১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, মঙ্গলবার, ১:১৯

সুন্দরবনকে উপেক্ষা করে নয়

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

নামে কি-বা এসে যায়। বার্মা এখন মিয়ানমার। বোম্বাই হয়েছে মুম্বাই। এমনকি এই সেদিন তুরস্ককে তার্কিই বলে ডাকার কথা বলেছেন এরদোগান। রায়মঙ্গল আর কালিন্দির মোহনায় তারা তখন কী একটি ব্যাপার নিয়ে যেন শলাপরামর্শ করছিল। সমুদ্রের পানি উত্তাল। আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস বার্তা আজকাল তাদের শোনা লাগে না। দুই নদীর মোহনা দু’দেশের সীমান্ত বাংলাদেশ ও ভারতের। এখান থেকে ঢাকা-দিল্লির দূরত্ব অনেক। কিন্তু সোবহান আর নরেন ব্যাপারটি দেখে অন্যভাবে। সোবহানের বাড়ি বাংলাদেশের শ্যামনগরের সাপখালি আর নরেনের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের শমসের নগরের কাটাখালিতে। তাদের ট্রলারে বাংলাদেশের পতাকাও আছে আর আছে ভারতের পতাকা। এ রকম রাখার কারণ, তারা এমন জলসীমানায় মাছের সন্ধানে ফিরে সেখানে মাছেরা আন্তর্জাতিক, তাদের পাসপোর্ট, ভিসা চেক করার মতো বোকামির বিষয় আর নেই। একই নদীর দু’টি ধারা গঙ্গা-যমুনা যেমন তেমন সোবহান-নরেনের পেশার মধ্যে নেই তেমন ব্যবধান। এখানে ভারতীয় রুপি আর বাংলাদেশের টাকার কোনো পার্থক্য প্রযোজ্য নয়। এখানে যেমনটি দু’দেশের জলসীমানা থেকে ধরা সমস্ত মাছেরা মনে দুঃখ পাবে যদি তাদের ন্যাশনালিটি নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তোলে। ভারত না ইন্ডিয়া এখানকার মাছেরা এ তর্কাতর্কির কিছু জানে না। যেমন তারা জানে সুন্দরবন, তা বাংলাদেশ ভাগের হোক আর ভারতের ভাগে হোক সুন্দরবন তো সবার। সুন্দরবন সব বাঘ, বানর, কুমির, পশু-পাখি, মাছ, শামুক ও শালিকের।

ইদানীং সুন্দরবন ও তদসংলগ্ন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে গাছের আগামরা যে রোগের প্রাদুর্ভাব তা তো উভয় দেশের গাছ সম্প্রদায়ের জন্য দুঃসংবাদ। গাছদের প্রাণ আছে এটি তো জগদীশ চন্দ্র বসু বলে গেছেন। সোবহান প্রতিদিন সকালে কুরআনের ৫৫ নং সূরা আর-রাহমান তিলাওয়াত করে সেখানে ৬ নং আয়াতে আছে- ‘নক্ষত্রমালা ও বৃক্ষরাজি সৃষ্টিকর্তাকে সিজদা করে’। নরেন আর সোবহান দু’জনের দুঃখ সুন্দরবনের গাছ-গাছালি মহামারীর শিকার। যেন দিন দিন বন ছোট হয়ে যাচ্ছে, আগামরা রোগে মারা যাচ্ছে অনেক গাছ। বড় বড় ঘূর্ণিঝড়ে যে গাছ পড়ে যায় তার জায়গায় নতুন গাছ লাগানোর কোনো উদ্যোগ যেমন দেখা যায় না তেমনি পচামরা গাছগুলো সারানোর কোনো খবর নেই। নরেন জানে তাদের দেশে সুন্দরবনের কাছে বড় শিল্পকারখানা এমনকি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের নিষেধাজ্ঞা আছে তাদের দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। অথচ সোবহানের দেশে সুন্দরবনের কাছে শিল্পকারখানা এমনকি কয়লার একটি বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র বসানো হয়েছে, তাও দু’দেশের যৌথ উদ্যোগে।

