাক্রমে ১৪ ও ৩২ সেন্টিমিটার এবং ২১০০ সাল নাগাদ ৮৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে বাংলাদেশের কমপক্ষে ১০ শতাংশ এলাকা সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষ উদ্বাস্তু হবেন বলে অনুমান করা হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬৭ সেন্টিমিটার বাড়লে গোটা সুন্দরবনই পানিতে তলিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশে অবস্থিত 'লোহাচরা'ও 'সুপারিভাঙ্গা' নামের দুটি দ্বীপ হারিয়ে গেছে। লোহাচরা দ্বীপের মাত্র এক মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত প্রায় দেড় লাখ জনসংখ্যার 'সাগরদ্বীপের ৩৩ দশমিক ৬২ বর্গকিলোমিটার এলাকা গত ৩০ বছরে সমুদ্রে তলিয়ে গেছে। বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবন সংলগ্ন দুবলার চরে বন অফিস সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ভোলা দ্বীপও গত চার দশকে প্রায় ৩ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা হারিয়ে বর্তমানে ১৯৬৫ সালের তুলনায় অর্ধেকে এসে দাঁড়িয়েছে।

প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ১৯৭ দেশ তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করলেও সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি ঠেকানো যাবে না। ফলে ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতেই থাকবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা জোরদার করার দাবী সংশ্লিষ্টদের।

https://www.dailysangram.info/post/537099