১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ১:১৪

ডেঙ্গুতে মৃত্যু নাকি হত্যাকাণ্ড?

রাজধানী ঢাকায় মানুষের কাছে এখন আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। ডেঙ্গু প্রকোপ বেড়ে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ঢাকার বাইরে এখন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হুহু করে বেড়ে গেছে। গতকালও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং হাসপাতালে ভর্তি হন ২১২৯ জন। সরকারি হিসেবেই চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৭৯০ জন। এ সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আক্রান্ত হয়েছে এক লাখ ৬১ হাজার ৯৬৪ জন রোগী। সরকারি এই হিসেবে বাইরে আরো কয়েক লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে।
চলতি বছরের শুরুতে কীটতত্ত্ববিদরা আগষ্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে এমন আশঙ্কা করেছিলেন। সেই আশঙ্কাকে বাস্তবতায় রূপ দিয়ে দেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে ডেঙ্গু। এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই মৃত্যুর দায় করা? এটা মৃত্যু নাকি হত্যাকা-? করোনা হলো অদৃশ্য ভাইরাস। ওই ভাইরাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ায় দায়িত্বশীলদের হয়তো করার কিছু নেই। ডেঙ্গু তো এডিস মশা বাহিত রোগ। এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ করা হলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন এতো মানুষকে প্রাণ দিতে হতো না। পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১১ বছরে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ দুই সিটি কর্পোরেশন মশা মারতে ১০৮০ কোটি টাকা খরচ করেছে। মশা মারতে ভেজাল বিষের পাশাপাশি তেলাপিয়া মাছ, গাপ্পি মাছ, হাঁস, ব্যাঙ, ড্রোন দিয়ে মশা নিধনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু মশা মরেনি বরং বেড়েছে। কীটতত্ত্ববিদ ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেছেন, মশা মরতে দুই সিটিপ কর্পোরেশনে যে মাছ-হাঁস- ব্যাঙ ড্রোনের ব্যবহার করা হয়েছে এগুলোর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। জনগণের টাকার অপচায় করা হয়েছে। ভুক্তোভোগীদের অভিযোগ দুই সিটি কর্পোরেশনের ব্যর্থতায় ডেঙ্গুতে ঢাকার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারানো পরিবারগুলোর বক্তব্য হচ্ছে, আমরা প্রতিবছর সিটি কর্পোরেশনের ট্রাক্স দেই। অথচ মশার কামড়ে আমাদের স্বজনদের মরতে হচ্ছে। সময়মতো মশা নিধন করা গেলে আমাদের স্বজনদের প্রাণ হারাতে হতো না। এগুলো মুত্যু নয় হত্যাকা-। ডেঙ্গু জ্বরে এতোগুলো মানুষের প্রাণ হারানোর দায় সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের। দেশে আইনের শাসন কার্যকর থাকলে এসের বিচারের মুখোমুখি হতে হতো। ওরা (ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের মেয়র) ট্র্যাক্সের টাকায় রুপকথা গাপ্পি মাছ দিয়ে মশা নিধনের নাটক করে।

জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আগেই সতর্ক করা হয়েছিল যে আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর এ চার মাসেই ডেঙ্গু ঝুঁকি রয়েছে। যদি ডেঙ্গু সংক্রমণের উচ্চহার এক জায়গায় থাকে সেটাকে রোগত্ত্বাতিকভাবে স্থিতিশীল বলা যায় না। বর্তমানে ঢাকার ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্থিতিশীল নয়। যখন আমরা দেখবো পর পর দুই সপ্তাহ ধরে কমে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে বলা যাবে সংক্রমণ কমেছে। তবে সে অবস্থা এখনো আসেনি।

নাগরিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দ্বিখ-িত করা হয়। সিটি কর্পোরেশনকে দুই ভাগ করায় চেয়ার, টেবিলের সংখ্যা বাড়লেও ‘নাগরিক সেবার মান’ বাড়েনি। বরং নাগরিকরা নিয়মিত ট্রাক্স দেন অথচ সেবা পান না। এডিস মশার যন্ত্রণায় নাগরিকদের সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয়। মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে এখন অঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন নাগরিকরা। প্রতিদিন কয়েকজন করে মানুষ মশার কামড়ে আক্রান্ত হয়ে ডেঙ্গু রোগে মারা যাচ্ছে। কিন্তু দুই সিটির মেয়রদ্বয় নির্বিকার। অবশ্য ভুক্তোভোগীদের অভিযোগ জনগণের ভোটে নির্বাচিন মেয়র না হওয়ায় জনগণের সমস্যাগুলো তাদের ভাবায় না। কারণ তাদের জনগণের কাছে ভোটের জন্য যেতে হয় না। এমনিতেই নির্বাচিত হওয়ায় তারা কার্যত লুটপাটে ব্যস্ত।

