৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শনিবার, ৩:০৬

খাদ্যসঙ্কটের শঙ্কায় বিশ্ব

ইবনে নূরুল হুদা

বিশ্ব তীব্র খাদ্য সঙ্কটের শঙ্কায় পড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন হ্রাস, করোনার দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কট ও মন্দা, বিশ্বের শীর্ষ খাদ্য উৎপাদনকারী দেশগুলোর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা এবং আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থায় বিপর্যয় এই আশঙ্কাকে রীতিমত জোরালো ভিত্তি দিয়েছে। যা বিশ্ববাসীকে রীতিমত উদ্বেগ-উৎকন্ঠার মধ্যে ফেলেছে।

এক্ষেত্রে বৈশ্বিক উৎপাদন হ্রাসই অন্যতম প্রধান সমস্যা। বিষয়টিকে কোন কোন খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ অধিক মুনাফার জন্য খানিকটা অজুহাতও বানিয়ে পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ন্ত্রণ ও স্থানীয় প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার কথা বলে গত জুলাইয়ের শেষদিকে বাসমতি ছাড়া অন্য সকল প্রকার চালের রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে আমাদের বৃহত্তর প্রতিবেশী ভারত। বিশ্বের বৃহত্তর চাল রপ্তানিকারক দেশ থেকে আসা এ নিষেধাজ্ঞা বিশ্ববাজারে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। কারণ, বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ, বিশেষ করে এশিয়া ও সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলো ভারতীয় চালের ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া এ নিষেধাজ্ঞা তাদের অভ্যন্তরীণ চাল রপ্তানির এক-চতুর্থাংশকেও প্রভাবিত করছে। আল জাজিরা বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে শস্যচুক্তি থেকে রাশিয়ার বের হয়ে যাওয়ার পরপরই চাল রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা একটি বড় ধরনের খাদ্যসঙ্কট সৃষ্টির ইঙ্গিত দিয়েছে। দেশটির এমন নেতিবাচক সিদ্ধান্তের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে।

অবশ্য ভারত বলছে, ভূরাজনৈতিক ও জলবায়ু পরিস্থিতির বড় ধরনের অবনতি, খারাপ আবহাওয়াসহ নানা কারণে দেশটি চাল রপ্তানি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। এর আগে ২০২২ সালে তীব্র তাপপ্রবাহের ফলে ভারতের গম উৎপাদন ব্যাপক হারে কমে যায় বলে দাবি করা হয়। সে সময় নয়াদিল্লী গম রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এক বছরের বেশি সময় পার হলেও সে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়নি। অন্যদিকে শস্যচুক্তি বাতিল হওয়ার পর ইউক্রেন থেকেও গম রপ্তানি এক প্রকার বন্ধই রয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দামও সকল সময়ের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।

মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই খাদ্য উৎপাদন অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। বিশ্বের অন্যতম সয়াবিন ও শীর্ষ ভুট্টা উৎপাদনকারী দেশ আর্জেন্টিনা দীর্ঘ ৬ দশকের মধ্যে বড় ধরনের খরায় ভুগছে। ফলে এ দু’টি শস্যের ফলনও আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। সয়াবিন উৎপাদনে শীর্ষ আরেকটি দেশ ব্রাজিলও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তীব্র খরার মুখোমুখি। খারাপ আবহাওয়ার কারণে কানাডায় ১৪ বছরের মধ্যে ক্যানোলা তেলের ফলন প্রান্তিক পর্যায়ে নেমে এসেছে। বিশ্বের বৃহত্তম পাম তেল রপ্তানিকারক দেশ ইন্দোনেশিয়া ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির মধ্যেই গত বছর সাময়িকভাবে পাম তেল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সূর্যমুখী তেলের সরবরাহও কমে গেছে। সব মিলিয়ে ভোজ্যতেলের বাজারেও অস্থিরতা চলছে তীব্রভাবেই।

আল জাজিরা বলছে, আবহাওয়ার বিপর্যয়, রপ্তানি রোধ ও ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা বিশ্বের খাদ্যনিরাপত্তাকে চিরস্থায়ী ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর একটা সমাধান অবশ্যই আছে। অবাধ বাণিজ্যের অনুমতি দেয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনকে আরও ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারে এমন ফসলের উন্নত জাত আবিষ্কার বিশ্বকে আসন্ন সঙ্কট মোকাবিলা করতে সাহায্য করতে পারে। যা খুবই প্রয়োজনীয়, যৌক্তিক ও কাক্সিক্ষত।

