২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, বুধবার, ৯:৫৮

মাসে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা করে চাঁদা দাবী

সুন্দরবনের আতঙ্ক এখন সরকারী রক্ষীবাহিনী ‘স্মার্ট বাহিনী’। জেলে প্রতি মাসে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা করে চাঁদা না দিলে হামলা-হামলার শিকার হতে হচ্ছে। সুন্দরবনে আগে জলদস্যুদের বছরে একবার টাকা দিলে নিরাপদে মাছ শিকার করা যেত। এখন সুন্দরবন রক্ষায় নিয়োজিত সরকারি স্মার্ট বাহিনীকে প্রতি মাসে ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হচ্ছে। টাকা না দিলে নৌকা ও জাল আটকে রাখাসহ বিভিন্নভাবে জেলেদের হয়রানি করা হয়। মিথ্যা মামলায় জেলেদের কারাগারেও পাঠানো হচ্ছে। এমনকি চাঁদা না দেয়ায় স্মার্ট বাহিনীর অতর্কিত গুলিবর্ষণে এক জেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সহকর্মী জেলে জয়নাল। এছাড়াও সুন্দরবনে আবারও দস্যুরা আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে জেলেদের কাছে চাঁদা দাবী করা হচ্ছে। কথায় বলে জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ এমন এক পরিস্থিতির মুখে পড়েছে জেলেরা। সরকারী বাহিনীর পাশাপাশি বনদস্যুদের নিয়মিত চাঁদা দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

মাঝিকে (৩০) দেখতে এসে এভাবেই ক্ষোভ প্রকাশ করে সরকারি স্মার্ট বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে কথাগুলো বলছিলেন, সুন্দরবনের কচিখালী-কটকা এলাকায় মাছ ধরা একাধিক জেলে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জলদস্যুর উৎপাত সুন্দরবনে নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন থেকে বিভিন্ননামে বাহিনী গড়ে তুলে অতীতে চলত দস্যুতা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় সেইসব বাহিনীর দৌরাত্ম্য কমেছে। কিন্তু উৎপাত থেকে রেহাই মিলছে না জেলেদের। জেলেদের অভিযোগ, নিরাপদে মাছ শিকারের স্বার্থে বন বিভাগের গঠণ করা ‘স্মার্ট বাহিনী’ এখন গরীব নিরীহ মৎস্যজীবীদের কাছে আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেদের ঘরে ভাত থাকুক আর নাইবা থাকুক। প্রতিমাসে স্মার্ট বাহিনীর চাঁদার অর্থ পরিশোধ করতেই হচ্ছে জেলেদের।

ভুক্তভোগী জেলেরা বলেন, জলদস্যুদের একবার চাঁদা দিলে সারাবছর নিশ্চিত থাকা যেতো। আমরা যাতে নিরাপদে সুন্দরবনের নদীগুলোতে মাছ শিকার করতে পারি সেকারণেই সরকার রক্ষীবাহিনী ‘স্মার্ট বাহিনী’ পাঠিয়েছে। তারাই এখন আমাদের ওপর জুলুম ও অত্যাচার করছে। চাঁদার টাকা পরিশোধ না করায় গত ১৩ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত তিনটার দিকে সুন্দরবনের কচিখালী-কটকা এলাকায় মাছ ধরা অবস্থায় জেলেদের ওপর স্মার্ট বাহিনীর টহল টিমের সদস্যরা গুলি চালায়। এ সময় জয়নাল মাঝি নামের এক জেলে গুলিবিদ্ধ হয়। পরে বাহিনীর সদস্যরা চলে গেলে জয়নাল মাঝিকে তার সঙ্গীরা স্থানীয় হাসপাতালে নিয়ে আসেন। জয়নাল মাঝি বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলার পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের রুহিতা গ্রামের আবদুর রশিদের ছেলে।

