২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, সোমবার, ১০:২১

ট্রানজিটে বড় রুট রেলপথ

বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী আখাউড়া-আগরতলা নতুন রেললাইন রুট দিয়ে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের অপেক্ষায়। নতুন রেল লাইনসহ অবকাঠামো নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে নতুন লাইনে ট্রেনের ট্রায়াল রান করা হয়েছে উভয় প্রান্তে। নয়া রেলওয়ে রুটটি উদ্বোধন করা হবে খুব শিগগিরই। ভারতকে দেওয়া ট্রানজিট ও করিডোর সুবিধায় রেলপথে সবচেয়ে বড় ও ব্যস্ততম রুট হতে চলেছে আখাউড়া-আগরতলা নতুন রেলপথ। সমুদ্রবন্দর, নৌপথ, সড়ক-মহাসড়ক পথে ভারতের পণ্যসামগ্রী পরিবহনের লক্ষ্যে ট্রানজিট ও করিডোর ব্যবস্থা এর আগেই চালু করা হয়েছে। এবার রেলপথে ট্রানজিট-করিডোর সুবিধা চালুর অপেক্ষায়। ভারতের আবদার-অভিলাষ পূরণ আরেক ধাপ এগিয়ে গেল।

ভারতের অনুকূলে ট্রানজিট ব্যবস্থা ক্রমেই রূপ নিতে চলেছে বহুমুখী যোগাযোগ সুবিধায়। ষোলকলা পূর্ণ হতে চলেছে ভারতের পণ্য পরিবহেনর ট্রানজিট-করিডোর ব্যবস্থা। যা শুধুই একতরফা তথা ভারতমুখী। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার ভারতকে তাদের পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট তথা ট্রানজিট-করিডোর সুবিধায় পরিবহনের জন্য চারটি রুট চূড়ান্ত অনুমোদন করেছে। যার অন্যতম রুট হচ্ছে আখাউড়া-আগরতলা। চারটি রুট হলো- চট্টগ্রাম বন্দর-আখাউড়া-আগরতলা, মোংলা বন্দর-আখাউড়া-আগরতলা, চট্টগ্রাম বন্দর-বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর এবং মোংলা বন্দর-বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর।

এর মধ্যে ট্রানজিট ও করিডোর ব্যবস্থায় রেলপথে সবচেয়ে বড় রুট আখাউড়া-আগরতলা। কেননা একই সঙ্গে আখাউড়া-আগরতলা ট্রানজিট-করিডোর রুটে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম এবং দ্বিতীয় সমুদ্রবন্দর মোংলার সঙ্গে ট্রানজিট ও করিডোর যোগোযোগ ব্যবস্থা চালু হয়েছে। এদিকে আখাউড়া-আগরতলা রেলপথের দূরত্ব সাড়ে ১৫ কিলোমিটার। নয়া রেলপথটি বাংলাদেশকে আখাউড়ার (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) দিয়ে আগরতলা হয়ে মূল ভারতের ভূখ-কে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে সংযুক্ত করছে। নতুন রেল লাইন সম্প্রসারণ প্রকল্পে সাড়ে ৬ কি.মি. অংশ বাংলাদেশ অংশে এবং অবশিষ্ট ৫ কি.মি. ভারতে পড়েছে। উভয় দেশের মধ্যে খুব সামান্য দূরত্বের ব্যবধানে (ভৌগোলিক অবস্থানগত ‘চিকেন নেক’ আদলের অংশটি) রেলপথে সংযুক্ত হওয়ায় কার্যত সুবিধা হলো ভারতেরই। ভারতের ট্রানজিট ও করিডোর সুবিধা হলো আরও পাকাপোক্ত।

আখাউড়া-আগরতলা নতুন রেলপথ ও ভারতের জন্য ট্রানজিট-করিডোর রুট সুবিধা চালু প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের সাবেক প্রফেসর ড. আবুল কালাম আযাদ গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, “ভারত এখানে মৃগয়া নাভি আহরণের সুবর্ণ ও লোভনীয় সুযোগগ্রহণের একটা ক্ষেত্র বানিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশ ব্যবসা-বাণিজ্যের বিরাট সম্ভাবনা হারিয়েছে। ভারতে বাংলাদেশের গুণগত ভালোমানের অনেক পণ্যসামগ্রীর উচ্চ চাহিদা রয়েছে। কিন্তু প্রবেশাধিকার আটকে আছে। এমনকি ভারতের হরেক ধরনের পণ্যসামগ্রী আমদানি করে বাংলাদেশ থেকে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পুনঃরফতানির যে অবারিত সুযোগ রয়েছে, তাতেও আমরা বঞ্চিত আছি।

