১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ১২:৫৫

বড় ধরনের সংকটের দিকে যাচ্ছে অর্থনীতি

এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এক দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে। অবশ্য গত এক বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বৃহস্পতিবার রাতের সাপ্তাহিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত ৫ সেপ্টেম্বর ২৩ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার থাকলেও ১৩ সেপ্টেম্বর তা কমে ২১ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আমদানি নিয়ন্ত্রণে একাধিক উদ্যোগ নেওয়ার পরও মূলত রেমিট্যান্স প্রবাহে ধীরগতির কারণে রিজার্ভ কমছে। সর্বশেষ ৫ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৩১৮ কোটি ডলার। এরপর মূলত এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় পরিশোধ করার কারণেই রিজার্ভ কমেছে। এই দায় হচ্ছে জুলাই-আগস্ট সময়ের আমদানির বিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ জানায়, আকু বিল পরিশোধের কারণে আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ২ হাজার ১৭১ কোটি ডলারে নেমেছে। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী, বর্তমানে রিজার্ভ ২ হাজার ৭৬৩ কোটি ডলার। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকার একটি হোটেলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) আয়োজিত এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন বিষয়ক জাতীয় সেমিনারে বলেছেন, দেশের রপ্তানি ও রেমিটেন্সের পরিমাণ আমদানির তুলনায় বেশি হওয়ায় ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে কোনো বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থাকবে না।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্তে দেখা গেছে, চলতি বছরের শুরু থেকে দেশে অস্বাভাবিক আমদানির পরিমাণ ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি বেড়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখার পর আমদানিকৃত পণ্য যাচাই-বাছাইয়ের পর ৫ বিলিয়ন ডলারের আমদানি কমেছে, যা স্বাভাবিক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত মাসে মে-জুন সময়ের জন্য ১১০ কোটি ডলারের আকু বিল পরিশোধ করা হয়। এরপরের জুলাই-আগস্টে আমদানি কিছুটা বেশি। এ দায়ের জন্য ৫ শতাংশের বেশি হারে সুদ পরিশোধ করতে হয়। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি আন্ত-আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিব্যবস্থা। এর মাধ্যমে এশিয়ার ৯টি দেশের মধ্যে যেসব আমদানি-রপ্তানি হয়, তা প্রতি দুই মাস পরপর নিষ্পত্তি হয়। তবে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের লেনদেন তাৎক্ষণিকভাবে সম্পন্ন হয়।

আকুর সদস্যদেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, ইরান, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ভুটান ও মালদ্বীপ। তবে দেনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় সম্প্রতি এ তালিকা থেকে বাদ পড়েছে শ্রীলঙ্কা। আকুর বাকি দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে দুই মাস পরপর লেনদেনের অর্থ পরিশোধ করতে হয়। এসব দেশের মধ্যে ভারত পরিশোধ করা অর্থের তুলনায় অন্য দেশ থেকে বেশি ডলার আয় করে। বাকি বেশির ভাগ দেশকে আয়ের তুলনায় অতিরিক্ত ডলার খরচ করতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আকু দেশগুলো থেকে যে পণ্য আমদানি হয়, ব্যাংকগুলো তার মূল্য হিসেবে প্রতি সপ্তাহেই ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেয়। প্রতি দুই মাস শেষে ব্যাংকগুলোর পক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ দায় পরিশোধ করে থাকে। তখন রিজার্ভ হঠাৎ কমে যায়।

২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি ১৫ দশমিক ৮১ শতাংশ কমে গিয়েছিল। ওই অর্থবছরে আমদানিতে খরচ হয় ৭ হাজার ৫০৬ কোটি ডলার। তার আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানিতে খরচ হয়েছিল ৮ হাজার ৯১৬ কোটি ডলার। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এতে আমদানি খরচ বেড়ে যায় এবং ডলারের সংকট দেখা দেয়। এরপর আমদানি কমাতে নানা শর্ত ও কড়াকড়ি আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্ক বসায়। এরপর কমতে শুরু করে আমদানি ব্যয়।

এদিকে অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, যেভাবে প্রতিমাসেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ কমছে, তাতে বড় ধরনের সংকটের দিকে এগোচ্ছে দেশের অর্থনীতি এবং সেটি থেকে উত্তরণের কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। গত এক বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আমদানি-রপ্তানির ব্যয় মেটানোর পর প্রতিমাসেই প্রায় একশো কোটি ডলার করে রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। রিজার্ভের এই পতন ঠেকানোর জন্য নানারকম উদ্যোগ নেয়া হলেও তা বাস্তবে খুব বেশি কাজ আসেনি। এই মাসেই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের জুলাই-অগাস্ট প্রান্তিকের একশো বিশ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বিবিসি বাংলাকে বলেন, পুরো পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক, কারণ যেটা আমরা দেখছি, সেটা একটা আর্টিফিশিয়াল হিসাব বলে মনে করার কারণ রয়েছে। “শ্রীলঙ্কা থেকে আমরা দেড়শো মিলিয়ন ডলার পেয়েছি, সেটা এখানে যোগ হয়েছে। সেই সঙ্গে ইডিএফের (রপ্তানি উন্নয়নের তহবিল) থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলার যোগ হয়েছে। তারপরেও রিজার্ভের পরিমাণ কমে এসেছে। কিন্তু এসব টাকা আসার পরে তো রিজার্ভ বেড়ে যাওয়ার কথা, সেটা বাড়েনি। তার মানে হচ্ছে, রিজার্ভ কিন্তু অনেক বেশি পরিমাণে কমছে। এখনো অনেক রেফার্ড পেমেন্ট (যেসব পেমেন্ট পিছিয়ে দেয়া হয়েছে) আছে। এই অবস্থা আরও খারাপ হতে যাচ্ছে বলে আমার ধারণা।

অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচনের সামনে অর্থনীতিতে বড় ধরনের বা শক্ত কোন ব্যবস্থা নিতে চাইবে না সরকার। ফলে আগামী কয়েকমাসে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নির্বাচনের পর যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, তারা পরিস্থিতি সামলাতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেবে, তার ওপরেও রিজার্ভের বিষয়টি নির্ভর করবে। নির্বাচনের পরে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, অর্থনীতির অবস্থা ঠিক করতে হলে, তাদের খুব শক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে, বলছেন আহসান এইচ মনসুর।

তিনি ধারণা করেন, রিজার্ভ কমলেও সেটা হয়তো দশের নীচে নামাতে দেবে না সরকার। হয়তো অনেক পেমেন্ট আটকে রাখা হবে। বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের মতো সংস্থাগুলো থেকে অর্থ পাওয়ার চেষ্টা করবে সরকার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের শর্ত অনুযায়ী, রিজার্ভের পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলারের ওপরে থাকতে হবে।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, উদ্বেগটা অনেক বেশি এই কারণে যে, আমদানির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রেখে কমিয়ে আনার পরেও রিজার্ভের কমার প্রবণতা ঠেকানো যায়নি। ডলারের খরচ কমানোর পরেও সেটা স্থিতিশীল হচ্ছে না।

https://www.dailysangram.info/post/535584