৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৩:৫১

সার সঙ্কটের শঙ্কা

দেশে চলছে আমনের ভরা মৌসুম। এ মৌসুমে সারের চাহিদা বোরো মৌসুমের চেয়ে অনেক কম। তবে এবার জুলাই মাসে বৃষ্টি কম হওয়ায় ইউরিয়া সারের চাহিদা অন্যান্য বারের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। চলতি সেপ্টেম্বর মাসে আমন ও আগাম শীতের সবজি চাষে এ সারের চাহিদা ৫ লাখ টনের বেশি। বর্তমানে দেশে ইউরিয়া সারের মজুত প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টন। অন্যদিকে আগামী অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়ে ১৬ লাখ টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হবে। কারণ জানুয়ারিতে শুরু হবে ধানের প্রধান মৌসুম বোরোর আবাদ। অক্টোবরের শেষ থেকেই শীতকালীন সবজি ও পেঁয়াজের আবাদ শুরু হবে। সাধারণত এই সময়টিতেই সারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে।

এ অবস্থায় গ্যাস সঙ্কটের কারণে দেশের ৩টি সার কারখানায় এখন উৎপাদন বন্ধ। অন্যদিকে মার্কিন ডলারের সঙ্কট, সরবরাহকারীদের পাওনা ও দরপত্রে অংশ নিতে ঠিকাদারদের অনীহায় নতুন অর্থবছরের (২০২৩-২৪) শুরুতে সার আমদানি সঙ্কটের মুখে পড়েছে। কৃষিমন্ত্রণালয় চেষ্টা করেও এ সমস্যার এখনো সমাধান করতে পারছেনা। ফলে আগামী বোরো মৌসুমে সারের সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরী হয়েছে। দ্রুত আমদানি করতে না পারলে সারের সঙ্কট দেখা দেবে এমনটাই বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। বিএডিসির চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ সাজ্জাদ বলেন, আমরা সার আমদানি দ্রুত করার চেষ্টা করছি। চলতি মাসের মধ্যে রাশিয়া, তিউনিসিয়া ও মরক্কো থেকে সার আসছে। আশা করি বড় কোনো সংকট হবে না। যে তিনটি কারখানা এখন বন্ধ, সেগুলোতে ইউরিয়া উৎপাদিত হতো। গ্যাস না পেয়ে গত সপ্তাহে যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। গ্যাস সঙ্কট কেটে গেলে আবার উৎপাদন শুরু হবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিমুক্ত রাখতে কৃষি খাতে চাষাবাদ ও ফসলের উৎপাদন ঠিক রাখার জন্য সারের নির্বিঘœ সরবরাহ জরুরি। কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমিয়ে রাখতে সরকার ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহ করে। চলতি আমন ও আগামী জানুয়ারিতে শুরু হতে যাওয়া বোরো মৌসুমে সারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকবে। এ সময় সারের সরবরাহে ঘাটতি হলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। এতে চরম খাদ্য সঙ্কট দেখা দিতে পারে বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

কৃষি মন্ত্রণালয় ও সার আমদানিকারক সূত্রে জানা যায়, মন্ত্রণালয়ের কাছে সরবরাহকারীদের পাওনা প্রায় ৬ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। পাশাপাশি সার আমদানি করতে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা দরকার। সেটারও সংকট চলছে ব্যাংক খাতে। অবশ্য সমস্যা শুধু সার আমদানিতে নয়, জ্বালানি আমদানিতেও প্রয়োজনীয় মার্কিন ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। বেসরকারি খাতও পণ্য আমদানি করতে গিয়ে সংকটে পড়ছে।

