৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৩:২৭

হাওরে বিলুপ্তির পথে দেশী মাছ

সুনামগঞ্জের হাওর এক সময় মাছের রাজ্য হলেও আগের তুলনায় এখন প্রচুর পরিমাণে দেশী প্রজাতির মাছ গ্রাম এলাকা ও হাট-বাজারে মিলছে না। বর্তমানে অন্তত ৩০-৩৫ প্রজাতির দেশী মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। বাজার দখল করেছে চাষযোগ্য হাই ব্রিড জাতীয় মাছ।
যার কারণে হাইব্রিড জাতীয় চাষের মাছ খেয়ে মিটাতে হচ্ছে আমিষের চাহিদা। হঠাৎ কখনো কিছু দেশী মাছ মিললেও চড়া দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

সুনামগঞ্জের হাওরে এক সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ মিঠা পানির দেশী সুস্বাদু মাছ পাওয়া যেত। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া ওই মাছ স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও ভৈরবে পাঠানো হতো, যা দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির খাতে ভূমিকা রাখতো। এক যুগ আগেও বহু প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত হাওরে। এখন আর এই সব মাছ সচরাচর চোখে পড়ে না। ফাল্গুন- চৈত্র মাসে অবাধে জলমহাল সেচে মৎস্য নিধন করার মূল করণেই দেশী মাছ কমে যাচ্ছে। নির্বিচারে পোনা মাছ ধরা, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, কৃষি জমিতে অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার বর্ষায় মাছের প্রজনন ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হওয়া এ সব কারণে গত কয়েক বছরে প্রায় ৩০-৩৫ জাতের দেশী মাছ প্রায় বিলুপ্তির পথে। তার মধ্য রয়েছে রানী মাছ, গুতুম, দারকিনা, চাপিলা, চাটুয়া, চাঁন্দা, বড় চান্দা, গোল চান্দা, আইড়, গুলশা, পাবদা, দেশী পুঁটি, সরপুঁটি, তিত পুঁটি, বাইলা, মেনি, ভেদা, শিং, কৈ, টাকি, শোল, কাংলা, দারকিনা, মলা, ঢেলা, কানপোনা, রিটা, পিয়ালি, খৈলশা, ছোট টেংরা, বড় টেংরা, কাজলি, চ্যাং, ছোট চিংড়ি, বাতাশি, বড় বাইম, বাগাই, তারা বাইম, কাইক্যা ইত্যাদি। এ সব মাছের জায়গা দখল করেছে হাইব্রিড পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, সিলভার, কার্গো, মিরর কার্প, ঘ্রাস কার্প, সরপুঁটি ইত্যাদি।

বিভিন্ন এলাকার মাছ বাজার ঘুরে দেখা গেছে দাম-দরের অস্থিরতা। এক-দুই বছর আগেও যেখানে তেলাপিয়া ছিল মধ্যবিত্তের সাধ্যের ভেতরে, সেখানে তেলাপিয়ার দাম এখন দ্রুত গতিতে বাড়ছে। একই অবস্থা পাঙ্গাশেরও।

বাজারে আকার ভেদে তেলাপিয়ার কেজি ২০০ থেকে ২২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত বছরের এমন দিনে তেলাপিয়ার কেজি ছিল ১২০-১৪০ টাকার মধ্যে। গরিবের মাছ হিসেবে খ্যাত পাঙ্গাশের কেজি গত বছরের এমন দিনে ১২০-১৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও এখন পাঙ্গাশ ১৮০ থেকে ২২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সিলভার কাপ বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে আকার ভেদে।
আর এ জাতীয় মাছেই আমিষের চাহিদা মিটতো নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের। কিন্তু দাম বাড়ায় সেটিও এখন অনেকের ভাতের পাতে জুটছে না। বাজারে আসা ক্রেতাদের অনেকে বলেন, তেলাপিয়া-পাঙ্গাশে আমাদের স্বস্তি ছিল এক বছর আগেও। সেই জায়গাটাতেও এখন চরম অস্বস্তি।

শুধু পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া বা সিলভারই নয়, অন্যান্য মাছের দামও বেড়েছে। বাজারে প্রতি কেজি আকার ভেদে রুই-কাতলা ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। কৈ মাছ (বড়) বিক্রি হচ্ছে ২৬০-২৮০ টাকা দরে। এ ছাড়া চিংড়ি মাছের মধ্যে ছোট আকারের প্রতি কেজির দাম ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। মাঝারি আকারের প্রতি কেজি ৩০০ টাকার বেশি।

এ দিকে জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার সর্ববৃহৎ পাকনা হাওর ও হালির হাওর ঘুরে কয়েকজন জেলের সাথে কথা হলে তারা বলেন, এখন আগের মতো মাছ নেই হাওর বা নদীতে। হাওরে পাতানো জাল তুলে হতাশ হতে হয় তাদের। কিছু ছোট পুঁটি, চান্দা, বাইলা, তারা বাইম পাঁচ মিশালি মাছ ছাড়া অন্য কোনো মাছের দেখা নেই।

জেলেরা বলেন, সারা দিন হাওরে মাছ মেরে তাদের রোজের পারিশ্রমিক অনেক দিন হয় না। আগে বর্ষার পানিতে হাওরে রুই, কাতলা, বোয়াল, কালিবাউসসহ অনেক জাতের মাছ পাওয়া যেত।

এখন কিছু ইছা, ছোট পুঁটি আর চান্দার গুঁড়া কিছু পাঁচমিশালি মাছ ছাড়া তেমন কোনো মাছ মিলে না। এর মধ্যে জলমহাল (বিল) ইজারাদারদের রক্তচক্ষু ও তাদের দৌরাত্ম্যের কারণে জেলেরা চরম হতাশ হয়ে পড়েন।

ভরা বর্ষায় হাওরের বেশ জায়গা জুড়ে জলমহালের সীমানা দিয়ে তারা জেলেদের মাছ ধরার বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এতে অনেক সময় বাগি¦তণ্ডায় জেলেদের ওপর অত্যার নেমে আসে।

বেশ কিছু বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ভরা বর্ষা মৌসুমে পুকুরে চাষ করা পাঙ্গাশ, কই, তেলাপিয়া ছাড়া প্রাকৃতিক পানির মাছ নেই বললেই চলে।

বাজার এখন চাষের মাছের দখলে। আর যে দু-একটা জাতের মাছ পাওয়া যায়, তার দাম সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে।
জামালগঞ্জ-সাচনাবাজারসহ গ্রামীণ হাট-বাজারেও এখন হাইব্রিড মাছের দখলে। বর্ষা ও হেমন্তে জলাশয়ে জেলে ও জলমহালের ইজারাদাররা মাছ ধরে এলাকার বাহিরের পাইকারদের কাছে বেশি দামে বিক্রির কারণে মাছের সিজনেও প্রায়ই দেশী মাছ পাওয়া যায় না।
জামালগঞ্জ উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম বলেন, জলমহাল সেচে মৎস্য নিধন, নির্বিচারে পোনা মাছ ধরা, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে গত কয়েক বছরে ধীরে ধীরে বেশ কিছু প্রজাতির দেশী মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তবে এসব বন্ধ করে মাছের প্রজননের জন্য নিরাপদ আশ্রয় স্থল তৈরি করে এলাকাবাসী সচেতন হলে দেশী মাছ রক্ষার একটা উপায় হতে পারে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/775921