১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৩:৩৯

ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার প্রকল্প

চ্যালেঞ্জে জাপানি ঋণের কিস্তি পরিশোধ

উৎপাদনে যাওয়ার আগেই জাপানি ঋণের কিস্তি পরিশোধের কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)। আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর শুরু হচ্ছে প্রথম কিস্তি। কিন্তু সংস্থাটির হাতে কোনো টাকা নেই। পরিস্থিতি সামাল দিতে অর্থ বিভাগের ৫২১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে। ‘ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার’ শীর্ষক প্রকল্পে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রথম কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে প্রকল্প বাস্তবায়নের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে-এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। গত ১৭ আগস্ট অনুষ্ঠিত প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভায় এসব বিষয়ে আলোচনা হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিসিআইসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর প্রকল্প। তাই এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারব না। জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এটুকুই বললাম, এতে আমার নামও কোড করা যাবে না।’

সূত্র জানায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বিসিআইসি। প্রকল্পের আওতায় নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলায় বিদ্যমান পলাশ ইউরিয়া সার কারখানার জায়গায় দৈনিক ২ হাজার ৮০০ টন এবং বার্ষিক ৯ লাখ ২৪ হাজার টন ইউরিয়া উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি নতুন কারখানা স্থাপন করা হচ্ছে। এটি অত্যাধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর এবং পরিবেশবান্ধব কারখানা হবে। যখন প্রকল্প অনুমোদন করা হয় তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। পরে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ৪৮ শতাংশ বাড়িয়ে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়। সে সময় প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয়েছিল ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত। পরে মেয়াদও বাড়িয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়। এ প্রকল্পে জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন, ব্যাংক অব টোকিও মিতসুবিশি ইউএফজে লিমিটেড ও এইচএসবিসি অর্থায়ন করছে। সরকারি তহবিলের অর্থ রয়েছে ৪ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা। গত জুলাই মাস পর্যন্ত এটির ক্রমপুঞ্জিত বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৭১ দশমিক ৬১ শতাংশ।

পিএসসি সভা সূত্রে জানা যায়, সভায় প্রকল্প পরিচালক রাজিউর রহমান মল্লিক জানান, সাধারণ ঠিকাদার প্রকল্পে সব কাজ শেষ করে আগামী অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে উৎপাদন শুরু করবে। এছাড়া ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে এটি বিসিআইসির কাছে হস্তান্তর করবে। ফলে প্রকল্পটি উৎপাদনে যাওয়ার আগেই জাপানি ইয়েন অংশের রিপেমেন্টের প্রথম কিস্তি আগামী ১৩ সেপ্টেম্বর পরিশোধ করতে হবে। এখন এটাই প্রকল্পের প্রধান চ্যালেঞ্জ। তিনি আরও বলেন, প্রথম কিস্তি বাবদ ৬৫৬ কোটি ৪১ লাখ ১৬ হাজার ১৫৬ জাপানি ইয়েন সমপরিমাণ আনুমানিক ৫২১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা প্রয়োজন। কিন্তু এই টাকা বিসিআইসি থেকে সংস্থান করা সম্ভব নয়। এই টাকা অর্থ বিভাগের মাধ্যমে পরিশোধের ব্যবস্থা করতে হবে।

সভায় অর্থ বিভাগের প্রতিনিধি বলেন, এ প্রকল্পে রিপেমেন্টের অর্থ সরকারের মাধ্যমে পরিশোধের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রকল্পের সভরেন গ্যারান্টি যেহেতু সরকার দিয়েছে, সেহেতু সরকারকেই সময়মতো অর্থ পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু বর্তমান বাজেটে রিপেমেন্টের ৫০০ কোটি টাকা কোথাও ধরা নেই। বিষয়টি অনুমোদিত হয়ে এলে অন্য কোনো খাত থেকে ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে বিসিআইসি তাদের অন্য কোনো ফান্ড থেকে ১০০ কোটি টাকার ব্যবস্থা করলে বাকি টাকা অর্থ বিভাগ থেকে দেওয়া যেত।

সভার সভাপতি ও শিল্প সচিব জাকিয়া সুলতানা পিএসসি সভায় বলেন, যেহেতু সময়মতো প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে উৎপাদনে যেতে পারেনি তাই কারখানার উৎপাদিত সার বিক্রয়ের মাধ্যমে পাওয়া অর্থ এবং ভর্তুকি বাবদ প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধ সম্ভব হচ্ছে না। বিসিআইসির হাতে এখন কোনো টাকা নেই।

যদি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ট্রেড গ্যাপের টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হয় তাহলে সেই অর্থ থেকে কিস্তি দেওয়া সম্ভব। তিনি আরও বলেন, ট্রেড গ্যাপের টাকা না পাওয়ায় বিসিআইসির পক্ষে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগকে বর্ধিত গ্যাস বিল পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ বাবদ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা পাবে। গ্যাসের সংকটে গত বছর বিসিআইসির ৪টি কারখানা প্রায় বন্ধ ছিল। ফলে বিসিআইসির পক্ষে কিস্তির টাকা পরিশোধ সম্ভব হচ্ছে না। প্রকল্প পরিচালক রাজিউর রহমান মল্লিক আরও জানান, সাধারণ ঠিকাদার আগামী ২০ আগস্ট থেকে অ্যামোনিয়া প্ল্যান্ট চালু করবে। সাধারণ ঠিকাদারের চাহিদা অনুযায়ী সময়মতো গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব না হলে প্রকল্প বাস্তবায়ন দেরি হবে। ফলে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, সার উৎপাদনে বিলম্বিত হবে এবং ঋণের সুদ বাড়বে। ফলে প্রকল্প তথা সরকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এ কারণে সাধারণ ঠিকাদারের চাহিদা অনুযায়ী প্রকল্পে নতুন আরএমএস স্থাপনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৭১ দশমিক ৯০ এমএসসিএফডি গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, প্রকল্পের আওতায় রেললাইন নির্মাণ এবং নতুন আবাসিক ভবন ও অনাবাসিক ভবন নির্মাণ প্যাকেজের কাজ পিছিয়ে আছে।
তিনি জানান, আগামী অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রীর এ প্রকল্পটি উদ্বোধনের কথা রয়েছে।

এ পর্যায়ে শিল্প সচিব বলেন, যেহেতু বিসিআইসির এ মুহূর্তে রিপেমেন্টের প্রয়োজনীয় অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব নয়, তাই অর্থ মন্ত্রণালয়কেই কিস্তি পরিশোধের ব্যবস্থা নিতে হবে। সার উৎপাদন ও বিক্রির ট্রেড গ্যাপের অর্থ পাওয়া গেলে সেই অর্থে বর্ধিত গ্যাস বিল পরিশোধ করা সম্ভব হবে বলে বিসিআইসি প্রস্তাব পাঠাবে। এছাড়া আগামী অক্টোবরে প্রকল্পটির উদ্বোধনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।

রেললাইন স্থাপন ও গ্যাস সরবরাহ দ্রুত করতে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি নতুন আবাসিক এবং অনাবাসিক ভবন নির্মাণে দ্রুত টেন্ডার মূল্যায়ন করে ঠিকাদার নিয়োগ দিতে বলেছেন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/716289