চাল বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যার প্রধান খাদ্য। প্রতি বছর বিশ্বে ৫শ’ মিলিয়ন মেট্রিক টনেরও বেশি চালের প্রয়োজন হয়। বিশ্বব্যাপী চাল রপ্তানির ৪০ শতাংশই ভারতের দখলে। অপর বৃহৎ রপ্তানিকারক দেশ হলো থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র। খাদ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারত বাসমতি ছাড়া অন্য সব চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি আতপ চাল রপ্তানিতে ২০ শতাংশ কর আরোপ করেছে। অথচ গত দুই বছরে এ ধরনের চাল বিশ্ববাজারে প্রায় ১০ শতাংশ চাহিদা সৃষ্টি করেছে। ভারতের মোট চাল রপ্তানির ৪০ শতাংশই এ দুই ধরনের চালের ওপর নির্ভরশীল। তারা বলছেন, এ চাল মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, নেপাল ও বাংলাদেশসহ নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্য নির্ধারিত। সম্প্রতি ক্যামেরুন, মাদাগাস্কার ও কটে ডি’আইভরির মতো আফ্রিকান দেশগুলো এ ধরনের চালের অন্যতম প্রধান ক্রেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। মূলত, এ ধরনের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা বাজারকে অস্থিতিশীল করে তোলে। এমন সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধি সৃষ্টি করে। বিশেষ করে, সঙ্কটের ভয়ে বেশি চাল কিনতে চাওয়া দরিদ্র দেশগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

চালের বৈশ্বিক সঙ্কটকে পুরোপুরি কাজে লাগাচ্ছে আমাদের নিকট প্রতিবেশী ভারত। জানা গেছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দেশটি পর্যাপ্ত অভ্যন্তরীণ সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য শুল্কের মাধ্যমে বাসমতি ছাড়া অন্য সাদা চালের আন্তর্জাতিক ক্রয়কে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের সে কৌশল পুরোপুরি সফল হয়নি। কর থাকা সত্ত্বেও ভারত থেকে এ ধরনের চাল রপ্তানি গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চের মধ্যে ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন বিজেপি শাসিত দেশটি কিছু চালের রপ্তানি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী দাম বহুগুণে বেড়েছে। এফএও’র সব মূল্যসূচক অনুসারে, চালের দাম গত ১২ বছরের মধ্যে চলতি বছরের জুলাইয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট দাবি করেছে, ভারতের নিষেধাজ্ঞার ফলে থাই সাদা চালের দাম প্রায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ খাদ্যনিরাপত্তা আপডেট অনুসারে, মোট ২০টি দেশ তাদের প্রধান খাদ্যপণ্যের ওপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। তাদের মধ্যে আফগানিস্তান গম, বাংলাদেশ চাল ও ক্যামেরুন উদ্ভিজ্জ তেল এবং খাদ্যশস্য রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। অপর দিকে রাশিয়া এবং উগান্ডা সূর্যমুখী তেল, গম, বার্লি, ভুট্টা ও চালের মতো কিছু পণ্যের ওপর রপ্তানি কর আরোপ করেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার ‘সামরিক অভিযান’ শুরু হওয়ার পর থেকে বাণিজ্য-সীমাবদ্ধ করার নীতিগুলোর প্রয়োগ বিশেষভাবে বেড়েছে।

মূলত, বিশ্বে খাদ্য চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মহামারির কারণে এমনিতেই খাদ্যপণ্যের বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলা চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে। সর্বোপরি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ববাজারকে অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় সর্বাধিক অস্থির করে তুলেছে। এফএও’র সূচক অনুসারে, ২০২২ সালের মার্চ থেকে বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্য সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়, যা গত প্রায় এক দশকে দেখা যায়নি। যুদ্ধের আগে রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বব্যাপী গমের রপ্তানির ৩৪ শতাংশ, বার্লির ২৭ শতাংশ, ভুট্টার ১৭ শতাংশ ও সূর্যমুখী তেলের ৫৫ শতাংশ পূরণ করতো। বিশেষ করে কিছু কিছু দেশ দুটি বৃহত রপ্তানিকারকের ওপর অনেক বেশি মাত্রায় নির্ভরশীল ছিল। উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য তাদের খাদ্যপণ্য সরবরাহের ৫০ শতাংশই পেতো রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে।

