১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ২:১৬

বাড়ছে সামাজিক অপরাধ

চট্টগ্রামে সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। তুচ্ছ ঘটনায় মানুষ খুন হচ্ছে। স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী খুনের ঘটনা ঘটছে। স্বজনের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে স্বজনের হাত। ধর্ষণের পর নৃশংস খুনের শিকার হচ্ছে নিষ্পাপ শিশু। কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম টানা যাচ্ছে না। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, পেশাদার অপরাধীদের অপতৎপর আগের চেয়ে কমেছে। রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতাও তেমন নেই। তবে পারিবারিক ও সামাজিক কলহ বিরোধে খুনের ঘটনা ঘটছে। ধর্ষণ, খুনসহ শিশুর প্রতি সহিংসতাও বাড়ছে। হতাশা, বঞ্চনা থেকে আত্মহননের প্রবণতাও বাড়ছে উদ্বেগজনক হারে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক অস্থিরতার কারণে পারিবারিক ও সামাজিক অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে।

চট্টগ্রাম মহানগর এবং জেলায় একের পর নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ রোববার নগরীর চান্দগাঁও থানার মৌলভী পুকুরপাড়ে সাত বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। শিশুটি বাসায় একা ছিল। প্রতিবেশিদের কাছে খবর পেয়ে পুলিশ শিশুটির হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করে। এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে স্থানীয়দের সহযোগীতায় এক যুবককে পাকড়াও করা হয়।

পাশবিক নির্যাতনের পর খুনের শিকার শিশুটির নাম তানহা আক্তার মারিয়া। সে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি থানার রামদয়াল এলাকার মো. বাকের হোসেনের মেয়ে। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী ছিলো সে। শিশুটির মা তৈরী পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। আর তার বাবা রিকশা চালক। গ্রেফতার রাকিবুল ইসলাম মুন্না ওই এলাকার বাসিন্দা। মুন্না কক্সবাজার জেলার সদর থানার কক্সশাহীর টিকা এলাকার মৃত ইউসুফের ছেলে।

এর আগে নগরীর পাহাড়তলী থানার আলামতারা পুকুর এলাকায় ধর্ষণের পর নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ১০ বছরের শিশু আবিদা সুলতানা আয়নীকে। বিড়াল ছানা দেওয়ার কথা হলে এক তরকারি বিক্রেতা তাকে একটি বাসায় নিয়ে ধর্ষণ করে। এরপর লাশ বস্তায় ভরে ডোবায় ফেলে দেওয়া হয়। নিখোঁজের আট দিন পর সেখান থেকে লাশ উদ্ধার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই। তারও আগে নগরীর জামালখানে শিশু বর্ষাকে ধর্ষণের পর লাশ বস্তায় ভরে নালায় ফেলে দেওয়া হয়। নগরীর বন্দরটিলা এলাকায় শিশু আয়াতকে অপহরণের পর হত্যা করে ছয় টুকরো করা হয়। আলাদা ব্যাগে ভরে এসব টুকরো ভাসিয়ে দেওয়া হয় খালে ও সাগরে। প্রতিনিয়তই ঘটছে শিশু ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা।

তুচ্ছ ঘটনায় খুনের ঘটনাও ঘটছে নগরীতে। শুক্রবার রাতে নগরীর খুলশী থানার সেগুনবাগানে উপুর্যপুরি ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় আবদুর রহমান সুজন নামে এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে। এ ঘটনায় সাত জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সাত জনই তার পরিচিত। সুজন রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল, আসামিরা একটি টমটম যোগে এলাকা পার হওয়ার সময় সুজনের সাথে ধাক্কা লাগে। এর প্রতিবাদ করায় সুজন ও তার এক সহপাঠীর উপর হামলে পড়ে ওই সাত জন। উপুর্যপুরি ছুরিকাঘাতে সুজন মারা যায় আহত হয় তার সহপাঠী।

জেলার রাউজানে অপহরণের পর কলেজছাত্র শিবলী সাদিক হৃদয়কে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পড়ালেখার পাশাপাশি রাউজানের একটি মুরগির খামারে ব্যবস্থাপকের চাকরি করছিল হৃদয়। সেখানে সহকর্মীদের সাথে ঝগড়ার জের ধরে তাকে অপহরণ করা হয়। রাঙ্গামাটির পাহাড়ে নিয়ে হত্যা করে লাশ টুকরো টুকরো করা হয়। এরপর পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণও আদায় করা হয়। ১৪ দিন পর গহীন অরণ্য থেকে লাশের অংশবিশেষ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় গ্রেফতার এক আসামিকে জনতার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, হৃদয় হত্যাকা-ের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