নরেন-সোবহানের হাতে মোবাইল ফোন আছে, তাতে ওয়াইফাই নেই বটে তবে মোবাইল ডাটা ব্যবহারের ব্যবস্থা আছে। নরেনের ধারণা, ডিজিটাল যোগাযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় সব দেশে অনেক সুযোগ-সুবিধা এনে দিয়েছে। তবে কোনো কোনো দেশে এ সুবিধা আবার আত্মঘাতী কাজে ব্যবহার না হয়; সেদিকে সবার খেয়াল রাখা দরকার। তারা দু’জন যখন এসব নিয়ে ভাবছে তখন তাদের হয়তো পুরোপুরি জানা হয়নি এখনো বাংলাদেশে হাজার হাজার মানুষের এনআইডির তথ্য বাইরে বেহাত হয়ে গেছে। সোবহান গতবার এনআইডি করেছে। এখন ব্যাংকে বা কোনো সেবা পেতে হলে এনআইডি নম্বর লাগবেই। কাজটি এগোচ্ছিল, ঠিক এ সময় এনআইডির কাজ বা দায়িত্ব নাকি নির্বাচন কমিশন থেকে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে ইসির যেন বলার কিছু ছিল না, আর জনগণের কোনো প্রতিক্রিয়া প্রকাশের সুযোগ রাখা হয়নি। সিদ্ধান্ত যা হয় তা তো নিজস্ব কিচেনে। বেচারা মিডিয়ায় নানান ধান্দায় তার পক্ষ-বিপক্ষ কিছু একটা প্রকাশ পায়, প্রচার হয়। বোঝাই যায় না মিডিয়া এসব সিদ্ধান্তের পক্ষে না বিপক্ষে। কেননা, অনেক সময় তাদের নাটক সাজাতে হয়। কিঞ্চিৎ কতিপয় মানুষ যারা মিডিয়ায় চোখ রাখে তাদের মধ্যে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টির উদ্যোগ তো থাকে। তবে সদ্যোজাত শিশুরাও এটি জানে যে, এই মুষ্টিমেয় মানুষেরা দেশে দেশে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। সুতরাং যারা সূত্রপাত ঘটাবে তাদেরকে দিয়ে তাদের কাছে টানার বুদ্ধিটাও কাজে লাগায় তারা।

নরেন-সোবহান কিচেনের এসব ঘটনা জানাজানি থেকে অনেক দূরে থাকলেও ফল তো তাদের ওপর তাৎক্ষণিকভাবে বর্তায়। অর্থ-আইন পাসের আগে বেনাপোলে ভ্রমণ কর আদায় শুরু হয়ে গিয়েছিল বলে এক নিন্দুক সে সময় নরেনকে জানিয়েছিল। তাদের জানানোর আগে সিমের টাকা কাটা শুরু হয়ে যায়। সোবহানের দেশে আলু ডিম আর পেঁয়াজের দাম বেঁধে দেয়ার খবর সবার কানে পৌঁছানো হয় না, যায় না। যেমন সবার কানে পৌঁছায় না ব্যাংকের টাকা কখন কিভাবে উধাও হয়ে যায়, মোটা অঙ্কের টাকা দেশের গর্তে বা বিদেশে পাচার হয়ে যায়। কার টাকা বিদেশে পাচার, ব্যাংকে লুট হয় ভুট হয় কাদের দ্বারা তা তারা কিছু জানে না। যারা নিয়ে যায় তাদের সবাই কোনো কিছু বলে না। টাকা নরেন-সোবহানের কিন্তু নিয়ে যায় ব্যাংকের সাজানো সিন্ডিকেট, দখলদার মালিক পক্ষ। যারা কৈ মাছের তেলে কৈ মাছ ভাজে আর সবার টাকা সরায়। তারা যখন এসব নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছিল তখন সোবহানের ফোনে মেসেজ আসে- গোলাখালির গাঙ পার হয়ে আসা মাঝ বয়েসী এক বাঘের বড় বিপদ এখন। লোকালয় কেমন তা দেখতে গিয়েছিল বাঘটি। যেমন সুন্দরবন কেমন তা দেখতে আসেন ট্যুরিস্টরা। কিন্তু দু’জনের প্রতি দুরকম আচরণ। গোলাখালির বাঘটি শহীদূল তরফদারের বড় হেসেলের চালে আশ্রয় নিয়েছে। -ইতোমধ্যে সে বুঝেছে এভাবে হুট করে এ এলাকায় আসা তার ঠিক হয়নি। আসার সময় সুন্দরবনের বাবাহকু পর্ষদের আন্ত নিরাপত্তা-বিষয়ক বিভাগের কাছে জানিয়ে আসা উচিত ছিল। তারা অন্তত বলতে পারত, লোকালয়ে এ সময় ভ্রমণ করা নিরাপদ হবে কি না। কেননা, লোকালয়ের সবাই নিজেরা নিজেদের শত্রু এখন, সুন্দরবনের পাখ-পাখির প্রতি তো বটেই। সুতরাং মাঝ বয়েসী বাঘকে পূর্বশত্রুতার জের ধরে কোণঠাসা যে করবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তরফদারের ঘরের চালে উঠে মাঝ বয়সী বাঘটি এসব কথা ভাবছে তখন শ্যামনগর থেকে সোবহানের শ্যালিকা সাদিয়া (সে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানের ছাত্রী, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য নিয়ে তার একটি টিউটোরিয়াল জমা দেয়ার কাজ চলছে।) বাঘটির প্রতি তার মমতা ও বাঘটিকে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে কি না এ নিয়ে তার উদ্বেগ প্রকাশ করে মেসেজ পাঠিয়েছে। সোবহানের বন্ধু গোলাখালির মন্টু মেম্বারকে সে জানায়, যেন বাঘটিকে সসম্মানে বনে ফেরার ব্যবস্থা করে। সে যেন গ্রামের মানুষকে বোঝায় বাঘ আমাদের শত্রু নয়, বন্ধু। সবার প্রতি বন্ধুত্ব কারো প্রতি শত্রুতা নয়- এ নীতিতে যেন সবাই চলে। গ্রামে উগ্রপন্থী অনেক লোক থাকে তারা মাঝ বয়েসী বাঘটির প্রতি সদয় নাও হতে পারে। মেসেজে কী বার্তা এসেছে তা নরেন জানতে চায়। সোবহান নরেনকে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করে। নরেন বলে, ও এই কথা! আমাদের ভাগে যে সুন্দরবন পড়েছে সেখানে সব বাঘ বানর, হরিণ, কুমিররা এখন ফেডারেল ডিজিটাল জরিপের আওতায়। বাঘদের আধার কার্ড দেয়ার পরিকল্পনা চলছে। সুতরাং বাঘের গতিবিধি যাচাইসহ তাদের আসন্ন বিপদাপন্ন হওয়া পরিস্থিতি (যেমনটি গোলাখালিতে আটকা মধ্য বয়সী বাঘটির ক্ষেত্রে ঘটেছে) সম্পর্কে তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবে বন বিভাগের কর্মকর্তা। তারা বাঘটিকে উদ্ধার তো করবেই, তাকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে বনে পাঠিয়ে দেবে।