তিনি বলেন, সমুদ্রবন্দর, নৌপথ, সড়ক ও রেলপথ সবকিছু মিলিয়ে মাল্টিমোডাল যোগাযোগ সুবিধায় ট্রানজিট-করিডোর পেয়ে গেছে তারা। বিনিময়ে তারা আমাদের নামেমাত্র ফি-চার্জ-মাশুল দিচ্ছে। তাও ডলারে নয়; পরিশোধ করছে টাকায়। ইতোমধ্যে টাকার ২৫ থেকে ২৭ শতাংশ অবচয়ন হয়েছে। সুতরাং লাভ তাদেরই। ট্রানজিটের পণ্য পরিবহন করতে গিয়ে রাস্তাঘাট সড়ক, রেলপথ, নৌপথ আমাদের মেরামত করতে হচ্ছে জনগণের ট্যাক্সের টাকায়। সামগ্রিকভাবে এ ধরনের একতরফা ভারতের পণ্য ভারতে ট্রানজিট ও করিডোর ব্যবস্থায় আমাদের লাভ বা সুবিধা কী এই প্রশ্ন তুলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর আযাদ বলেন, ‘বরং অর্থনৈতিক ও কৌশলগতসহ সবমিলিয়ে ভারতেরই লাভ। আর আমাদেরই ক্ষতি’।

এদিকে সুদীর্ঘকাল যাবত অনেক দীর্ঘ ঘুরপথে আগরতলা-কলকাতার বর্তমান দূরত্ব ১৬শ’ ৫০ কিলোমিটার। আখাউড়া-আগরতলা সাড়ে ১০ কি.মি. নয়া ডুয়েলগেজ রেলপথে সংযোগ হওয়ায় সেই দূরত্ব এখন মাত্র ৫৫০ কি.মি.। মোট দূরত্ব কমছে ১১শ’ কি.মি.। সময় বাঁচবে ২৬ ঘণ্টা। ‘ভারত থেকে ভারতে’ ট্রানজিটে মালামাল যাবে আরও সহজে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর এবং ঢাকার কমলাপুর আইসডি থেকে কন্টেইনারসহ বিভিন্ন ধরনের ট্রানজিট পণ্য দ্রুত পরিবহন করা সম্ভব হবে। এর ফলে বাংলাদেশ-ভারত রেলপথে যোগাযোগ স্থাপিত হতে চলেছে কলকাতা থেকে রাজধানী ঢাকা হয়ে সরাসরি আখাউড়া-আগরতলার মধ্যে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার গঙ্গাসাগর থেকে ভারতের নিশ্চিন্তপুর এবং নিশ্চিন্তপুর থেকে আগরতলা স্টেশনে যুক্ত হচ্ছে নয়া এই রেলপথ।

সংক্ষিপ্ত নয়া দূরত্বে ভ্রমণে সময় যাবে ৩৬ ঘণ্টার পরিবর্তে মাত্র ১০ ঘণ্টা। বাঁচবে প্রচুর হারে কর্মঘণ্টা, সময় এবং অর্থ। নতুন আখাউড়া-আগরতলা রেলপথে প্রথমদিকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভারতের ট্রানজিট পণ্যসামগ্রী রেল মালবগি-ওয়াগনে সরাসরি পরিবাহিত হবে। আগামী দুয়েক মাসের মধ্যে কলকাতা থেকে ঢাকা হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলগামী যাত্রীরাও রেলপথে যাতায়াত করবেন। তাদের যথেষ্ট সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, নয়া আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ মূলত ভারতের ঋণ-নির্ভর প্রকল্প। এতে মোট ব্যয় ৪৭৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ভারতীয় ঋণ ৪২০ কোটি ৭৬ লাখ টাকা এবং সরকারি অর্থায়ন ৫৭ কোটি ৫ লাখ টাকা। ২০১০ সালে আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ-ভারত সমঝোতা স্মারক চুক্তি হয়। এর শর্ত অনুযায়ী ভারত সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনসট্রাকশন (ইপিসি) ভিত্তিতে এই রেল সংযোগ নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচ দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।

গত ৯ অথবা ১০ সেপ্টেম্বর নবনির্মিত আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ উদ্বোধনের সম্ভাব্য তারিখ থাকলেও জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের কারণে আপাতত তা পিছিয়ে গেছে। শিগগিরই চূড়ান্ত হবে উদ্বোধনের দিনক্ষণ। গত ১৪ সেপ্টেম্বর নবনির্মিত রেল লাইনে রেলওয়ে (পূর্ব) প্রধান প্রকৌশলী আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ প্রকল্পের পরিচালক আবু জাফর মিঞার নেতৃত্বে গঙ্গাসাগর থেকে ভারতীয় সীমান্ত বরাবর শিবনগর (জিরো পয়েন্ট) পর্যন্ত সফল ট্রায়াল রান সম্পন্ন হয়েছে।