নগরীর পাহাড়তলীতে মাত্র ১০ হাজার টাকা ভাগ-বাটোয়ারার বিরোধে প্রকাশ্যে দিনদুপুরে যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ হোসেন মান্নাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে তার প্রতিবেশী ও একই দলের কর্মী মো. জসিম উদ্দিন। এ হত্যাকা-ে বাবার সাথে অংশ নেয় তার কিশোর ছেলে মো. রাহাতও। অসংখ্য মানুষের সামনে গরু জবাই করার ছুরি দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। হত্যাকা-ের দুই দিন পর ১২ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করা হয় পিতা-পুত্রকে। পারিবারিক কলহে ঘটছে খুনের ঘটনা। গত ১০ সেপ্টেম্বর নগরীর বন্দর থানার কলসি দীঘির পাড়ে শাশুড়ি রুমা আক্তারকে শ^াসরোধে হত্যা করে লাশ জানালার সাথে ঝুলিয়ে রাখেন মো. আজিম নামের এক ব্যক্তি। পরদিন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। অভাবের তাড়নায় মেয়ের বাসায় এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন রুমা আক্তার। কিন্তু তাকে সহ্য করতে পারছিলেন না মেয়ের জামাই আজিম। আর এ কারণে স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে শাশুড়িকে হত্যা করেন আজিম।

এ ঘটনায় গ্রেফতারের পর নির্বিকারচিত্তে খুনের দায় স্বীকার করে বর্ণনাও দেন এ আত্মস্বীকৃত খুনি। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পারিবারিক কলহে নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটছে। স্ত্রীর হাতে স্বামী এবং স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন হচ্ছে। খুনের পাশাপাশি আত্মহত্যার ঘটনাও আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে গেছে। পারিবারিক কলহ, হতাশা, বঞ্চনা থেকে অনেকে আত্মহত্যা করছেন। পাড়ায়, মহল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত চলছে। ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ ভয়ঙ্কর সব অপরাধে নেমে পড়েছে উঠতি কিশোর-যুবকেরা।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় বলেন, পেশাদার অপরাধীদের তৎপরতার লাগাম টানা গেলেও কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতসহ সামাজিক অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। এসব অপরাধে জড়িতদের দ্রুত পাকড়াও করে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে। নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে ধর্ষণ বিশেষ করে শিশু ধর্ষণ ও খুনের মত ঘটনাও ঘটছে। পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাওয়ায় সন্তানদের প্রতি অভিভাবকদের উদাসীনতা বাড়ছে। এ কারণে বিপথগামী হচ্ছে কিশোর-যুবকেরা। কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে নানা অপরাধ করছে তারা। এ ধরনের অপরাধ দমন পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি বলেন, এজন্য দরকার সামাজিক আন্দোলন। পরিবার এবং সমাজের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে হবে।

চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, সামাজিক অপরাধ বড় আকারের সমস্যা। এর নেপথ্যে রয়েছে দীর্ঘদিনের বিচারহীনতার সংস্কৃতি। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, সীমাহীন দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্থিরতার কারণেও এই অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। দুর্নীতির মাধ্যমে একটি শ্রেণি রাতারাতি কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে। আর যারা সততার সাথে জীবনযাপন করছেন তারা নানাভাবে হয়রানি ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন। সমাজে এ ধরনের বৈষম্য থেকে হতাশা এবং একপর্যায়ে অপরাধী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। সামাজিক অপরাধ প্রতিরোধে সর্বস্তরের নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে মসজিদে জুমার খুতবা ভালো ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান বলেন, বিচারহীনতার কারণে খুন, শিশু ধর্ষণসহ ভয়ঙ্কর সামাজিক অপরাধ বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি নগরীতে বেশ কয়েকটি শিশু ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা ঘটেছে। অথচ এসব ঘটনার তদন্ত শেষ করা হয়নি। চাঞ্চল্যকর ঘটনার দ্রুত তদন্ত শেষ করে জড়িতদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হলে এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে। বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে মামলার আলামত নষ্ট হয়, সাক্ষী পাওয়া যায় না, তাতে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়।

https://dailyinqilab.com/national/article/603576