কোস্টগার্ড দক্ষিণ জোনের পাথরঘাটা স্টেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গুলিবিদ্ধ জেলে জয়নাল মাঝিকে কচিখালী স্টেশনের সহযোগিতায় পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার জন্য নিয়ে আসা হয়। পাথরঘাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্তব্যরত চিকিৎসক রুবাইয়াত আলী বলেন, জয়নাল মাঝি ডান হাতে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এসেছিলো। প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। পাথরঘাটা থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সাইফুজ্জামান জানান, বন বিভাগের স্মার্ট বাহিনীর হাতে এক জেলে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে আমরা হাসপাতালে যাওয়ার আগেই তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশালে পাঠানো হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত জয়নাল মাঝি অভিযোগ করে বলেন, বলেশ্বর নদ সংলগ্ন সুন্দরবনের কচিখালী-কটকা এলাকায় মাছ ধরতে বন বিভাগের স্মার্ট বাহিনীকে প্রতিমাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা করে মাসোয়ারা দিতে হয়। চলতি মাসের টাকা না দেয়ায় স্মার্ট বাহিনীর একটি টহল টিম গত ১২ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত তিনটার দিকে আমাদের ধাওয়া করে। তখন প্রাণে বাঁচতে আমরা দ্রুত মাছ ধরার ট্রলার নিয়ে সরে যাওয়ার সময় স্মার্ট বাহিনীর সদস্যরা এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে। এ সময় একটি গুলি এসে আমার ডানহাতে বিদ্ধ হয়। এতে হাত থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে।

বনবিভাগের স্মার্ট বাহিনীর প্রতি তীব্রক্ষোভ প্রকাশ করে বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, সুন্দরবন এলাকায় মাছ ধরতে হলে স্মার্ট বাহিনীকে টাকা দিতে হয়।

তবে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) শেখ মাহবুব হাসান জেলেদের অভিযোগ পুরোপুরি অস্বীকার করে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কচিখালী অভয়ারণ্য এলাকার একটি খালে টহলকালে ট্রলার দেখতে পায় স্মার্ট টহল দল। তারা ট্রলারটিকে থামাতে নির্দেশ দিলে না দাঁড়িয়ে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। এ সময় ওই ট্রলার থেকে কিছু একটা পানিতে ফেলে দেয়া হয়। তখন বনরক্ষীরা তাদের থামাতে ফাঁকা গুলি ছুঁড়লে ফোর সিলিন্ডার ট্রলার নিয়ে বন বিভাগের স্পিডবোর্ডে ধাক্কা দেয়। এতে তিন বনরক্ষী নদীতে পড়ে যায়। এমনকি স্পিড বোর্ডে ধাক্কা দিলে তা ডুবে যাওয়ার উপক্রম হয়। তখন বনরক্ষীরা গুলি ছুড়ে। তিনি আরও বলেন, ওই ট্রলারটিতে হয়তো ৫/৭ জন লোক ছিল। পরে সেখান থেকে খালে পাতা অবস্থায় নিষিদ্ধ বেহেন্দি জাল এবং বনের মধ্যে তল্লাশী করে হরিণ শিকারের ফাঁদ পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে তখন হয়তো তারা ট্রলার থেকে হরিণের মাংস পানিতে ফেলেছিলো। এ ঘটনায় বন আইনে মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে।

এক সময় অপহরণ, ডাকাতিসহ নানা অপরাধের অভয়ারণ্য ছিল বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। চার বছর পর আবারও সুন্দরবনে দস্যুরা আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে আলাদাভাবে প্রত্যেক গ্রুপের কাছে দাবি করা হচ্ছে লাখ টাকার চাঁদা। সম্প্রতি বিকাশের মাধ্যমে কয়েকটি পরিবার কিছু টাকা পরিশোধও করে। ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সুন্দরবনের ৩২টি বাহিনীর প্রধানসহ ৩২৪ জন দস্যু আত্মসমর্পণ করে। সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে অপহৃত এক জেলে সময় সংবাদকে জানান, তাদের কয়েকজনকে টগিবগি এলাকা থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে দস্যুরা। এরপর হাত-মুখ বেঁধে আটকে রাখে। তাদের পরিবারের কাছে ফোন করে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এ ব্যাপারে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা ৩০ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে পাঠায়।

সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে। তবে আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু ঘটেনি। এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কেউ যদি আবারও আতঙ্ক সৃষ্টি বা কোনো অপরাধ করার চেষ্টা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায়তাদের নির্মূল করা হবে।

https://www.dailysangram.info/post/535957