সুন্দরবনের বাবাহকু পর্ষদের প্রেসিডিয়াম প্রধান সুন্দরমিয়া ব্যাপারটিকে ন্যায়-ন্যায্যতার ভিত্তিতে বিশেষ গুরুত্ব দিতে আগ্রহী। কোপেনহেগেনে সম্মেলনে ক্লাইমেট চেঞ্জ অধিবেশনে টাকা ভাগ বাটোয়ারা কাজে বিশ্বসভা থেকে যে সব শর্ত দেয়া হয় তা প্রতিপালন দেখার উপরও জোর দেয়া হয়েছে। ক্লাইমেট চেঞ্জ ফান্ডের প্রাপক দেশ নিজ দেশে বলে বেড়ায়, ফান্ডের টাকা পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ অন্যান্য দেশে টাকা নিয়ে খরচ করে হিসাব দেয়ার কাজ শেষ হলেও সুন্দরবনের ভাগে বরাদ্দ করা টাকা কার পকেটে গেছে তা জানা যায়নি। সিপিডি নামে এক চিন্তাচৌবাচ্চা এ ব্যাপারে একটি সম্মেলন করেছিল মাস দুয়েক আগে। সেখানে সুন্দরবন ব্যতিরেকে যে সব কর্তৃপক্ষীয় কর্তাব্যক্তিরা যোগ দিয়েছিলেন তারা ইংরেজি বাংলায় বড় বড় কিছু বক্তব্য দিয়েছিলেন শোনা যাচ্ছে। কিন্তু সেখানে কাজের কথা, তহবিলের হিসাবের কথা, বণ্টনের কথা এমনকি অসহায় বন্যপ্রাণীদের সহায়তার কথা ওঠেনি বলা চলে।

সুবিদখালি অবকাশ কেন্দ্র থেকে গতকাল এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে এ প্রসঙ্গে সুন্দর মিয়া জানান, নিজের টাকায় অনেক কিছু করার কথা শোনা যায় লোকালয়ে। কিন্তু সুন্দরবনের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় বিদেশী টাকা পেয়ে তা খরচের কোনো উপলক্ষ তো দেখি না, সবই বাহানা। কয়েক বছর আগে খোদ সুন্দরবনের শেওলা নদীতে তেলবাহী জাহাজ ফুটো হয়ে অনেক তেল ছড়ালে বনের ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছিল প্রাণিকুল। সে ব্যাপারে কেউ কোনো কথা রাখেনি। কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কঠিন শর্তে কয়লা আমদানি চলছে তা আসবে সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া শিবসা পশুর নদী দিয়ে। আকরম পয়েন্টের ওখানে যদি ডিপ সি পোর্টটা হতো তাহলে অন্তত সুন্দরবন অভ্যন্তরস্থ নৌপথ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রেহাই পেত। নানা সঙ্কট আশঙ্কা পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে ক্লাইমেট চেঞ্জের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনের। আত্মঘাতী ব্যবস্থা আর কারে বলে।’
লেখক : উপকূলীয় উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক

https://www.dailynayadiganta.com/post