৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৮:০১

মৃত্যুকুপ হানিফ ফ্লাইওভার

১০ বছরে ১ হাজার ১৪৬ জন নিহত

দুর্ঘটনার ৭০ শতাংশ মোটরসাইলে
সড়ক দুর্ঘটনার মৃত্যুকুপ যেন রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার। প্রতিনিয়তই এই ফ্লাইওভারে ঘটছে দুর্ঘটনা। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে সবচেয়ে বেশি প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে মোটরসাইকেল চালক ও যাত্রীদের। এখানে মোট দুর্ঘটনার ৭০ শতাংশই ঘটছে মোটরসাইকেলে।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সর্বশেষ রনি নামের এক যুবক নিহত হয়। আহত হয়েছে ফাহিম হোসেন নামে আরও একজন। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ভোর ৫টার দিকে এই দুর্ঘটনা ঘটে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে চিকিৎসক রনিকে মৃত ঘোষণা করেন। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার জজ মিয়ার ছেলে রনি। এর আগে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় রাকিব হাসান নামের এক মোটরসাইকেলে যাত্রী নিহত হন। যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ সংলগ্ন মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর এ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই রাকিব মারা যান। কোনো গাড়ি তাকে চাপা দিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। শুধু রনি ও রাকিব নয় এমনিভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় গত দশ বছরে নিহত হয়েছে এক হাজার ১৪৬ জন। আহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৫০ জন।

সড়ক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফ্লাইওভারে ওঠার মুখে থাকে যানজট। সেটি কাটিয়ে ফ্লাইওভারে উঠেই মোটরসাইকেলচালক তার বাইকের গতি বাড়িয়ে দেন। ফ্লাইওভারে স্পিড লিমিট ৬০ কিলোমিটার। তবে অনেক বাইকার ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটার গতিতে চালান। এ কারণে ঝুঁকি বেড়ে যায়। বাস ড্রাইভাররা তাই বাইকারদের প্রতিযোগী মনে করে। যেহেতু মোটরসাইকেলচালকদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যথেষ্ট ঘাটতি আছে, তাই তারা মাপটা ঠিকমতো বুঝতে পারেন না। অনেক সময় মোটরসাইকেল নিয়ে সরু জায়গা দিয়ে নামার সময় তারা দুর্ঘটনাকবলিত হন। বাস মূল ফ্লাইওভারের ওপরে থামিয়ে যাত্রী নামাচ্ছে। যাত্রীরা আবার র‌্যাম্প দিয়ে হেঁটে হেঁটে সায়দাবাদের দিকে নামছে। বাস থামার ফলে ওইখানে আসলে সামনে কী আছে সেটা দেখতে সমস্যা হয়। ফলে ওই জায়গাটা ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। ওইখানে দুর্ঘটনা অনেক হয়।

রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনার হার রাজধানীর অন্য ফ্লাইওভারগুলোর চেয়ে বেশি। আর এখানে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে মোটরসাইকেলের। ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে চালু হওয়া ১১ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ফ্লাইওভার দিয়ে গুলিস্তান থেকে শনির আখড়া ও পোস্তগোলা পর্যন্ত যাতায়াত করা যায়। চার লেনের ফ্লাইওভারে ওঠতে ছয়টি এবং বের হতে সাতটি পথ রয়েছে।

২০১৩ সালের ১১ অক্টোবর উদ্বোধনের পর থেকে গত ১০ বছরে মেয়র মোহাস্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে ওঠতে-নামতে ও চলতে ছোট-বড় ৭ হাজার ৯৬৪ টি দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৫০ আহত ও ১ হাজার ১৪৬ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে সেভ দ্য রোড। সেভ দ্য রোডের মহাসচিব শান্তা ফারজানা ইনকিলাবকে জানান, কয়েকদিন পর পরই আমরা জানতে পারি রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনায় নিহতের খবর। এটা দুঃখজনক। সড়কের উন্নয়ন করা হয় সহজ যোগাযোগের জন্য কিন্তু সেই উন্নয়ন যদি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় এটা মেনে নেয়া যায় না। পৃথক বাইকলেন না থাকা, যথাযথ তদারকি না করা, নিয়ম না মেনে দ্রæতবাহন চালানো ও সিøপারগুলো দুর্ঘটনামুক্ত করার জন্য উপযোগী না হওয়ায় প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটেই চলছে।

২০১৩ সালের ১১ অক্টোবর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছোট বড় ১৮৮ টি দুর্ঘটনায় ১৫৮জন আহত এবং নিহত হন ৩০ জন। ২০১৪ সালে ৭৩২টি ছোট-বড় দুর্ঘটনায় ৫৫৩ আহত এবং নিহত হন ১৫৫ জন। ২০১৫ সালে ৭৫৯ টি ছোট-বড় দুর্ঘটনায় ৫৬৮ আহত এবং নিহত হন ১২৩ জন। ২০১৬ সালে ৮৬৯ টি ছোট-বড় দুর্ঘটনায় ৬৬৪ আহত এবং নিহত হন ১৫৮ জন। ২০১৭ সালে ৮৫৪ টি ছোট-বড় দুর্ঘটনায় ৭০৭ আহত এবং নিহত হন ১১৮ জন। ২০১৮ সালে ৮৩৬ টি ছোট-বড় দুর্ঘটনায় ৬০৯ আহত এবং নিহত হন ১৬৪ জন। ২০১৯ সালে ৮৪৪ টি ছোট-বড় দুর্ঘটনায় ৬৭৯ আহত এবং নিহত হন ১১৬ জন। ২০২০ সালে ৬৮৬ টি ছোট-বড় দুর্ঘটনায় ৫১৯ আহত এবং নিহত হন ৬৭ জন। ২০২১ সালে ৮২৪ টি ছোট-বড় দুর্ঘটনায় ৬৬০ আহত এবং নিহত হন ৮৩ জন। ২০২২ সালে ৭৬৫ টি ছোট-বড় দুর্ঘটনায় ৬২৭ আহত এবং নিহত হন ৭৩ জন। ২০২৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬০৭ টি ছোট-বড় দুর্ঘটনায় ৫০৯ আহত এবং নিহত হন ৫৯ জন।

প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানিয়েছেন, হানিফ ফ্লাইওভারে মোটরসাইকেলকে বাস পেছন থেকে ধাক্কা দেয়ার ঘটনায় বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। আবার অনেক সময় মোটরসাইকেল চালকরা দ্রæত গতিতে ফ্লাইওভারে চালানোর কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। এমনও হতে দেখা গেছে দুর্ঘটনার সময় মোটরসাইকেল চালকরা বাসের নিচে চলে যান সেখান থেকে লোকজন তাদের টেনে বের করতে হয়।

জানতে চাইলে সেভ দ্য রোডের প্রতিষ্ঠাতা মোমিন মেহেদী ইনকিলাবকে বলেন, নির্মম হলেও সত্য, কেবলমাত্র বাইকলেন না থাকায় মেয়র মোহাস্মদ হানিফ ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৭০ শতাংশ বাইকের। আর নিহতও সবচেয়ে বেশি হয়েছে বাইক দুর্ঘটনায়। দুর্ঘটনামুক্ত মেয়র মোহাস্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের জন্য অনতিবিলম্বে বাইকলেন, সিøপারগুলো সংস্কার, সার্বক্ষণিক সিসিটিভি স্থাপন, তদারকির জন্য বিশেষ টিম সার্বক্ষণিক রাখার সুপারিশ করছি।

https://dailyinqilab.com/national/article/606132