তবে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ডলার-সংকটজনিত সমস্যা আছে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার-সংকট মোকাবিলা করার জন্য আমরা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে কথা বলছি। আমাদের কাছে এখন পর্যাপ্ত সার মজুত আছে। সামনের বোরোর আগে আমরা এসব সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারব।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বছরে প্রায় ৬০ লাখ টন সারের চাহিদা আছে। এর বড় অংশ আমদানি হয়, বাকিটা দেশের কারখানায় উৎপাদিত হয়। উৎপাদন আবার নির্ভর করে গ্যাস সরবরাহের ওপর। ২০২১-২২ অর্থবছরে সার বিক্রি হয়েছে প্রায় ৫৯ লাখ টন। এর মধ্যে ৫২ লাখ টন আমদানি হয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারের চাহিদা ধরা হয়েছে ৬৮ লাখ টনের কিছু বেশি। এর প্রায় ৪০ লাখ টন আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। চলতি অর্থবছরের শুরুতে ছয় লাখ টন সার আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু দেশের বড় আমদানিকারকেরা তাতে সাড়া দেয়নি।

সার উৎপাদনকারী কারখানাগুলোর মধ্যে চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি লিমিটেড ও আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের (এএফসিসিএল) মেরামতকাজের জন্য গত বছর বন্ধ করা হয়েছিল। চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার ফ্যাক্টরি গ্যাস সঙ্কটের জন্য গত মার্চ থেকে উৎপাদনে যেতে পারছে না। আর আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি গত জুন থেকে গ্যাসের অভাবে বন্ধ রয়েছে। এদিকে নরসিংদীর পলাশ উপজেলায় চালুর অপেক্ষায় থাকা ঘোড়াশাল পলাশ ফার্টিলাইজার পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিও গ্যাস সঙ্কটের জন্য গত সপ্তাহে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন বিসিআইসির অধীনে শুধু শাহজালাল ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে ইউরিয়া উৎপাদন হচ্ছে। তবে এর উৎপাদন ক্ষমতা খুবই সামান্য।

দেশে সাধারণত তিন মাসের জন্য প্রয়োজনীয় সার মজুত থাকে। বর্তমানে প্রায় দেড় মাসের চাহিদা পূরণের মতো সার মজুত আছে। এরই মধ্যে গ্যাসের সঙ্কটে গত সপ্তাহে বন্ধ হয়ে গেছে দেশের সবচেয়ে বেশি সার উৎপাদনকারী কারখানা যমুনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড। এটিসহ এখন বন্ধ তিনটি সার কারখানা। এমন একটা সময়ে সারের মজুত কম এবং কারখানাটি বন্ধ হলো, যখন চাহিদা অনেক বেশি। দেশে এখন ধানের দ্বিতীয় প্রধান মৌসুম আমনের আবাদ চলছে। জানুয়ারিতে শুরু হবে ধানের প্রধান মৌসুম বোরোর আবাদ। অক্টোবরের শেষ থেকেই শীতকালীন সবজি ও পেঁয়াজের আবাদ শুরু হবে। সাধারণত এই সময়টিতেই সারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবার আমনে সারের চাহিদা অনেকটাই রেড়ে গেছে। গত জুলাই মাসে বৃষ্টি কম হয়েছে। এতে মাটির উবর্বতা কমে যাওয়ায় সারের প্রয়োজন বেড়েছে। উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষককে এবার অন্যান্য বছরের চেয়ে ১০ থেকে ২০ শতাংশ বেশি সার জমিতে ব্যবহার করতে হবে।

বিশ্ববাজারে মূল্যবৃদ্ধি ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষি মন্ত্রণালয় গত এপ্রিলে সারের দাম কেজিপ্রতি ৫ টাকা করে বাড়ায়। এখন কৃষক পর্যায়ে প্রতি কেজি ইউরিয়ার দাম ২৭ টাকা, ডিএপি ২১ টাকা, টিএসপি ২৭ টাকা ও এমওপি ২০ টাকা। গত বছর সারে ভর্তুকি বাবদ সরকারকে ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। এ বছর বিশ্ববাজারে সারের দাম কমায় আশা করা হয়েছিল ভর্তুকি বাবদ ব্যয় কমবে। কিন্তু প্রতিযোগিতামূলক দামে আমদানি করতে না পারলে বেশি খরচ পড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়।