এদিকে ভারতের সংবাদ মাধ্যম জানায়, ৯৭২ কোটি রুপি তথা হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ভারতীয় অংশে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সাড়ে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নয়া রেলপথসহ পূর্ণাঙ্গ রেলওয়ে অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প। ভারতের ইরকন ইন্টারন্যাশনাল (ইন্ডিয়ান রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন লি.) নির্মাণকাজ তদারক করছে।

আখাউড়া-আগরতলা নতুন রেলপথ নির্মাণের সুবাদে বদলে যেতে চলেছে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। আখাউড়ার অপর প্রান্তে ও আগরতলার কাছেই নিশ্চিন্তপুরে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক রেলস্টেশন এবং ইমিগ্রেশন। বন্দর সুবিধাবিহীন ও ভূমিবেষ্টিত (ল্যান্ড লক্ড) উত্তর-পূর্বাঞ্চলে হচ্ছে প্রথম আন্তঃদেশীয় স্থলবন্দর। এর ফলে ভাগ্যবদল ঘটবে ভারতে বিশেষত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের। ‘দি সেভেন সিস্টার্স’ বা ‘সাত কন্যা’ হিসেবে পরিচিত আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম, মেঘালয়, অরুণাচল, মনিপুর ও নাগাল্যান্ড এবং সেই সাথে পশ্চিমবঙ্গের একাংশ ও সিকিমের সাথে ভারতের মূল ভূখ-ের সংযোগ ও বিস্তার ঘটবে। ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, বিনিয়োগ, মেডিকোল-টুরিজমের সুযোগ খুলবে।

অথচ উত্তর-পূর্ব ভারতের জনসাধারণের মাঝে বাংলাদেশের উৎপাদিত উৎকৃষ্টমানের পণ্যসামগ্রীর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ভারতের শুল্ক-অশুল্ক বাধার কারণে বাংলাদেশের পণ্যসামগ্রী সেখানে প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত। এখন তা আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, ভারতমুখী এই ট্রানজিট ও করিডোর ব্যবস্থা যে একতরফা তা চুক্তিই বলে দিচ্ছে। অর্থাৎ বিষয়টি স্বব্যাখ্যাত। ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পাদিত এই চুক্তিতে শুরুতেই উল্লেখ করা আছেÑ ‘এগ্রিমেন্ট অন দ্য ইউজ অব চট্টগ্রাম অ্যান্ড মোংলা পোর্ট ফর মুভমেন্ট অব গুডস টু অ্যান্ড ফরম ইন্ডিয়া’। চুক্তি অনুযায়ী ‘ভারতের পণ্য- ভারত থেকে যাচ্ছে ভারতেই’। অন্যদিকে ‘কানেকটিভিটি’ ‘সংযুক্তি’ কিংবা ’ট্রান্সশিপমেন্ট’ কথামালার মাধ্যমে ট্রানজিট ও করিডোর সুবিধা ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। এর লক্ষ্য হাসিলে প্রকল্প-পরিকল্পনা, আয়োজন হচ্ছে পাকাপোক্ত। ‘ভারতের পণ্য ভারতে’ পরিবহনের পাশাপাশি ‘ভারতের যাত্রী ভারতে’ পরিবহন ব্যবস্থা করা হচ্ছে আরো সহজ এবং সাশ্রয়ী। শতাধিক বছরের প্রাচীন ব্রিটিশ আমলের ‘আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ে’ নেটওয়ার্ক পুনরুজ্জীবিত এবং তার আধুনিকায়ন হচ্ছে। বাংলাদেশের রেলপথ উন্নয়নের সমানতালে একে পরিপূরক ও সম্পূরক করছে ভারত তার ট্রানজিট ও করিডোর সুবিধাকে কাজে লাগাতে।

এদিকে আখাউড়া-আগরতলা নতুন রেলরুট ও ভারতের ট্রানজিটের বিষয়ে ভবিষ্যতে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনৈতিক সম্ভাবনার আশাবাদ ব্যক্ত করেন চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ওমর হাজ্জাজ। তিনি ইনকিলাবকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরসহ সমগ্র বাংলাদেশ বিরাট এই অঞ্চলের জন্য ‹অর্থনৈতিক ও পোর্ট হাব› বা কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতে চলেছে।

বিশেষ করে ভারতের সেভেন সিস্টার্স উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ এবং নেপাল, ভুটানসহ প্রতিবেশী দেশসমূহে বাংলাদশের গুণগত উৎকৃষ্টমানের পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। সেখানে আমরা রফতানিও করছি। তবে দেশের সামগ্রিক অবকাঠামো সুবিধার যুগোপযোগী উন্নয়ন এবং প্রতিবেশী ভারতের সাথে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে ও রফতানি বৃদ্ধিতে আমাদের আরো কাজ করতে হবে এমনটি তিনি অভিমত দিয়েছেন।

https://dailyinqilab.com/national/article/605068