যুদ্ধ চলাকালে কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার সামরিক অবরোধের ফলে গত বছরের মার্চ থেকে জুলাইয়ের মধ্যে ইউক্রেনের রপ্তানি এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু জাতিসংঘ ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় কিয়েভের সঙ্গে যুগান্তকারী শস্যচুক্তি করে মস্কো। এ চুক্তির পরে ২০২২ সালের জুলাই ও ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ইউক্রেন থেকে ৩ কোটি ২০ লাখ মেট্রিক টন ভুট্টা, গম ও অন্য শস্য রপ্তানি হয়। কিন্তু গত ১৭ জুলাই রাশিয়া শস্যচুক্তি নবায়ন না করায় ইউক্রেনের শস্য রপ্তানি আবারও হুমকির মধ্যে পড়ে। এমনকি সম্ভাব্যভাবে ইউক্রেনের পরিকল্পিত ৪ কোটি ৫০ লাখ টন শস্য রপ্তানি বন্ধ হওয়ার উপক্রম। যা সার্বিক পরিস্থিতিকে আরো জটিল ও অস্থির করে তুলেছে।

২০২২ সালে পাকিস্তানের বিশাল অংশজুড়ে ভয়াবহ বন্যার কারণে প্রায় চেক প্রজাতন্ত্রের আয়তনের সমান কৃষিজমি প্লাবিত হয়। ওই বন্যায় দেশটির ৮০ শতাংশেরও বেশি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও চরম খাদ্যসঙ্কটে তৈরি করে। বর্তমানে প্রতিনিয়ত চরম আবহাওয়ার মুখোমুখি হচ্ছে আর্জেন্টিনা ও স্পেন; যারা চলতি বছর অভূতপূর্ব খরার সম্মুখীন হয়েছে। ফলে দেশগুলোতে খাদ্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার খাদ্য বিভাগ জানিয়েছে, এ বছর তাদের গমের ফলনে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এ বছর বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম শস্য রপ্তানিকারক দেশটির গমের উৎপাদন ৩৪ শতাংশ হ্রাস পেতে চলেছে। নিউইয়র্কভিত্তিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-সম্পর্কিত কৃষি-শিল্প বিশ্লেষণ সংস্থা গ্রো ইন্টেলিজেন্সের মতে, উচ্চ তাপমাত্রা যুক্তরাষ্ট্রের ভুট্টার ফলনের পাশাপাশি ইউরোপ ও কানাডায় গমের উৎপাদনকেও প্রভাবিত করছে।

কেনিয়া, সোমালিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া, হাইতি, চিলি ও বলিভিয়ায়ও এ বছর প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ফসলের ফলন কম হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের একটি অংশে উৎপাদন হ্রাস, তাত্ত্বিকভাবে অন্যান্য দেশে বাম্পার ফলন দ্বারা ক্ষতিপূরণ করা খুবই সম্ভব। আন্তর্জাতিক বোদ্ধামহল মনে করছে, আবহাওয়া চরমভাবে ফসলের উৎপাদনকে প্রভাবিত করে, কিন্তু এ প্রভাব সারাবিশ্বে এক নয়। বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহের খুব বেশি পরিবর্তন ঘটে না। একটি বৈশ্বিক খাদ্য ব্যবস্থা এ ধরনের ঘাটতি মোকাবিলা করতে পারে, কারণ অধিকাংশ দেশের মধ্যে যথেষ্ট সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব রয়েছে ও আমরা খাদ্যকে অবাধে চলাচলের অনুমতি দিই। তারা আরো বলছেন, খরার কারণে ২০২১ ও ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রসহ এশিয়ার কিছু দেশে গম ও ভুট্টার ফলন কম হলেও একই সময়ে অস্ট্রেলিয়ায় গমের বাম্পার ফলন হয়েছিল। যা ছিল সৃষ্ট সঙ্কট মোকাবেলায় খুবই সহায়ক।

