১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, রবিবার, ৩:৩৬

প্রাইভেট কোচিংয়ে পড়েও পাস করছে না ২৯ ভাগ শিক্ষার্থী

গণসাক্ষরতা অভিযানের গবেষণা

করোনাকালে শিক্ষায় ক্ষতি নিয়ে গবেষণার ফল প্রকাশ করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযান। সংস্থাটির করা নতুন এই গবেষণার তথ্য বলছে, অষ্টম ও নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ্য বইয়ের সাধারণ কয়েকটি বিষয়েও জ্ঞান অর্জন করতে পারছে না। তথ্য মতে, অষ্টম শ্রেণীর প্রায় ২৯ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে ন্যূনতম পাস নম্বরও (৩৩ শতাংশ) পায় না। নবম শ্রেণীর ক্ষেত্রে এটি প্রায় ২৬ শতাংশ। অপর দিকে গবেষণা গ্রতিবেদনের তথ্য আরো বলছে, অষ্টম ও নবম শ্রেণীর ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউটর বা কোচিংয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়। শহর ও গ্রামাঞ্চল সব পর্যায়েই এই চিত্র দেখা গেছে। আর অভিভাবকদের তথ্য অনুযায়ী, অষ্টম শ্রেণীর প্রায় ৬৪ শতাংশ এবং নবম শ্রেণীর ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউটরিংয়ের জন্য প্রতি মাসে ১ হাজার ১০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে।

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, প্রাথমিকে ৭৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ৮৫ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের পাঠ ও পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বাণিজ্যিক গাইড বই অনুসরণ করছে। ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাসে প্রাথমিক পর্যায়ে গড়ে ৬৬৯ এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ২ হাজার ৬৫ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে বলে অভিভাবকরা জানিয়েছেন ‘মহামারি-উত্তর শিক্ষা : স্কুল শিক্ষার পুনরুদ্ধার ও আগামীর অভিযাত্রা’ শীর্ষক এডুকেশন ওয়াচ ২০২২ নামের প্রতিবেদনটি গতকাল শনিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনের তথ্য উপস্থাপন করেন গণসাক্ষরতা অভিযানের উপ-পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন এডুকেশন ওয়াচের চেয়ারপারসন ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, শিক্ষক নেতা কাজী ফারুক আহমেদ, গবেষক সৈয়দ শাহাদাত হোসাইন প্রমুখ।

গণসাক্ষরতা অভিযান ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্য নিয়ে গবেষণাটি করেছে। গবেষণায় প্রাথমিক উপাত্তের উৎস ছিল দেশের আটটি বিভাগের প্রতিনিধিত্বকারী শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষা কর্মকর্তা এবং স্থানীয় এনজিও কর্মী। মোট উত্তরদাতার সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৬৯২ জন। এর মধ্যে ৩ হাজার ৮২১ জন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। যার মধ্যে প্রায় সমানসংখ্যক ছেলে ও মেয়ে। আট বিভাগের আটটি জেলা ও ২১টি উপজেলা এবং দুটি সিটি করপোরেশন এই গবেষণার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

গবেষণার অংশ হিসেবে গত বছরের অক্টোবরে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে ৯০ মিনিটের পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শিখন দক্ষতা মূল্যায়ন করা হয়। অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যক্রমে নির্ধারিত দক্ষতা পর্যালোচনা করে পরীক্ষাটি মধ্যম মানের কঠিন করা হয়েছিল। সামগ্রিক ফলাফলে দেখা গেছে, অষ্টম শ্রেণীর ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থী ৩৩ শতাংশ নম্বর অর্জন করতে পারেনি। নবম শ্রেণীর ক্ষেত্রে এই হার ছিল ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। ‘ডি’ গ্রেড (৩৩ থেকে ৩৯ শতাংশ নম্বর) অর্জন করেছে অষ্টম শ্রেণীতে ৩৬ দশমিক ১ শতাংশ এবং নবম শ্রেণীতে ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক পারদর্শিতার (পারফরম্যান্স) চিত্রও উঠে এসেছে এ গবেষণায়। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৮২ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলায়, ৬৫ শতাংশ ইংরেজিতে এবং ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে ৩৩ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাস করেছে। আর নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলায় ৮৪ শতাংশ, ইংরেজিতে ৭২ শতাংশ এবং গণিতে ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। আবার ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ভালো করেছে। যেমন অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৪ শতাংশ মেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে এবং ছেলেদের মধ্যে এই হার ৬৮ শতাংশ। নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ মেয়ে এবং ৭৩ শতাংশ ছেলে উত্তীর্ণ হয়েছে। সামগ্রিক ফলাফলে যশোর জেলায় ৯০ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তীর্ণ হয়েছে। আর সবচেয়ে পিছিয়ে আছে হবিগঞ্জ জেলা, যেখানে পাসের হার ৪২ দশমিক ৯ শতাংশ।