কীটতত্ত্ববিদরা জানিয়েছেন, এসিড মশা সাধারণত দিকে কামড়াতো। রাজধানী ঢাকা শহরে ‘লাইট পলিউশনের’ কারণে এডিস মশা এখন দিনে হোক বা রাতে সব সময় কামড়ায়। লাইট পলিউশন কিন্তু একটা বিশাল বড় পলিউশন। এ কারণে এডিস মশা তার আচরণে পরিবর্তন করেছে। এই পরিবর্তনকে টার্গেট করে এডিস মশার নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিতে হয়। মশক নিধন কার্যক্রম জোরদার করতে হয়। মশা জন্মানোর তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করে যারা মশার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে আছেন তাদের টার্গেট করে মশার নিধন করার কথা।

গত ২৩ জুন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১১টি এলাকাকে ‘রেড জোন’ ঘোষণা করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। যে ১১টি এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) রয়েছে ৬টি এলাকা এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৫টি এলাকা। এগুলো হলো- যাত্রাবাড়ী, মুগদা, কদমতলী, জুরাইন, মানিকনগর, সবুজবাগ, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, তেজগাঁও ও বাড্ডা। রেডজোন ঘোষণার পরও এডিস মশা নিধণের কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। মাঝে মাঝে দুই সিটি কর্পোরেশন থেকে এডিস মশার লার্ভা সন্ধানে অভিযান পরিচালনা করা হয়, লার্ভা পেলে জরিমানা করা হয়। মেয়রদ্বয় ডাবের পরিত্যাক্ত খোসা জমা দিলে একশ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দেয়। মশা নিধন নিয়ে টিভি পর্দায় গলা ফাটানো চিৎকার করা হয়। কিন্ত মশা নিধণের যে বাজেট ঘোষণা করা হয় সে টাকা খরচ হলেও মশা নিধন হয় না।

ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশনের মশা নিধণের খরচের খাতার পাতা উল্টালে দেখা যায়, গত ১১ বছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন খরচ করেছে ৪৯৩ কোটি ২৪ লাখ। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন খরচ করেছে ৫৮৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৬ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০ কোটি ২ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩১ কোটি ২ লাখ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৭ কোটি টাকা। এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্ধ রেখেছে ৪৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা টাকা। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মশা নিধনে ব্যয় হয় ১০ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১৪ কোটি টাকা, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০ কোটি টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২১ কোটি টাকা বরাদ্দ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৭০ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫৫ কোটি ৫০ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫৯ কোটি ৮৫ লাখ এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০১ কোটি টাকা এবং ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১১৪ কোটি ৫০ লাখ বরাদ্দ রেখেছে।

জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ইতিহাসে ঘাটলে দেখবেন বাংলাদেশের যতবার ডেঙ্গু হয়েছে দেখবেন আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে। আমরা আগেই সতর্ক করেছিলাম। কিন্তু দুই সিটি কর্পোরেশন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এবছর মে মাসে যখন বৃষ্টি শুরু হলো, তখন কমিউনিটিতে এডিস মশার ঘনত্ব বাড়তে শুরু করে। এরপর জুন, জুলাইয়ে গিয়ে আমরা ব্যাপক ডেঙ্গু রোগী পেলাম। জ্যামিতিক হারে এডিস মশা বেড়ে গেছে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর আমাদের জন্য বেশ শঙ্কার। কিন্তু মশা নিধনের সেই কার্যকর পদক্ষেপ দেখিনি।

অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৬১ হাজার ৯৬৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ৭১ হাজার ৫০৩ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯০ হাজার ৪৬১ জন। এতে দেখা যায় জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ১৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৩ জন, মার্চে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১১১ জন এবং এপ্রিলে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৪৩ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। মে মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১০৩৬ জন এবং মারা গেছেন ২ জন। জুন মাসে ৫ হাজার ৯৫৬ জন এবং মারা গেছেন ৩৪ জন। জুলাইতে শনাক্ত ৪৩৮৫৪ জন এবং মারা গেছেন ২০৪ জন। আগষ্ট ও সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে গেছে।

গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত (একদিনে) সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরো ২১২৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৪৩ জন আর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১২৮৬ জন। একইসঙ্গে এই সময়ে ডেঙ্গুতে আরো ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৯ হাজার ৮৯১ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ৪ হাজার ১৬ জন এবং অন্যান্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৫ হাজার ৮৭৫ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছেন।

https://dailyinqilab.com/national/article/602908