কৃষক পর্যায়ে এখনো সার নিয়ে সংকট হয়নি। তবে কোথাও কোথাও কৃষকদের সার কিনতে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দিতে হচ্ছে। কোথাও কোথাও সারের সঙ্কট দেখিয়ে কৃষকদের কাছে কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। আবার কোথাও সরকার নির্ধারিত দামে এখনও সার বিক্রি হচ্ছে। আমাদের নেত্রকোণা জেলা সংবাদদাদা এ কে এম আব্দুল্লাহ জানান, চলতি আমন মওসুমে নেত্রকোনা জেলায় ১ লাখ ৩২ হাজার ৫ শত ৮০ হেক্টর জমিতে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইেিতামধ্যে প্রায় শতভাগ জমি আবাদ হয়েছে। চলতি আমন মওসুমের প্রথম দিকে প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত না হলেও পরবর্তীতে টানা বৃষ্টিপাত হওয়ায় একটু দেরীতে হলেও নেত্রকোনায় আমনের চাষ ভালভাবেই হয়েছে। নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটী ইউনিয়নের অনন্তপুর গ্রামের কৃষক এনাম আহমেদ বলেন, শেষের দিকে পর্যাপ্ত বৃষ্টি হওয়ায় সমস্ত জমিতে আমন ধান আবাদ শেষ করেছি। সার ঠিক মত পেয়েছি। এখনো সারের কোন সঙ্কট হয়নি।

ময়মনসিংহের গফরগাঁও থেকে মুহাম্মদ আতিকুল্লাহ জানান, গফরগাঁও পৌরসভাসহ উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের চলতি আমনের আবাদ হয়েছে ২২হাজার ৪শত হেক্টর ও সবজি আবাদ হয়েছে ৭০ হেক্টর। মোট ইউরিয়া সারের চাহিদা রয়েছে ৭শত ৫০ মেট্রিক টন । প্রতিটি ৫০ কেজি ইউরিয়া সারের বস্তা এখন বিভিন্ন হাট বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৩৫০টাকা থেকে ১৪০০ টাকা । গফরগাঁও পৌরসভাসহ বিসিআইসির সারের ১৬জন ডিলার , বিএডিসির ডিলার ২৬জন ও খুচরা অনুমোদিত দোকান ১৪৪টি। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য জাতের সারের দামও অনুরুপ ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে । গফরগাঁও উপজেলার ১নং রসুলপুর ইউনিয়নের ছয়আনি রসুলপুর গ্রামের সবজি কৃষক মোঃ ছলিম উদ্দিন জানান, ভাইরে আগে ইউরিয়া সারসহ নানান ধরনের সারের দাম কম ছিল। ফলে অল্প খরচে শাকসবজি, আমন ফসল করতে পেরেছি। কিন্তু এখন সারের দাম বৃদ্ধি পাওয়া আমাদের ফসল উৎপাদনের খরচ বেড়ে গেছে। আমন ফসল যাতে ভাল ভাবে উৎপাদন হয়ে থাকে এর জন্য সারের দাম কমানো দরকার। কৃষি অফিস বলছে, আমন ও শাক সবজির জন্য ইউনিয়াসহ নানান ধরনের সারের সংকট হবে না। পর্যাপ্ত পরিমানের সার মজুদ রয়েছে। আমরা সরে জমিনে তদারকি করছি। যাতে কোন ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট করতে না পারে। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম, নীলফামারি এবং যশোরের কোথাও কোথাও ইউরিয়া সার কৃষক পর্যায়ে কেজিতে ১ থেকে ২ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে এমন খবর পাওয়া গেছে।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ইনকিলাবকে বলেন, এখনকার বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে ফসল চাষের সার আমদানি নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্দিষ্ট পরিমাণে নিশ্চিত করতে হবে। সরকার সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য গাড়ি কেনায় বরাদ্দ বাড়াচ্ছে। বেতনও বাড়িয়েছে। কিন্তু সারের বকেয়া টাকা পরিশোধ করছে না। রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকারি কর্মকর্তাদের তুষ্ট করার চেয়ে কৃষকের জন্য দ্রুত সার আনা বেশি জরুরি। তা না হলে চরম খাদ্য সঙ্কটে পড়তে হতে পারে।

https://dailyinqilab.com/national/article/601192