৮৫ শতাংশ প্রাইভেট কোচিং নির্ভর : গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, অষ্টম ও নবম শ্রেণীর ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউটর বা কোচিংয়ের ওপর নির্ভর ছিল। শহর ও গ্রামাঞ্চল সব পর্যায়েই এই চিত্র দেখা গেছে। আর অভিভাবকদের তথ্য অনুযায়ী, অষ্টম শ্রেণীর প্রায় ৬৪ শতাংশ এবং নবম শ্রেণীর ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী প্রাইভেট টিউটরিংয়ের জন্য প্রতি মাসে ১ হাজার ১০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করেছে।

প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, প্রাথমিকে ৭৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ৮৫ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের পাঠ ও পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বাণিজ্যিক গাইড বই অনুসরণ করছে। ২০২২ সালের প্রথম ৯ মাসে প্রাথমিক পর্যায়ে গড়ে ৬৬৯ এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ২ হাজার ৬৫ টাকা পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে বলে অভিভাবকরা জানিয়েছেন।

করোনা মহামারীতে বিদ্যালয় বন্ধের কারণে শিক্ষার্থীদের শিখনের ওপর সামগ্রিকভাবে বিরূপ প্রভাব পড়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। শিখন ঘাটতি যে হয়েছে সে বিষয়ে অংশীজনদের মধ্যে কোনো দ্বিমত ছিল না। শিক্ষকদের মধ্যে ৯৯ শতাংশের বেশি এবং শিক্ষা কর্মকর্তাদের মধ্যে শতভাগ মনে করেন, করোনাকালে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিখন ক্ষতি হয়েছে। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৭১ শতাংশ এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর মতে বিদ্যালয় খোলার পর তারা পাঠ বোঝার জন্য বিশেষ কোনো সহায়তা পায়নি।
গবেষণার তথ্য বলছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় স্তরের প্রায় এক-চতুর্থাংশ অভিভাবক শিক্ষার্থীদের মুঠোফোনের অত্যধিক ব্যবহারকে একটি সমস্যা (মুঠোফোন আসক্তি) হিসেবে দেখেছেন। তবে তিন-চতুর্থাংশ বাবা-মা এটিকে কোনো উল্লেখযোগ্য সমস্যা হিসেবে দেখেননি।

ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার জন্য কিছু পরামর্শ এসেছে গবেষণায়। এর মধ্যে বেশির ভাগ শিক্ষক মিড ডে মিলকে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া কর্মী দল গঠন করা, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত পরিবারগুলোর জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিধি বাড়ানো পাঠদানকে শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা, পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য পড়ালেখায় আরো সহায়তা দেয়া ইত্যাদি পরামর্শও এসেছে। প্রতিবেদনে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছে।

অনুষ্ঠানে এডুকেশন ওয়াচের সভাপতি ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেছেন, বাংলাদেশে নীতির কোনো সঙ্কট নেই। শিক্ষা হোক, স্বাস্থ্যসেবা হোক ভালো নীতি আছে। সঙ্কট হচ্ছে বাস্তবায়নে, এটি একেবারে সর্বক্ষেত্রে। বাস্তবায়নের কাজে যারা থাকেন, তারা সঠিকভাবে কাজ করেন না, সময় মতো করেন না। আর সুযোগ থাকলে নিজেদের পকেট একটু ভারী করার চেষ্টা করেন। গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘আমরা খারাপের দিকে যেতে চাই না। আলোর দিকে যেতে চাই।’

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/776177