মূলত, নানাবিধ কারণেই বিশে^ তীব্র খাদ্যসঙ্কটের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। তাই উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় নতুন নতুন কর্মকৌশল গ্রহণের আবশ্যকতাও দেখা দিয়েছে। খাদ্য ও কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ও ফলন হ্রাস উভয় চ্যালেঞ্জই মোকাবিলা করা খুবই সম্ভব, যদি একটি যুগোপযোগী বৈশ্বিক কৌশল অবলম্বন করা যায়। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো নানা সঙ্কট দেখা দিলেও খাদ্যের মজুত কিন্তু কয়েক বছর ধরে একই স্তরে রয়েছে। এমনকি চলতি বছরের জুনে এফএও’র সর্বশেষ পূর্বাভাস প্রকৃতপক্ষে মৌলিক কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও মজুত বৃদ্ধি দেখিয়েছে। তাদের মতে, এমন পরিস্থিতিতে দরিদ্র দেশগুলোকে আশ্বস্ত করার জন্য রপ্তানিকারকদের একটি সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। তাদের ভাবা উচিত যে, আমরা নিজেদের ইচ্ছামতো সরবরাহ বন্ধ করবো না ও দরিদ্র দেশগুলোর স্বার্থ বিসর্জন দেবো না। এটি বিশ্ববাণিজ্য ব্যবস্থায় বিশ্বাস পুনরুদ্ধার করবে।

সার্বিক দিক পর্যালোচনায় মনে হচ্ছে, বিশ^ এক অবশ্যম্ভাবী ও স্থায়ী খাদ্য সঙ্কটের দিকে ক্রমেই ধাবিত হচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় বৈশি^ক খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা সময় ও আবহাওয়া উপযোগী ও উন্নত করার তাগিদ এসেছে আন্তর্জাতিক বোদ্ধামহল থেকেই। একই সাথে খাদ্য উৎপাদনকারী দেশগুলোতে অবশ্যই আরও অধিক স্থিতিস্থাপক ও উচ্চ ফলনশীল শস্যবীজ ব্যবহার করা দরকার। এখন এমন ফসল উৎপাদনের ওপর জোর দিতে হবে, যা চরম বৈরী আবহাওয়াতেও উৎপন্ন হবে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে সম্ভাব্য ভয়াবহ খাদ্যসঙ্কট মোকাবেলা করা সম্ভব হতে পারে। আন্তর্জাতিক কৃষি ও খাদ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে ‘জোয়ার’ বা ‘বাজরা’র মতো চরম আবহাওয়া সহ্য করে টিকে থাকা ফসলের চাষ আবারও বাড়ানো দরকার। ‘বাজরা’ একসময় আফ্রিকা ও এশিয়ার অনেক অংশের প্রধান খাদ্য ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ গোত্রের খাদ্যশস্য রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে।
জাতিসংঘ ২০২৩-কে ‘আন্তর্জাতিক বাজরা বছর’ হিসেবে মনোনীত করেছে। প্রাচীন এ শস্যের পুষ্টি (প্রোটিন ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টে সমৃদ্ধ) ও জলবায়ুবান্ধব বৈশিষ্ট্যগুলোর ওরপ জোর দিয়ে প্রচার চালানো হচ্ছে। এরই মধ্যে বিজ্ঞানীরা ধান, গম, ভুট্টা ও অন্য গুরুত্বপূর্ণ ফসলের খরা সহনশীল জাত উদ্ভাবনে কাজ শুরু করছেন এবং এতে তারা বেশ সাফল্যও অর্জন করেছেন।

তাই সম্ভাব্য বৈশি^ক খাদ্যসঙ্কট মোকাবেলায় বিশে^র সকল রাষ্ট্রকে অভিন্ন কর্মপন্থা নির্ধারণ করে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করা সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। একই সথে বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় গতিশীলতা আনারও আবশ্যকতা রয়েছে। চলমান সঙ্কটকে কাজে লাগিয়ে কোন খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ অহেতুক ও অযৌক্তিক রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা না দেয় সেদিকেও সবিশেষ দৃষ্টি রাখা দরকার। এ বিষয়ে জাতিসংঘ সহ বিশ^খাদ্য সংস্থাকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। সর্বোপরি বিশে^ খাদ্য উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার জন্য আবহাওয়া বান্ধব ফসলের চাষকে উৎসাহিত করা দরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব যাতে খাদ্য উৎপাদনের না পড়ে দিকে তা নিয়েও কাজ করতে হবে বিশ^খাদ্য সংস্থাকে। অন্যথায় বিশ্বে খাদ্যসঙ্কট চিরস্থায়ী রূপ নিতে পারে।

https://www.dailysangram.info/post/534911